নিজেকে নিয়ে কিছু একটা লেখার চেষ্টা, এখোনো করে যাচ্ছি . . .
শুরুটা ঝলমলে, পাঠকের পাঠে আনন্দও আছে। শেষের কথাগুলো শেষেই বলি …..
আমাদের ফারুক স্যার, যদিও হাতে গোণা কয়েকজন বাদে অধিকাংশই মাষ্টার মশাই নামেই ডাকতেন। সেই তখনকার কথা, তাও আজ থেকে প্রায় ১৩ কি ১৪ বৎসর হবে। সে সময়কার। আমাদের শিক্ষক ছিলেন।
এতগুলো বৎসর আগে তিনি গ্রামের যে স্কুলটাতে পড়াতেন, তার অবস্থাও এখন বেশ জরাজীর্ণ। কোন রকম টিকে থাকা ছাড়া বোধহয় বাকী শক্তিটুকু ওই ইট কাঠের দালানটার আর অবশিষ্ট নেই। দালানটা তারও আগের। তবু টিকে আছে এখনও, কোনমতে বলতে হয়।
ওই সনে হেডমাষ্টার স্যার মারা গেলেন।
অনেকদিন পদটা শূণ্য ছিল। অন্য যে শিক্ষকেরা ছিলেন তাদের অনেকের বয়স প্রায় অবসরের বয়সসীমার কাছাকাছি। ইংরেজী শিক্ষকই প্রথম অবসর নিলেন। মাঝের গ্রীষ্মের ছুটিটাতে ইংরেজী শিক্ষক খোজা হল।
আমাদের ফারুক স্যার, বয়সে তখনও তরুন, মাত্র মফস্বলের কলেজ থেকে পাস করে বেরিয়েছিলেন, আমাদের স্কুলেই প্রথম শিক্ষাকতা।
যতটা আনন্দ পেয়েছিলাম আশ্চর্যও হয়েছিলাম, মাঝে মাঝে গুঞ্জন শোনা যেত, “ফারুক স্যার কি এখানে থাকবে?”- আমরা তো এতসব চিন্তা করতাম না, আধুনিক ধারায় শিক্ষা গ্রহনের অভিজ্ঞতায় আমাদের কাছে বড় ছিল।
ফারুক স্যার ছিলেন এই গ্রামেরই সন্তান, বাবা কৃষক । মাঝে মাঝে স্যারকেও মাঠে দেখেছি, তখন আমরা আরো বেশ ছোট। ওই সময় যতটুকু বুঝতাম, স্যারের মত এমন তরুন ছেলে যে, গ্রামে শিক্ষাকতা করছে ….এই সামান্য মাইনে-তে, যেখানে সাধারণ থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা পাবার আশায় মানুষ তখনই গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছিল, সেখানে স্যার,… প্রশংসা করতেই হয়, আমাদের মধ্যমণিও ছিলেন ! মাষ্টার মশাই থেকে স্যার বলতাম, আর স্যার মানেই ফারুক স্যার- আমাদের আদর্শ শিক্ষক
ওনাকে যখন আমাদের স্কুলে পাই, ক্লাস তখন নাইনে কি টেনে পড়ি। সামনে প্রথম সার্টিফিকেট পরীক্ষা।
স্কুলের বাইরে আলাদা করে ব্যক্তিগত বা দলগত পড়ার কোন প্রচলন ছিলনা সে সময় । স্কুলেই পড়িয়ে দিতেন সব। তারপরেও ফারুক স্যার প্রায়শই রাতে সময় দিতেন, সার্টিফিকেট পরীক্ষার আগ মুহুর্তে আরও বাড়তি যত্ন নিলেন।
প্রায়ই ক্লাস শেষে কথা হত, বিকেলে হয়ত কোন খেলার মাঠের পাশে একমনে শুনে যেতাম স্যারের ভবিষ্যত ভাবনা, দেশ ভাবনা, রাজনীতি হালচাল কোনকিছুই বাদ যেতনা, তবুও আজকালের মত এতটা ফ্রী ছিলামনা, কিছুটা সংকোচ থাকত।
সেবার সার্টিফিকেট পরীক্ষা শেষ হল, ভালই ভালই পাশ করলাম মোটামুটি সবাই, কলেজ শিক্ষা অনুসন্ধানে - স্যারকে ছেড়ে যেতে হবে, প্রথম দিকটাতে খুব খারাপ লেগেছিল কিন্তু পরে অল্পকদিনেই মানিয়ে নিয়েছিলাম।
ঢাকায় তখন আমরা প্রথম। একেবারে অচেনা, নতুন রীতিনীতিতে অনভ্যস্ত-সামলানোটাই মুষ্কিলের ব্যপার । আজ কারও পকেটমার হয়েছে নয়ত কাউকে ছিনতাই করেছে, যতটা দু:খবোধ থাকা উচিত ছিল তার চেয়ে যেন মজার আংশিক হিসেবটাই অনেক বেশী।
কলেজে ভর্তি হবার পরও স্যারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতাম। সমস্যা-পরামর্শ তিনিই সাহায্য করতেন।
মাত্র ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি তখন, স্যারকে ঢাকায় পেলাম। মনে আছে, অনেক যত্ন করেছিলাম যদিও মেসে থাকতাম, তারপরেও সাধ্য দিয়ে। শেষে যাবার বেলায় হাতে কিছু বখশিষ দিয়ে, স্যার বলেছিলেন “তোমাদের এ আপ্যায়ন জীবনেও ভুলবনা, কিছু মিষ্টি কিনে খেও” – কিছুটা আবেগে স্যারের ভেতর সেই গ্রাম্য সরলতা আমাদের কাছে এতটা স্পষ্ট – বলার অপেক্ষা রাখেনা।
স্যারকে লেখা অনেক চিঠির মধ্যে এই চিঠিটা একেবারে অন্যরকম। এই প্রথম স্যারের ছাত্র স্যারকেই পরামর্শ দিয়ে বার্তা পাঠাচ্ছে।
সিদ্ধান্তটা আমিই নিয়েছিলাম, স্যারকে জানাব। আসলে অনেকদিনই তো স্যার ওখানে থাকলেন এবার শহরমুখী হবার পরামর্শ দিলাম। কোন একটা স্কুলে জয়েন করে তারপর কোচিং না হয় ব্যক্তিগত শিক্ষক হলেও রুজি রোজগার কম হবেনা। বরং বাড়তি ইনকামই বেশী হবে। বিষয়টি সহজে নিবেন কিনা, এত সাতপাঁচ ভাবিনি।
স্যার সেদিন মেনে নিয়েছিলেন, মেনেছিলেন বলেই মাস দুয়েকের মধ্যে প্রথমে তিনি, পরে স্ত্রী-সন্তানসহ ঢাকাতেই আবাস গড়ে তুললেন।
…………………………………………….
…………………………………………….
তারপর, বেশ কিছুদিন হল, মাঝে চাকরীতে ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছিলাম, তাই ঢাকার বাহিরে অনেকদিন। স্যারের-ও তেমন সুযোগ হচ্ছিল না, নতুন চাকরীকে পাকাপোক্ত, এদিক টিউশনী, কোচিং-এ ক্লাশ নেওয়া, স্যারকে দোষ দেইনা বরং স্যারের খোজ খবর নিতে না পারার অক্ষমতাটা নিজের ঘারেই নিয়ে নেই।
স্যারের পুরোনে বাসায় গিয়েছিলাম, দেখা করতে। যাবার আগেই ছেড়ে দিয়েছেন, খাটুনি করে খুজে পেলাম নতুন বাসা, একটা ফ্লাটের চারতলাতে পুরো এক সেমিষ্টার নিয়ে থাকেন।
নীচে তার পড়ানোর জন্য আলাদা একটা ফ্লোর। ঢুকতেই মাথার উপরেই কড়া রং-এর বড় সাইনবোর্ড । ভিতরে ছাত্র-ছাত্রী গিজগিজ করছে, ফ্রন্ট ডেস্কও আছে, পরিচয় দিয়ে স্যারের সাথে দেখা করার অনুমতি চাওয়ার মুহুর্তেই পেয়ে গেলাম, বেশ ভাল লাগছিল, স্যার ভুলে যাননি।
- না, না, ভাই এভাবে সম্ভব না
- আপনার জন্যই শুধু অনুরোধ রেখেছি
- এমনিতেই আমার এখন প্রচুর ছাত্র
- দুই ব্রাঞ্চেও সম্ভব হচ্ছেনা
- এখানে তো কমানোর প্রসঙ্গই আসেনা
- আপনি বলছিলেন বলে, তাই ..
- তার উপর এতগুলো ছাত্র দিচ্ছেন
- কিন্তু,
- এত কমে কিভাবে পারি বলুন
- ভাই আমি যেটা বলেছি, প্রতি ছাত্র …
- অনেক কম করেই বলেছি
- যদি সম্ভব হয়, তাহলে বলবেন
- এখানে সহযোগিতার ঘাটতি থাকবেনা
- আচ্ছা এখন রাখি তাহলে… মোবাইলে রিং হচ্ছে
ব্যস্ত স্যার, আমাদের ফারুক স্যার তখনও ফোনে …….
একটু বস বলেই, আবার মোবাইলে … স্যারকে দেখছিলাম খুব সাধারণ চোখেই, খুব সাধাসিধে এখনও আছেন, কোথাও একটা পরিবর্তনও আছে।
- হ্যা বল, তোমাকে তো বলেছি-ই আগে
- দেখ, এমনিতেই আমি ব্যস্ত থাকি
- আচ্ছা ঠিক আছে,
- তুমি যেহেতু আমার গ্রামেরই ছেলে
- এস, আমি কম করেই নেব
- আর হ্যা,
- এগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার দরকার নেই
- আচ্ছা ঠিক আছে
হ্যা বল, তোমার কথা, কেমন আছ।
অনেকদিন পর তাইনা ? কোথায় আছ, কি করছ ইত্যাদি সব …
স্যারই বলে যাচ্ছিলেন সব..
ব্যস্ততা জানতে চাইলে, ক্লাস আর এই নিজের প্রতিষ্ঠানটিকে ঘিরে স্যারের সময়গুলোকে ভাগ করা যে খুব কষ্টসাধ্য তা বোঝালেন, শেষের ৩টি বৎসর তিনি গ্রামে যাননি । সময়কে দুষলেন ঠিকই কিন্তু নিজেকে না। কিন্তু এই সময়েই যে নিজের ভাগ্য ফিরিয়েছেন, সে সরলতার প্রকাশ তখনও ছিল।
অনেকক্ষন ছিলাম, দুপুর প্রায় শেষের দিকে, স্যারের অফিসের কড়া চা খেয়ে তখন মাত্র বের হয়েছি, বেরুবার পথেই এক পলক তাকিয়ে নিলাম ঝুলে থাকা সাইবোর্ডের দিকে, তাতে লেখা ছিল “এফএইচ মেথড” যার অর্থ ‘ফারুক হোসেইন মেথড’
//////////////////////////////////////////////////////////////////////////////////
অফিসের বস ডেকে পাঠিয়েছিলেন, জরুরী তলব, অফিস পিয়নটা বলে গেল, কোনমতেই হুমড়ি খেয়ে বসের রুমের দিকে ….
- না, না, ভাই এত কম দামে পারা যাবেনা
- ব্যবসা তো আমার একদিনের না
- আর তাছাড়া আপনিও ভাল করে জানেন…
- এমনিতেই যে অবস্থা
- ভাই, যেভাবেই বলেন না কেন
- আমাকে আর অনুরোধ করবেন, প্লিজ
- এ দামে সম্ভব না
- এখন যেটা বলছি, সেটাই দেন
- ভবিষ্যতে কথা দিচ্ছি, কমিয়ে রাখব
- আচ্ছা ঠিক আছে ভাই, ঠিক আছে
ফোনটা ছেড়ে দিয়েই একান্তই তার ব্যক্তিগত কাজের আদেশ দিলেন, বসের ছেলেকে ‘এফএইচ মেথডে’ ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসতে হবে। ওখানে খুব ডিমান্ড তখন, যারা পড়ে তারাই নাকি ভাল করে।
রীতিমত প্রতিষ্ঠানের নামে …. মাত্র শুরু করেছিলেন বস …
কথা না বাড়িয়ে যখন রুম থেকে বেরিয়ে আসছিলাম, আমার ফারুক স্যার আর এই বসের মধ্যে কোন পার্থক্য খুজে পেলামনা। আমার বস ব্যবসা নিয়ে কথা বলছিলেন, আমার স্যারের কথার সুরও সেরকম ছিল, তাহলে কি স্যার তার শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করছেন ? শিক্ষাকে পুজি করে ব্যবসাকেন্দ্র খুলে বসেছেন? যেখানে শিক্ষার্থী নামের অসংখ্য মানুষ লক্ষ, লক্ষ কোটি টাকা ইনভেষ্ট করছে শিক্ষা নামক ব্যবসায় ঢুকে জ্ঞান অর্জনের নেপথ্যে।
সেদিন আমাকে সবচেয়ে কঠিন কাজ করতে হয়েছিল, ছাত্রের সাথে শিক্ষকের দরাদরি, শিক্ষা বেচাকেনা নিয়ে দরকষাকষি।
আমার বসকে কখনো বলিনি তিনি আমার ছেলেবেলার শিক্ষক ছিলেন, পাছে আমার শিক্ষককে যেন ভেবে না বসে নিজের মত কোন ‘ব্যবসায়ী’
আমাদের ফারুক স্যার,
আমাদের "মাষ্টার মশাই" অত:পর "স্যার" এবং তারও অনেক পর “এফএইচ মেথডে’র” --- মেথড টিচার।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।