ইমরোজ
"বাংলা" একটি বিশাল নাম। বাঙ্গালী চিরদিনই স্বাধীনচেতা। বাঙ্গালীর বাঙ্গালীয়ানা হার মানায় অন্যান্য জাতিকেও। তবে বাঙ্গালীর এতটা কন্সার্ভেশন কেন তা আমাদের বুঝতে হবে। আমরা সবকিছু নিজের মত করে করতে চাই।
আমার এলাকায় বিদেশের কেউ এসে হাতাহাতি করবে এটা আমরা পছন্দ করি না।
বাংলা এইজন্য ইতিহাসে অনেকটা সময় জুড়ে স্বাধীন ছিল। সম্রাট আকবরের আমলেও বাংলা স্বাধীন থেকেছে। ঈসা খাঁয়ের সাথে আকবরের একটা চুক্তিই ছিল যে বছর বছর আমরা খাজনা দেব তোমরা আমাদেরকে কিছু বলতে পারবা না। সম্রাট জাহাঙ্গীর বাংলা দখল করলেন ঠিকই।
কিন্তু তা নিজের দখলে বেশিদিন রাখতে পারেন নাই। তার কারণ হলো ভারতীয়দের আমরা চিরদিনই বিদেশীদের তালিকায় ফেলেছি। ভারতীয় কেউ আমাদের উপর খবরদারি করবে এটা বাঙ্গালী মেনে নেবে না।
এইজন্য বাংলা বিহার উড়িষ্যা স্বাধীন ভাবে নবাবের হাতে পরিচালিত হত। বৃটিশ আমলের কথায় চলে আসি।
যখন বৃটিশরা বাংলা দখল করে তখন বাংলার নবাব ছিলেন সব থেকে শক্তিশালী। তাঁর সাথে পেরে ওঠার ক্ষমতা বৃটিশদেরও ছিল না। কিন্তু বৃটিশরা একরকম কারচুপি করে এই যুদ্ধে জিতে গেল। তারপরের ইতিহাস সবারই জানা।
বৃটিশরা জানত, বাংলার শক্তি কতখানি হতে পারে।
ইতিমধ্যে ঘটে যায় কতগুলো ঘটনা। তার মধ্যে উল্লেখ্য হলো তিতুমীরের আন্দোলন। যার সাথে ৮৩ হাজার কৃষক জড়িত ছিল। এবং তিতুমীর বাংলাকে স্বাধীন ঘোষণা করতে চাইলেন। বৃটিশরা তাকে পরাজিত করলেও তাদের মনে একটা বিষ এটে গেল।
বাংলাকে এক থাকতে দেওয়া যাবে না। বাংলা এক থাকলে যেকোন বড় আন্দোলন তারা গড়ে তুলবে। বাংলার শক্তি তখন বৃটিশদের জানা হয়ে গেছে।
কিন্তু বাংলার এই ভাঙ্গন কেমনে ধরাবে এইব্যাপারটা তারা বুঝতে পারছিল না। তখন একটা বিষয় তারা খেয়াল করল।
বাংলার মুসলিমরা বৃটিশ শিক্ষার বিরোধী। কিন্তু কোলকাতার হিন্দুরা পাশ্চাত্য শিক্ষায় দিনকে দিন উন্নতি করছিল। জিনিসটা বুঝতে পেরে তড়িৎ গতিতে তারা কাজ করল। বঙ্গভঙ্গের ডাক দিল। তার কারণ হিসেবে দেখাল এত বড় রাজ্য নাকি চালানো অনেক সমস্যা।
অতচ তারা তখন বিশ্বের অর্ধেক পরিচালনা করছিল। তা যা হোক পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালীরা ষড়যন্ত্র বুঝতে পারে। কারণ তাদের মধ্যে তখন জাতীয়তাবোধের জন্ম হয়েছে। এদিকে পূর্ববঙ্গের মানুষ অধিকাংশই মুসলিম। কিন্তু তারা তখনও পাশ্চাত্য শিক্ষা দ্বারে পৌছায়নি।
বৃটিশরা কোলকাতার আন্দোলনের জবাব দিল এইভাবে, যে তারা নাকি পূর্ববঙ্গের মুসলিমদের উন্নতি চায় না। তারা একচোখা ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু বাংলার মানুষের মধ্যে বিভেদের কবর খোড়া ততদিনে হয়ে গেছে। বাংলার মানুষ হিন্দু মুসলিম চিনে ফেলেছে। হিন্দু কখনও মুসলিমের ভাল চায় না, আবার মুসলিম কখনই হিন্দুদের ভাল চায় না, এমনই বিশ্বাস হলো তাদের।
বঙ্গভঙ্গ রদ হলেও বাংলার মানুষের মাঝে বৃটিশরা বেড়া টেনে দিয়েছে। এখন আর এক হওয়া সম্ভব নয়।
চেতনাকে বিভক্তকারী বৃটিশরা বানাতে শুরু করল, খান বাহাদুর, নবাব নামক কতগুলো চামচা। যারা বৃটিশদের চামচামি করে চেতনাকে আরও তাড়াতাড়ি বিভক্ত করে ফেলল। এদিকে বঙ্গভঙ্গ রদ হতে দেখে কোলকাতার বাবুরা চুপ।
তাদের কোন আপত্তি নেই।
এই তো গেল ইতিহাসের কথা। এই বিভক্ত চেতনা পূর্ববঙ্গের জন্য হয়ে গেল শাপে বর। কেন তা একটু পরে বলছি। ১৯৪৭ সালে ভারতকে ভাগ করে দেওয়া হলো।
কোলকাতাকে ভাগ করে দেওয়া হলো ভারতের ভেতর। পূর্ববঙ্গ পরে গেল পাকিস্তানের ভেতর। এইবার শুরু হলো ভারতের খেলা। তারা দেখল বাংলাকে শান্ত রাখতেই হবে। কারণ বাংলা যেকোন সময় স্বাধীন হতে পারে।
কিন্তু এইখানে একটা জিনিস কাজ করল। ভারতের ক্ষমতা হিন্দুদের হাতে। আর তখন এত দাঙ্গা হাঙ্গামার মধ্যে কোলকাতার হিন্দুদের কাছে এইটাই বেস্ট সল্যুশন বলে মনে হলো। মুসলমানদের সাথে তাদের আর হবে না এইটা তারা বুঝে গেছে। ওদিকে পূর্ববঙ্গ তো খুশি।
তাদের ক্ষমতাভার মুসলিমদের হাতেই আছে। আর হিন্দু মুসলমান কেচাল হবে না।
কিন্তু ততদিনে পূর্ববঙ্গের মানুষের জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত হয়েছে। এরা হিন্দু কী মুসলিম আমি শালার বাঙ্গালী মাছ ভাত ছাড়া কিছু বুঝি না বাংলা ছাড়া কিছু বুঝি না। উর্দূ ভাষীদের সাথে যুদ্ধ লেগে গেল।
ভুলটা ছিল পাকিস্তানেরই। তারা প্রথম থেকেই পূর্ববঙ্গের উপর খবরদারি করা শুরু করে। যেটা ভারত পশ্চিম বঙ্গের উপরে করে নাই।
আমরা ৭১ সালে স্বাধীন হলাম। বাংলা পলাশীর প্রান্ত থেকে ফিরে আসল ঠিকই।
কিন্তু টুকরো হয়ে। এই বাংলা প্রকৃত ইতিহাসবিদরা মেনে নেবেন কেমন করে? ভারত কী টুকরো ভারত মেনে নিত? কখনই না। কিন্তু আমরা মেনে নিলাম। কারণ আমাদের বাংলার চেতনাবোধ আগেই দ্বিখন্ডিত হয়ে গেছে। তাতে কী? আমরা মুক্ত হতে পেরেছি।
আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি।
পশ্চিমবঙ্গকে খুশি করার জন্য, এবং পাকিস্তান বিদ্বেষের কারণে ভারত একাত্তর সালে আমাদের সাহায্য করেছে। তবে এখানে টপ প্রায়রিটি ছিল এই সুযোগে যেন দুই বাংলা এক হতে (কারণ সীমান্ত তখন উন্মুক্ত) না পারে।
বাংলাদেশের বিজয়ের পরেই ভারত উঠেপরে লাগে বাংলাদেশের উপর। তাদের গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশ সম্পর্কে বিকৃত খবর পেশ করা শুরু করে।
যাতে পশ্চিমবঙ্গের মানুষেরা কোন কালেও বাংলাদেশের সাথে জোরা লাগতে চায়। সংবাদমাধ্যম ব্যাবহার করে ভারত পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মনে এক বিকৃত বাংলাদেশ উপস্থাপন করতে থাকে। এটার কারণ মূলত দুই বাংলাকে এক করতে না দেওয়া। কিন্তু তবু সংস্কৃতি বারবারই দুই বাংলাকে এক করেছে। গান, লেখা, উপন্যাস সবসময় দুই বাংলার মধ্যেকার মুক্তচিন্তার মানুষেরা বিনিময় করে আসছে।
ভারত তাদের ষড়যন্ত্র আগে থেকে ঠিক করে রাখে। তারা মুখে বাংলাদেশ সম্পর্কে মিষ্টি ঝরালেও বৃটিশ কায়দায় গণমাধ্যম দিয়ে কোলকাতার বাঙ্গালীদের বাঙ্গালিত্ব নষ্ট করে। তারা শুধু এখানে থেমে থাকেনি। বাংলাদেশের কোন চ্যানেলকে সেখানে ঢুকার অনুমতিও তারা দেয়নি। তাহলে আর দুই বাংলা কী করে এক সংস্কৃতির নিচে আসবে? আর ভারতীয়ম অপসংস্কৃতি খেতে ভাল না হলেও কোলকাতার বাবুরা বোম্বের দাপটে সবই ভুলে ভুল খাবার খেতে শুরু করলেন।
পশ্চিম বঙ্গীয় সংস্কৃতি বলে আর কিছুই থাকল না।
বাংলাদেশের কতিময় মৌলবাদী গোষ্ঠি সমূহ ভারতের বদনাম শুরু করে। তারা ভারতের সংবাদমাধ্যমের খবরকে প্রাধান্য দিতে শুরু করে। আর এই দেশের সাধারণ মানুষকে ভারত বিদ্বেষী করে তোলে। এরও মূল কারণ দুই বাংলাকে দূরে রাখা।
নীরদ সি চৌধুরী তাঁর একটা প্রবন্ধে বলেছেন, "পূর্ববঙ্গের মুসলিমরাই পারবে"। তখনও আমাদের স্বাধীন হতে অনেক দেরী। আমরা পেরেছিও। কিন্তু ভারতের জন্য আমাদের পূর্ণাঙ্গ দেশটা হারিয়েছি।
এখন মজার কথা হলো, পূর্ববঙ্গের বাঙ্গালীরা তো জাত বাঙ্গালী।
এরা তো বাংলার ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে হারাতে দেইনি। মনে রাখবেন দেশটার নাম কিন্তু "বাংলাদেশ"। আর ঐদিকে নিজেদের দেশ নাই বলে পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীরা কোথায় দাঁড়াবে? তাদের প্ল্যাটফর্ম হিন্দী না। তবে বাংলাও না। যদিও মাতৃভাষা বাংলা।
তারা ভারতের দুর্নাম সহ্য করতে পারেন না, অথচ নিজেরা ভারত সরকারকে ভালবাসেন না। পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালীদের আরেকটি বিড়ম্বনাও আছে। তা হলো, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তাদেরকে একটা পুতুল (বামফ্রন্ট) সরকার দিয়ে ইচ্ছে মতন শাসন করে যাচ্ছে। সেটা তারা বুঝেও না বুঝার ভান করে। কারণ তাদের চেতনা ভারতের ডান্ডার নিচে পরে লেপ্টে গেছে।
"কী দরকার ভাই, ভালই তো আছি, দিনে দুই একটা হিন্দী বললে বাঙ্গালীত্ব যায় না"।
তবে তাদেরকে বলি, বাংলা ভবিষ্যতের জন্য স্থির হয়েছে। আমাদের শত সমস্যা হলেও বাংলা মা কে আকড়ে ধরে সারাদিন বাংলা বলে বেশ কাটিয়ে দিচ্ছি। উর্দু বললে আমাদের সমস্যা আছে। আমার মায়ের ভাষা না যেটা কেন দিনের মধ্যে দু একবার হলেও বলবো?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।