হরিপদ লাল। নন্দীগ্রাম পোষ্ট অফিসের পোষ্টম্যান। অপেক্ষা করছেন একটি চিঠির। যে চিঠি তিনি পৌছে দেবেন গ্রামের কোনো এক ঘরে। সেই ঘরের মানুষগুলোর চোখে হরিপদ সেই উচ্ছলতা, সেই আবেগ দেখতে পাবে।
কতোদিন তা দেখা হয় না! চিঠি যে আসে না!
আধুনিকযুগে মানুষ যে চিঠি লেখা ভুলেই গেছে। তারা এখন মোবাইল পেয়েছে। গ্রামের প্রতিটি ঘরে পৌছে গেছে কন্ঠস্বর শোনার যন্ত্রটি। কোনো মা তার সন্তান, কোনো স্ত্রী তার স্বামীর অনুভূতি সম্বলীত কাগজ বন্দী করা চিঠির জন্য আর অপেক্ষা করে না। আপেক্ষা এখন ফোনের আওয়াজের।
ফোন আসবে সুদূর থেকে। আওয়াজ হবে। একটি বাটনে চাপ দিবে। বলবে, হ্যালো। তারপর ওপাশ থেকে ভেসে আসবে জীবন্ত মানুষের গলার আওয়াজ।
এত সহজভাবে কাছের মানুষকে পেলে কি আর চিঠির প্রয়োজন আছে!!
পোষ্ট মাষ্টারও অফিসে আসা ছেড়ে দিয়েছেন। মাঝে মাঝে আসেন। পাঁচ-দশমিনিট অফিসে থেকে চলে যান। একদিন তিনি হরিপদকে বলছিলেন, হরি রে, চিঠির মধ্যে যে তীব্র মায়া, তীব্র আবেগ, তীব্র ভালোবাসা ফুটে উঠতে পারে তা যেন মানুষ ভুলেই গেছে। তারপর দীর্ঘ এক নিশ্বাস ছেড়ে বলেন, অন্যের কথা আর কি বলবো! আমিই নিজেই তো প্রযুক্তির কাছে হার মেনেছি রে।
প্রযুক্তি আমাদের সবার আবেগকেও হাত করে ফেলেছে।
হরিপদ এসব কথার মানে বোঝে। আগে যখন সেই দূর থেকে সে চিৎকার করে বলে উঠতো, চিঠি, চিঠি। ঘর থেকে বউ-ঝিরা দৌড়ে বেরিয়ে আসতো। মানুষের অপেক্ষার দেয়াল ভাঙার যে দৃশ্য! তা যে কি মধুর হতে পারে! এসব দেখে হরিরও মাঝে মাঝে চোখে জল চলে আসতো।
হরির সামনেই চিঠি খুলে পড়া শুরু করে দিতো। তারপর ঘরের কর্তা বলতেন, কোথায় রে সব? হরি রে সরবত দাও। চেহারাটা যে শুকাইয়া গেছে। হরি যেন সবার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।
হরি কে দেখা মাত্রই সবার মাঝে যে আবেগ ফুটে উঠতো।
তা হরি আজও ভুলতে পারে না। কতোদিন সে আবেগ হরি দেখে না গ্রামের মানুষগুলোর মাঝে!
হরি তার বউকে একদিন বলছিল, বুজলা লক্ষীর মা, মানুষ তো ভালোবাসা কি জিনিস ভুইলাই যাইবো।
- কেন?
- আরে, কাছের মানুষরে যদি এতো সহজে পাইয়া যায় তাহলে ভালোবাসা কি জিনিস, তা কি করে বুজবো ওরা!! ভালোবাসা তখন গভীর হয় যখন অপেক্ষার প্রহর থাকে। দীর্ঘ প্রহর।
- মানি তো বুঝলাম না।
- দেহো না! মানুষের এহন আর চিঠির দরকার হয় না। কেউ কাউরে আর চিঠি লেহে না। তাই আর চিঠির অপেক্ষা করারও দরকার হয় না।
লক্ষীর মা মাথায় এতো কিছু ঢুকে না। তবে সে বুঝতে পারে, হরি কষ্টে আছে তার কর্মহীনতা নিয়ে।
তার কাজ চিঠি পৌছে দেয়া। চিঠি না আসলে কাজ যে নেই! তাই তো এখন হরিপদই অপেক্ষা করছে একটি চিঠির। যে চিঠি তাকে পৌছে দিতে হবে গ্রামের কোনো এক ঘরে।
একদিন তপ্ত রৌদ্রদাহ দুপুরে একটি চিঠি এলো। হরিপদ আনন্দে আত্মহারা।
যাক্, অনেকদিন পর তার কাজ করা হবে। অনেকদিন পর কারও অপেক্ষার প্রহর ভাঙবে। অনেকদিন পর কারও চোখে আনন্দের জল আসবে। চিঠিটি হাতে নিলো হরিপদ। আরে! এতো তার নামে! তাকে আবার চিঠি লিখলো কে? খাম খুলে পড়ে নিলো।
চিঠি হাতে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। চিঠিটিতে লেখা,
লক্ষীপুর জেলার রামগন্জ থানার নন্দীগ্রাম পোষ্ট অফিসটি সরকার বন্ধ ঘোষনা করেছে। আর তাই কর্তৃপক্ষ, পোষ্টম্যান, "হরিপদ লালকে" সকল পাওনা বুঝে নেয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। এই চিঠির পাওয়ার পর হরিপদকে পোষ্টমাষ্টারের সাথে যোগাযোগ করে হেড অফিসে আসার অনুরোধ জানানো হলো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।