আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আধুনিকতা ০১



একটা সমাজ যখন ধারাবাহিক ভাবেই মাঝারি মাপের মানুষদের লালন করা শুরু করে তখনই হয়তো সমাজে বড় মাপের মানুষের আগমন বন্ধ হয়ে যায়। বিপনন ও বিজ্ঞাপনের জোরে মাঝারি মাপের মানুষের বৃহৎ প্রতিমূর্তি তৈরি করা সম্ভব অনায়াসে। তথ্য আমাদের হাতের নাগালে এলে যাচাই বাছাই না করেই তথ্য হজম করে ফেলবার বদভ্যাসের শিকার সবাই। সুতরাং দিনে দিনে প্রচারমাধ্যমই ইশ্বরের ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে এখানে। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ভাল মানুষ, সাদা মনের মানুষ খোঁজার প্রক্রিয়া চলছে, কর্পোরেট হুমড়ি খেয়ে পড়ছে তাদের পৃষ্টপোষকতার নামে বিজ্ঞাপনের জৌলুসে তাদের বিভ্রান্ত করতে।

এবং আমরা সুখ্যাতি শুনেই পরের মুখে মিঠাই খেয়ে মুগ্ধ। সভ্যতার এই পর্যায়ে মাঝারি মাপের মানুষদের জয়জয়কার, সাধারণ মানুষের বিখ্যাত হয়ে উঠবার বাসনা রয়েছে তবে প্রতিভায় খামতি বলেই তারা বিশুদ্ধ যোগ্যতায় নিজের ছাপ রাখতে পারে না সভ্যতায়, সমস্যা নেই, আছে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এবং আকশা সংস্কৃতির উদার দুয়ার। চ্যানেলে চ্যানেলে আকাশে শুধু ব্যান্ড উইথের গুঁতোগুঁতি। বিগব্রাদার, আমেরিকান আইডল, ড্যান্স উইথ দ্যা হিরোস, এসবের অনুকরণে সব মহাদেশেই স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো অনুষ্ঠান তৈরি করছে। ক্লোজ আপ ওয়ানের সাফল্যের পরে এসেছে ক্লোজ আপ ওয়ানের পরবর্তী খন্ড, সে যাত্রা শেষ হলে পুনরায় নতুন করে শুরু হয়েছে তৃতীয় বর্ষের ক্লোজ আপ ওয়ান প্রতিযোগিতা।

এখানে যারা অংশগ্রহন করছে তারা সবাই খুব খারাপ মানের গায়ক গায়িকা এমন নয়, তবে কয়েক মাসের চর্চায় তাদের ধারাবাহিক উন্নতি এবং দর্শকের প্রত্যক্ষ ভোটে তাদের সেলিব্রিটি হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াতে খুব কম সময়ই ভালো মানের শিল্পীদের কদর বুঝতে পারছে শ্রোতা এবং দর্শকেরা। সাধারণ মানুষ স্যাটেলাইট চ্যানেল দেখবার জন্য টিভি পর্দায় দৃষ্টি এঁটে বসে থাকে। বিনোদনের জন্য অন্য কোনো পরিশ্রমে যেতে নারাজ মানুষ। জটিল এবং পরিশ্রমি উপলব্ধিগত বিনোদনে নারাজ মানুষেরা সহজপাচ্য হিসেবেই সস্তা বিনোদন গ্রহন করছে। সস্তা বিনোদনের সাথে সংযুক্ত হয়েছে সস্তা মানের নির্মাতা ও পরিচালকেরা।

তাদের সাথে তাল মিলিয়ে অনুষ্ঠান পরিকল্পকদের মানও নিম্নগামী। সুতরাং মেধার অবমূল্যায়নের তুলনায় মেধার অতিমূল্যায়নেই সংকট তৈরি হয়েছে। এই আকাশ সংস্কৃতির যুগে যখন বড় মাপের প্রতিভারা নিজস্ব পরিশ্রমের কদর পাচ্ছেন না। কিংবা যারা নিজস্ব বিশুদ্ধতা এবং উৎকর্ষের কথা বিবেচনা করে অতিপ্রজ নয় তাদের সমস্যা আরও বেশী। প্রচার মাধ্যম নিয়মিত নায়ক ও মহানায়ক খুঁজছে।

নিয়মিত পত্রিকার হেড লাইনে আসবার প্রতিযোগিতায় অনর্থক কুচুটে আচরণ করছে মানুষেরা। সমালোচনার নামে অহেতুক ব্যক্তিবিদ্বেষের প্রকাশ ঘটছে। এইসব অঘটনের সাথে রাজনীতিও কোনো না কোনো সংযুক্ত হয়ে যায়। নিজের প্রতি সহানুভুতি বৃদ্ধির জন্য অনেক রকম সংস্থাই নিবেদিতপ্রাণ। নিজেদের ভালোমানুষির মুখোশ উর্ধে তুলে ধরতে প্রথম আলোও ত্রানের টিনের গায়ে নিজের লোগে লাগিয়ে রাখে।

যেকোনো অনুদানই যখন বিজ্ঞাপনের নিমিত্তে ব্যবহৃত হয় তখন এর পেছনের ভালো মানুষি উদ্যোগটা রাজনৈতিক নোংরামি মনে হয় আমার কাছে। সুতারং সিডর আক্রান্ত জনপদে প্রথম আলোর ত্রান পৌঁছায়, জনগণের সংগৃহীত টাকায় সেখানে গৃহ নির্মান হয়, সেই গৃহের দেয়ালে শোভা পায় প্রথম আলোর বিজ্ঞাপন, যা কিছু ভালো, তার সঙ্গে প্রথম আলো। সুশীল সমাবেশে সুশীল সম্মোহনে বিমুঢ় মানুষগুলোর কখনই ভাবনায় আসে না, অনুগ্রহ গ্রহনের পরে সেটার বিজ্ঞাপন হয়ে উঠবার মতো নিগ্রহ দ্বীতিয়টি হতে পারে না। মানুষ অনেক রকম মানসিক বিকার চিহ্নিত করেছে। অতিরিক্ত মনোযোগ পাওয়ার চেষ্টার মানসিক সমস্যার নাম এডিএস।

চেতনানিস্তেজকারী ড্রাগ দিয়ে এটার চিকিৎসা করা হয়। হোমোফোবিয়া যদিও মানববিদ্বেষ নয় তবে এটাও মানসিক বিকার। তবে বর্তমানে প্রচারমাধ্যমের কল্যানে ফিলানট্রফিক মনোবিকার দেখছি প্রতিদিন। দেখছি মাঝারি কিংবা নিচু মানবের ক্রমশ উত্থান। বিতর্কিত হয়ে উঠবার প্রচেষ্টা না থাকলেও শুভ উদ্যোগ বিতর্কিত হয়ে উঠতে পারে সামাজিক মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক বিবেচিত হলে, তবে অগ্রসর মানুষেরা যা উপলব্ধি করে তা সাধারণের উপলব্ধিতে আসতে অনেকগুলো বছর অতিক্রান্ত হয়।

উন্মাদ,বায়ুগ্রস্থবিবেচিত হওয়া মানুষগুলো সাধারণের ব্যতিক্রম বলেই তাদের মতাদর্শ আক্রান্ত হতে থাকে। এদের অনেকেরই মানসিক বিকার থাকে সত্য, তবে এইসব জঞ্জালের ভীড়েও কিছু উন্নত মানুষ ও নৈতিকতা রয়ে যায়, অতিরিক্ত বাণিজ্যিকিকরণের এই যুগে সাধারণের ব্যতিক্রম হয়ে উঠার অপরাধে সমাজচ্যুত কিংবা সামাজিক নিগ্রহের শিকার হওয়ার স্বাভাবিক ঘটনাগুলোকে অঘটন বলা ঠিক হবে না। স্বল্প চর্চিত মতবাদ এবং স্বল্পজনের বিশ্বাসের অনুরণনে একদিন সামগ্রীক সামাজিক পরিবর্তন হয়তো সুচিত হবে। তবে প্রচারমাধ্যমের জোরে সাধারণ মানুষের স্বপ্ন পুরণের নামে মাঝারি মানের মানুষের স্তব ও স্তুতির ব্যধি নিরাময় না হওয়া পর্যন্ত উন্নত মানসিকতা ও মেধার চর্চার জায়গাটাতে শূন্যতা রয়েই যাবে। প্রণোদনা না থাকলে শুভবোধ আঁতুরে মারা যায়।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।