আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আধুনিকতা

জগৎ পারাবার তীরে শিশুরা করে খেলা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মুসলিম জাতির গৌরবময় ভূমিকার যুগ ইতিহাসে মধ্যযুগ বলে অভিহিত। তাদের পতনের সংগে সংগে বাগদাদ ও কর্দোভার জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাধনার কেন্দ্রগুলোর আভা যখন ম্লান হয়ে আসে। তখন ত্রয়োদশ শতকের চতুর্থ ও পঞ্চম দশকে প্যারী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন ও অধ্যায়পনাকালে মুসলিম চিন্তাবিদদের রচিত গ্রন্থাবলীর ছিন্নপত্র থেকে স্ফুলিংগমালা কুড়িয়ে নিয়ে ইউরোপে প্রথম বিজ্ঞানের দীপ জ্বালেন বৃটিশ বিজ্ঞানী-দার্শনিক মনীষী রজার বেকন। বহু শতাব্দির অন্ধকারাচ্ছন্ন ইউরোপের অচেতন মনে এ আলোক সম্পাতে যে চেতনার সৃষ্ঠি হয়, তারই ঐতিহাসিক নাম ইউরোপীয় রেনেসা। আর এখান থেকেই শুরু হয় আধুনিক যুগ।

এ আধুনিক যুগের অগ্রগতির সংগে সংগে ইউরোপ বুদ্ধিবৃত্তিক সাধনা ও সামাজিক ঘাত সংঘাতের মাঝ দিয়ে যে নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ এবং সেগুলোর ফলিত রূপ লাভ করতে লাগল, সেটাই হল সংশ্লিষ্ট যুগের আধুনিকতা। দশকের পর দশক শতকের পর শতক অতিক্রান্ত হবার সাথে সাথে এ আধুনিতার ধারণা ও রূপ পরিবর্তিত ও বিবর্তিত হয়েছে। এভাবেই ষোল, সতের, আঠারো এমনকি ঊনিশ শতকের আধুনিকতা থেকেও বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের বর্তমান আধুনিকতা ভিন্নতর রূপ লাভ করেছে। অনেক বিষয় যা সে সময়ে আধুনিক ও প্রগতিশীল বলে স্বতস্ফুর্ত স্বাগতম লাভ করেছে, আজ তা সেকেলে, প্রতিক্রিয়াশীল ও অবশ্য-পরিত্যাজ্যের পর্যায়ে নেমে গেছে। বেকনের সমমাময়িক উত্তরসূরী ও জ্ঞানবিজ্ঞানের সাধকেরা মুসলিম চিন্তাবিদদের গ্রন্থাবলী থেকে জ্ঞানবিজ্ঞানের শিক্ষা নিলেও ক্রুসেডের প্রতিক্রিয়া তাদের মধ্যে সক্রিয় থাকায়, জীবন ও জগতের প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রাথমিক যুগে মুসলিমদেরকে বিজ্ঞানের সাধনা ও প্রয়োগ প্রয়াসে উদ্বুদ্ধ করেছিল, আল-কুরানের সে দার্শনিক পট-ভূমিকাকে তারা গ্রহন করলেন না।

পক্ষান্তরে কুসংস্করাচ্ছন্ন গোড়া পুরোহিত শ্রেনির নেতৃত্বে পরিচালিত খৃষ্ঠিয় গীর্জা নামে জীবন বিমুখ পারলৌকিকতার বাণী প্রচার করে সমাজের সর্বস্থরে সর্বপ্রকার অত্যাচার, নিপীড়ন ও শোষণ চালিয়ে জনমনে ব্যাপক অসন্তোষের বীজ বপন করা হয়। বুদ্ধিজীবি শ্রেনির এক অংশ গীর্জাকে এবং সেই সংগে ধর্মকে যাবতীয় অনাচারের সাথে সমার্থক মনে করে ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত জীবনযাপন প্রণালী পাবার প্রয়াসে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্ঠা চালাতে শুরু করে। যাবতীয় জীবনকে ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত করার এ অভিযান চলাকালেই ডারউইন তার সারভাইবেল অব দ্য ফিটেস্ট তত্ব প্রকাশ করেন। একদিকে ধর্মীয় প্রভাব লোপ পাবার সাথে সাথে মানবপ্রেম, ভ্রাত্বীত্তবোধসহ সার্বজনীন মূল্যবোধগুলো বিলুপ্ত হতে শুরু করে এবং তার স্থলাভিষিক্ত হতে থাকে মরনোতত্তর জবাবদিহিতামুক্ত দ্বায়িত্ববোধহীনতা। অপর দিকে এ ধারায় এসে মিলিত হয় ডারউইন তত্বের মূখ্য বাণী “জাগতিক সুখ-ভোগের ক্ষেত্রে আত্ম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামই মানুষের মৌল প্রকৃতি”।

ফলে সমাজের সর্বস্থরে ছড়িয়ে পড়ে উগ্র ভোগমুখীন প্রতিযোগীতা, আর তা থেকেই জন্ম নেয় ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদ বা লেইসেজ ফেয়ার। শিল্প বিপ্লবের পর সামন্ত শ্রেণীকে পরাভূত করে যে বণিক শ্রেণী সমাজে প্রাধান্য লাভ করে ও বিভিন্ন দেশের রাস্ট্রীয় যন্ত্রকে করায়ত্ব করে, জাগতিক স্বার্থ উদ্ধারের তাগিদে তা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের পতাকাকে উচ্চে তোলে ধরেন। রাষ্ট্রীয় যন্ত্রকে তারা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রতিযোগীতার ময়দানে, ফলে উৎপত্তি হয় রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক নিয়ন্ত্রণবাদ বা মার্কেন্টালিজমের। আর এ রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক নিয়ন্ত্রণবাদের দড়াবাজী থেকেই জন্মলাভ করে জাতীয়তাবাদ বা ন্যাশনালিজমের। এমনিভাবে, দায়িত্ববোধহীন ভোগবাদের বুনিয়াদে গড়ে ওঠা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র রাষ্টীয় বাণিজ্যিক নিয়ন্ত্রণবাদের আওতায় লালিত ও উদারনৈতিক অর্থ-নীতির মুক্ত অংগনে বর্ধিত হয়ে পুজিবাদী দানবের রূপ পরিগ্রহ করে নির্মম শোষণ ও নিষ্পেষণ চালিয়ে ইউরোপীয় সমাজের সামগ্রিক জীবনকে বিষিয়ে তোলে, প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদের মুষ্ঠিমেয় অধিকারীগণ আকন্ঠ ভোগবিলাসে নিমিজ্জত হয়ে সমাজের উপরতলাকে পরিণত করে অবাধ ব্যভিচারের উন্মোক্ত চারণভূমিতে, সেখান থেকে নির্বাসিত হয় যাবতীয় যৌন নৈতিকতা।

অন্যদিকে জীবনের নিম্নতম চাহিদা পূরণে অসমর্থ বিপুল জনতার ললাটে নেমে আসে অনশন, মহামারী আর অকাল মৃত্যু। ক্ষুধার যন্ত্রণায় তাদের নাবালক সন্তান সন্ততি, স্ত্রী পরিজন বাধ্য হয় কারখানার শ্রমিকের দলে নাম লেখাতে। পরিবেশের ধুম্রজালে আধাঅন্ধ বুদ্ধিজীবিরা তাকে ব্যাখ্যা করলেন 'নারী স্বাধিনতা' বলে। এ অবস্থার মাঝেও খ্রীস্ট্রীয় গীর্জা প্রচার করেত থাকে জীবন বিমুখতার বাণী। ফলে ভোগোন্মত্ত পুজিবাদী শ্রেণি ও তাদের বুদ্ধিজীবিরা ধর্মের প্রতি প্রদর্শণ করতে থাকে অনুকম্পা।

আর বঞ্চিত-নিপীড়িত শ্রেণি ধর্মকে ভাবতে থাকে শোষণের পরোক্ষ সমর্থক হিসেবে। এ সময় কার্লমার্ক্স ঘোষনা করেন 'দুনিয়ার সব অপকর্ম আর অনাচারের মূল হচ্ছে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদ ও তা থেকে উদ্ধুত পুজিবাদ। আর ধর্ম সেই পুজিবাদের হাতিয়ার, নিপীড়িত শ্রেণিকে নেশায় বুদ করে রাখার আফিম'। পুজিবাদী সমাজ কাঠামো তথা পরিবার ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি সংস্থাসমূহকে উৎখাতের ঘোষনা সম্বলিত চরমপত্র প্রকাশের সাথে সাথে তিনি পেশ করেন এক নতুন বিকল্প পরিকল্পনা সমাজবাদী বা সোশালিজম ও সাম্যবাদ বা কমিউনিজম। পুজিবাদী সমাজের তোলনায় এ সমাজে অধিক সংখ্যক লোক দুবেলা দুমুঠো খেতে পারল সত্য কিন্তু তার বিনিময়ে তাদের কন্ঠে বেধে দেয়া হল রাস্ট্র নামক এক কল্পিত দানবের আনুগত্যের রশি।

সেখানকার বৃহত্তর জনসমাজ মানুষের স্থর থেকে নেমে এল বড়লোকের গোয়ালের দানাখোর পশুর পর্যায়ে। এ ছাড়া পুজিবাদের আওতায় উত্তরোত্তর অতি শিল্পায়নের ফলে সম্প্রসারিত যন্ত্রশক্তি বিপুল জনশক্তিকে বেকার করে দেয়। এতে যে অভ্যন্তরীণ সংকটের সৃষ্ঠি হয় তা থেকে উত্তোরণ করতে গিয়ে প্রয়োজন হয় বিদেশী কলোনী স্থাপনের। ফলে মার্কেন্টালিজম রূপ নেয় সাম্রাজ্যবাদী সংগ্রামে। এভাবেই হিটলার, মুসোলিনি, ফ্যাসিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠে।

অপরিহার্য হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। একবিংশ শতাব্দীর এ দুদশকে আধুনিকতার নিত্যনতুন রূপ দেখা গেল। বিশ্ব সন্ত্রাস দমনের নামে মুসলিম বিশ্বের অর্থনৈতিক শক্তি হাত করে নিচ্ছে পশ্চিমার। লাখ লাখ আধ পেটা শিশুর প্রাণের বিনিময়ে দেয়া হচ্ছে শান্তিতে নোবেল। কৃত্রিম খাদ্য সংকট তৈরী করে জনপদের দখল নিতে ব্যস্ত সাম্রাজ্যবাদীরা।

তৃতীয় বিশ্বের শিশুদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি থেকে দূরে সরিয়ে বাড়ানো হল ডিজিটাল ডিভাইড। রাষ্ট্রপ্রধানরা পরাশক্তির লেজুরবৃত্তি করতে ব্যতিব্যস্ত সারাক্ষণ। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ এর মত বিশ্ব সংস্থাগুলোকে যাচ্ছে তাই ভাবে ব্যবহার করা হল পুজিবাদীদের উদরপুর্তি করতে। সেকুলারিজমকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গিয়ে রাস্ট্রের বিবেক এতটুকু কাপেনা সমকামিতাকে বৈধতা দিতে, ধর্ম শিক্ষাকে নির্বাসিত করতে কিংবা নিরস্ত্র জনসাধারণকে রাসায়নিক বা জীবানু বোমা দিয়ে মারতে। ইচ্ছামাফিক ছাঁচে ঢেলে মানুষ গড়ার প্রচেষ্ঠা চালাতে গিয়ে পদে পদে হোচট খেয়ে সমাজবাদী মহলও আজ উপলব্ধি করেছেন যৌন নৈতিকতা, বিবাহ ও পারিবারিক সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা।

বিশ্ব মানবের এই 'ঠেকে শেখা' আধুনিকতম মূল্যবোধ থেকে উৎসারিত দৃষ্ঠি ভংগিই আজকের দিনের 'আধুনিকতা'। বস্তুনির্ভর জ্ঞান একান্তভাবে আপেক্ষিক হবার দরুন সত্যিকারের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় নীতির সন্ধানে মানুষকে নির্ভর করতে হবে এমন কোন সূত্রের উপর, যা আপেক্ষিকতার গলদমুক্ত, দ্বারস্থ হতে হবে এমন কোন সত্তার যা স্থান কালের অতীত বা শাশ্বত।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।