আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বার্মিংহাম- ১৪

ইচ্ছেমতো লেখার স্বাধীন খাতা....

আমি ব্রিটেনের যে এলাকায় থাকি সে এলাকার মানুষদের দেখলে বিদেশ বলে মনেই হয়না। প্রচুর বাঙ্গালির বসবাস এ এলাকায়। এলাকার মসজিদটাও মুসল্লিদের পদচারণায় বেশ সরগরম থাকে। শুক্রবারের জুম্মার সময় এতো মানুষের জায়গা করে দিতে বেশ কষ্টই হয়। এ দেশের প্রায় ২ লক্ষ ৮৩ হাজার জন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত (বাংলাদেশীদের চেয়ে পাকিস্তানি ও ইন্ডিয়ানদের সংখ্যা অবশ্য বেশি)।

ব্রিটিশদের বর্তমানে জন্মহার বেশ কম। সন্তান জন্ম দেওয়ার চেয়ে অন্যান্য কাজেই এদের আগ্রহ বেশী। এ কারণে সরকার ব্রিটিশদের কোনো সন্তান হওয়া মাত্রই ৩ হাজার পাউন্ড অনুদান দেয়। এছাড়াও ফ্রি চিকিৎসা, ফ্রি শিক্ষা ইত্যাদিতো আছেই। প্রায় পরিত্যক্ত বহু পুরনো একটা চার্চ।

এ এলাকায় এ ধরনের অনেক চার্চ আছে, যেগুলোতে বহুদিন কোনো প্রার্থনা হয়না.... এতোকিছুর পরও এদের জনসংখ্যাও দিন দিন কমছে। ফলে বুড়ো-বুড়ির সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। অন্যদিকে এখানকার এশিয়ানদের জন্মহার অনেক বেশি। ফলে শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশরা কমছে আর অন্যরা বাড়ছে। ফলে ব্রিটেন ক্রমান্বয়ে বাইরের লোকদের দখলে চলে যাচ্ছে।

এ এলাকায় হাঁটার সময় হঠাৎ সামনে দেখা যাবে বাংলাদেশের কোনো গ্রামাঞ্চলের মতোই ঘোমটা পরা মহিলা দ্রুত এক বাড়ি থেকে বের হয়ে অন্য বাড়িতে যাচ্ছে। রাস্তায় লুঙ্গি পরা মানুষ স্বাচ্ছন্দে হাটাহাটি করছে। মাঝে মাঝে দেখি লোকজন পান খেতে খেতে রাস্তায় পানের পিক ফেলছে। আপাদমস্তক রীতিমতো বোরখা পড়া মহিলাদেরও প্রচুর দেখা যায়। প্রতি নামাজের ওয়াক্তে দেখা যায়, টুপি পরা লোকজন মসজিদে নামাজের টাইম ধরার জন্য তাড়াতাড়ি পা চালাচ্ছে।

এমনকি আমার বাসা থেকে মসজিদের আজানের শব্দও শোনা যায়। তবে বাড়িঘর আর গাড়িগুলো অবশ্য বাংলাদেশের মতো না। মসজিদের চেয়ে চার্চের সংখ্যা নিঃসন্দেহে বেশি এ এলাকায়। কিন্তু সেগুলোতে প্রার্থনার জন্য কোনো মানুষই পাওয়া যায়না। আমি যে গলিতে থাকি সেখানে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল আমার বাসার ঠিক পাশের বাসা।

অন্য সব বাসায় বাংলাদেশি বা এশিয়ান লোকজন বাস করলেও পাশের বাসাতে এক সাদা চামড়ার ব্রিটিশ বুড়ো দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে বাস করতো। তার সঙ্গী ছিল দুইটা কুকুর। এছাড়া দীর্ঘদিন তার কাছে কোনো মানুষজন আসতে দেখা যায়নি। বুড়োর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল ছয় সাত মাস আগে। আমার বন্ধুর স্ত্রী চাকরি পাওয়ায় প্রতিবেশি হিসেবে তার বাসাতে মিষ্টি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

এরপর তার সাথে মাঝে মাঝে দেখা হতো সকালে ক্লাসে যাওয়ার সময়। খুব সকালে ফিটফাট হয়ে রাস্তায় হাঁটাহাটি করতো সে। আমাকে দেখলে গুড মর্নিং জানাতো। মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করতো, হাউ ইউ ডুইং। উত্তর দিতে একটু দেরি হলে সে নিজেই অবশ্য বলে ফেলতো, .... ফাইন।

একেবারে পাশের বাসা হওয়ায় আমার বন্ধু তার উপর বেশ নজর রাখতো। কিছুদিন আগে তার বাসা থেকে দুই দিন যাবৎ কোনো সারাশব্দ পাওয়া যাচ্ছিলো না। এসময় আমার বন্ধু খবর নিতে গেছিলো। কিন্তু দরজা নক করে কাউকে পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় সঙ্গত কারণেই এদের সবচেয়ে বড় বন্ধু পুলিশকেই খবর দেওয়া হয়েছিল।

এখানে পুলিশের নাম্বার হচ্ছে ৯৯৯। ফোন করে ব্যাপারটা জানানোর কয়েক মিনিটের মধ্যেই অ্যাম্বুলেন্স আর পুলিশের গাড়ির শব্দে এলাকাবাসীর শঙ্কিত হয়ে উঠলো। হলিউড সিনেমার মতো কালো পোশাক, কালো গ্লাভস আর সানগ্লাস পড়া কয়েক পুলিশ এসে দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করছিল। এসময় সামনের দরজাটা বেশ শক্ত হওয়ায় পুলিশ পিছনের দরজাটা ভেঙ্গে বাসায় ঢুকলো। আর ঠিক সে সময়ই পুলিশ অ্যাম্বুলেন্স আর এলাকাবাসিকে হতাশ করে গলির ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে সে বুড়ো উপস্থিত।

তার বাড়িতে এতো পুলিশ আর অ্যাম্বুলেন্স দেখে সে অবাক। সব শুনে সে বলে, আরে আমি ৪০ বছর ধরে এ বাড়িতে আছি, আরো ৪০ বছর থাকবো। জানা গেল, সে তার মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেছিলো। গত কয়দিন যাবৎ শুনতে পাচ্ছিলাম বুড়োর শরীর ভালো না। এখানকার বুড়োদের প্রতি সরকার বেশ সতর্ক।

সরকার থেকে তাকে দেখাশোনার জন্য নিয়মিত লোকজন আসে। মাসখানেক আগে দেখলাম অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। অবশ্য কিছুদিন পর আবার তাকে বাসায় দিয়ে গেল। সরকারি লোকজন এবং কেয়ারাররা প্রতি বেলায় এসে তার দেখাশোনা করে। কয়দিন আগে বাসা থেকে বের হতেই কালো পোশাক আর চকচকে কালো হ্যাট পরিহিত কয়েক হাসিখুশি শেতাঙ্গ তরুণীকে দেখে চমকে উঠলাম।

ঠিক যেন মুভির কোনো দৃশ্য। তার পাশে দেখি কালো পোশাকে সুসজ্জিত আরো কিছু শেতাঙ্গ নারী-পুরুষ। আগে এ রাস্তায় এদের কখনো দেখিনি। ভাবছি‍লাম ক্যামেরা বের করে ছবি তুলে রাখবো। কিন্তু তাড়াহুড়ায় আর সম্ভব হলোনা।

যা ভেবেছিলাম তাই। দেখলাম রোলস রয়েস গাড়িতে অসংখ্য ফুলের মাঝে সাজিয়ে রাখা কফিন বক্স। মনটা খারাপ হয়ে গেল, এ পাড়ার শেষ ব্রিটিশ.... সেই প্রতিবেশি বুড়ো মারা গেছেন। এতোদিন তাঁর যেসব আত্মীয় স্বজনের কোনো খবর ছিলনা তারাই এখন আনুষ্ঠানিকতা করার জন্য চকচকে কালো পোশাক পড়ে শোভাযাত্রায় করছে। মনে মনে বলছিলাম, কয়দিন আগে আসলে কি হতো।

ব্রিটিশদের আচার ব্যবহার এখনো আমার কাছে দুর্বোদ্ধ রয়ে গেল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.