প্রথম পর্ব এখানে
Click This Link
দ্বিতীয় পর্ব এখানে
Click This Link
বাবা রহমত জায়নামাজ থেকে নেমে এলেন। আহাদের কাছে এসে বললেন- ‘বাবা আজ তুমার জন্যি ভালো একটা খবর আছে। ’
বাবার কথায় চমকে ওঠে আহাদ। কি এমন চমকে দেবার আছে এই পোড়া সংসার! আহাদ তার বাবার কথা শুনে উত্তর দেয়- ‘কি খুশির খবর বাবা? মতি, সোহান আর সোনালীর জন্যি খুব ভালো দেহে মিষ্টি আলু আনছো? নাকি কয়েক সের চাল আনছো?’
আহাদের কথা শুনে আঁতকে ওঠেন রহমত। ছেলে তার একি কথা বলে! এখন তাকে তিনি কি উত্তর দেবেন? কতক্ষণ আমতা আমতা করেন রহমত।
তারপর বলেন- ‘বাজানরে, না আমি কিছুই নিয়ে আসপার পারি নাই। আমারে কেউ কামে নিল না। আমি যে রোগা! আমার যে বয়স ভাটির টানে গেছে! তয় আমি তুমাগার জন্যে একটা খাঁটি মন নিয়ে আইছি বাজান। আমার তো আর কিছু করবার ছিল না! ক’ তো বাজান আমারে কেউ কামে, না নিলি সে দোষ কি আমার? আমি তুগার জন্যি খাবার-চাল-ডাল আনব কি দিয়ে?’
বলতে বলতে তার চোখের কোণে পানি জমে ওঠে। আহাদ সে পানি আবিষ্কার করে ফেলে।
বাবার কান্না দেখে সে আর কথা বাড়ায় না। সে জানে বাজান আহাদের ভাইবোনদের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসেন। তার শুধু অর্থ নেই- এই জন্যেই তিনি সন্তানদের ভালোবাসা দেখাতে পারেন না, যেমনটি দেখায় আর দশজন বাবা। কোন অনুষ্ঠান এলেই ওইসব বাবার মতো রহমতেরও ইচ্ছে করে সন্তানদের অন্তত একটা নতুন জামা কিনে দিতে। কিন্তু অভাব তার সে ইচ্ছে পূরণ হতে দেয়নি।
আহাদ এসবই জানে। বুঝতে পারে। সে জন্যে সে আর কথা বানায় না। বাবাকে বলে- ‘তা খুশির খবরডা কি বাবা?’
‘তুমাকে আজ আমি স্কুলে ভর্তি করে দেব। তুমি পড়ালেখা শিখে অনেক বড় হবা।
আমার মত ব্যর্থ বাবা তুমি হও তা আমি চাইনে। ’
‘কিন্তু বাবা আমি স্কুলে গেলে সংসার চালাবি কে? আমরা সবাই তো এক সময় না খায়ে মরে যাব। ’
‘নারে বাবা আল্লাহ বাঁচালি মরব না। তুমি স্কুলে চল। ’
আহাদ বাবার কাছে হেরে যায়।
গোসল সেরে ছেড়াফাড়া যা কাপড়-চোপড় ছিল তাই পড়ে নিল আহাদ। মনের মধ্যে অনেক কষ্ট থাকলেও এই মুহূর্তে তার কাছে ভীষণ খুশির জোয়ার। তার সামনে খোলা পৃথিবী- যেখানে খুশি সে ছুটে যেতে পারবে। দুর্নিবার বাসনা থাকলে সে হতে পারে বিখ্যাত কেউ। চকচকে দুনিয়াটা তার কাছে আরো আলোকিত মনে হতে থাকে।
বাবার হাত ধরে ঘর থেকে বের হয় আহাদ। যাবার আগে মাকে দু’পা ছুঁয়ে সালাম করে। মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে- ‘বাবা তুমি অনেক বড় হও। আমার যে এর চেয়ে বড় কিছু চাওয়ার নাই!’
আহাদের চোখ ছলছল করে ওঠে- ‘মা আমারে দোয়া করো। দেখো আমি তোমার ইচ্ছা পূরণ করব।
’
আবেদা খাতুন ছেলের মাথা-বুক চাপড়ে দেয়। দোয়া পড়ে ফুঁ দেয় ছেলের বুকে-পিঠে।
আহাদ বাবার হাত ধরে রওয়ানা হয় স্কুলের পথে।
ছেলেকে নিয়ে স্কুলে পৌঁছে গেলেন রহমত। তাকে দেখে প্রধান শিক্ষক অবাক।
বললেন- ‘কি ব্যাপার রহমত, ছেলেকে নিয়ে স্কুলে যে?’
রহমত মাথা নুইয়ে জবাব দেন- ‘স্যার ওরে আপনার হাতে তুলে দিলাম। আজ থেইক্যা ওর মা-বাবা আমি না, আপনি। ওরে শিক্ষিত করে তুলেন। ’
স্যার আরও অবাক হন। রহমতের চেয়ে ভালো সংসারের অবস্থা এমন পরিবারের অনেকে তো তার ছেলেমেয়েকে স্কুলে ভর্তি করে না।
তারা চিন্তা করে ছেলে একটু বড় হলে তাকে দিয়ে উপার্জন করানো যাবে। সংসারে স্বচ্ছলতা আসবে। আর রহমত ছেলেকে ভর্তি করাতে এসেছে! অনেকক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন স্যার।
রহমত বলেন- ‘জে স্যার, এর চেয়ে ভালো কোন পথ খুঁজে পাইলাম না। আমি চাই না আমার ছাওয়াল আমার মত চাষা হোক।
’
স্যার বললেন- ‘তুমি কি চিন্তা-ভাবনা করে কথা বলছো?’
‘হ স্যার, কাল রাইতে ওর মার সাথে এ নিয়ে অনেক কথা হইছে। ’
‘তুমি একটা ভাল কাজ করছো রহমত। তোমার মতো বোধোদয় এদেশে সবার হলেই দেশের উন্নতি হবে। দেশ পাবে একটা শিক্ষিত জাতি। জেনে রেখো যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত! তোমার মত করে এদেশে সবাই সন্তানের কথা ভাবলে দেশে আর গরিব মানুষ থাকতো না।
’
‘আর লজ্জা দিয়েন না স্যার!’
‘লজ্জা না, রহমত সত্যি কথা! তোমার মত করে অন্যেরা ভাবলে আমাদের সমাজ আরও অনেক আগে ভালো হয়ে যেত। আমরা বিশ্বের কাছে আরও আগে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারতাম। ’
‘আমি অল্প শিক্ষিত মানুষ! এত কিছু বুঝি না!’
‘সেজন্যই তুমি মহাৎ একটা কাজ করে ফেলেছ!’
আহাদকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে ঠান্ডা মাথায় বাড়ির পানে পা বাড়ালোন রহমত। পথে হাঁটেন আর চিন্তা করেন কি করে ছেলের পড়ালেখা সম্ভব। এত গরিব সংসারে পড়ালেখাতো বাসনামাত্র।
ওহ-হো, তার আহাদতো সকালে নাস্তা করে আসে নাই। আসলে নাস্তা করার মতো কিছু ছিল না তার ঘরে। আহা ছেলেটা তার সারাদিন খালি পেটে স্কুল করবে! ক্ষিধেয় নিজের পেটও তার জ্বলছে। কি করবেন তিনি, কি করার আছে তার! উপরের দিকে তাকিয়ে লম্বা করে একটা দম টানেন। পরক্ষণেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন- যেন এই দীর্ঘশ্বাসের সাথে তার বুকের জমাট বাঁধা কষ্টের অনেকটাই বেরিয়ে যায়।
বুকটা একটু পাতলা মনে হয়।
ওদিকে হেড স্যার আহাদের ছোটখাটো একটা পরীক্ষা নিয়ে নিলেন। স্যার বললেন- ‘তোমরাতো অনেক গরিব। তুমি পড়ালেখা করবা কিভাবে? তোমার বাবাতো তোমার পড়ালেখার খরচ যোগাতে পারবে না। দু’এক ক্লাস পড়েই কেটে পড়বা নাকি?’
আহাদ মাথা নিচু করে স্যারের দিকে এগিয়ে যায়।
স্যারের পা ছুঁয়ে ছালাম করে। তারপর বলে- ‘স্যার পৃথিবীতে মানুষের অসাধ্য বলতে কি আছে! একজন মানুষের ইচ্ছে থাকলে পড়ালেখা করা খুবই সম্ভব। আমার বাবা পড়ালেখার খরচ দিতে না পারলে আমি টিউশনি করে আমার খরচ যোগাবো স্যার! আপনি আমার গুরুজন। আপনার দোয়া থাকলে আমার জন্যে এ কাজ কঠিন হলেও সম্ভব। আমাকে পারতেই হবে, স্যার!’
হেড স্যার ওর কথা শুনে খুশি হলেন।
এতটুকু ছেলে এত সুন্দর করে কথা গুছিয়ে বলতে পারে! ও সত্যি একদিন নিশ্চয় বড় বিদ্যান হবে। ওর মাঝে তিনি এ সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছেন। তাছাড়া এত ছোট একটা ছেলে কত আত্মপ্রত্যয়ী! কত বড় পরিকল্পনা তার! এমন একটা ছাত্র পেয়ে স্যারের মন খুশিতে ভরে উঠল। তিনি বললেন-‘আমি দোয়া করি আহাদ তুমি পড়ালেখা শিখে অনেক বড় হবে। আমি এর আগে এমন দোয়া, প্রাণখোলা দোয়া কারো জন্যে করতে পারি নি।
পারি নি এ জন্যে যে আমি আমার মনের মতো একটা ছাত্র আজ পর্যন্ত পাই নি। আজ সে স্থান তুমি দখল করে নিলে। আমি চাই তুমি আমার, স্কুলের মান-সম্মান আরো উজ্জ্বল করবে। ’
‘আপনার দোয়া নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। এ যাত্রায় আমার জিতাই লাগবি।
’
এরপর থেকে আহাদ নিয়মিত স্কুলে যেতে থাকে। বছর ঘুরে ডিসেম্বর মাস এল। সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। আহাদের পড়ালেখার চাপ অনেক। রাত-দিনে যতটুকু সময় পায় সে সময়টুকুতে সে বই নিয়ে পড়ে থাকে।
ওর মা অবাক হয় ছেলের একাগ্রতা দেখে। আহা! ছেলেটা এভাবে রাতদিন বই নিয়ে পড়ে থাকলে এতটুকু ছেলের মাথা ঠিক থাকবে তো। আবেদা খাতুন অনেক কষ্টে একটা মুরগি কিনেছেন। সে মুরগিতে কয়েকদিন হল ডিম দিচ্ছে। প্রথম প্রথম সে ডিম বিক্রি করে চাল-ডাল কিনাতেন আবেদা।
কিন্তু ছেলের এ অবস্থা দেখে ডিম আর বিক্রি করতে দিলেন না। সকালে একটা করে ডিম সিদ্ধ দিয়ে তা আহাদকে দিয়ে খাওয়ায়। আহাদের তাতে অনেক আপত্তি। একদিন সকালে বাড়ির সবাই উপোস। মা একটা ডিম সিদ্ধ করে নিয়ে এলেন।
আহাদ একবার মার মুখের দিকে তাকায়, একবার ছোট ভাইবোনের দিকে তাকায়। তার চোখ ছলছল করে ওঠে। মাকে বলে- ‘মা এ ডিম আমি খাব না। এটা নিয়ে তুমি মতি, সোহান আর সোনালিকে ভাগ করে দেও। ’
মা বলেন- ‘সেকি বাবা! ওরা তো স্কুলে যায় না।
উগার ডিম খাওয়া লাগবেন না। ’
‘তাকি করে অয় মা! ওরাতো আমার ছোট ভাইবোন! ওরা খালিই আমার খাওয়া অয়। ’
‘নারে বাবা, তোর কত্তো পড়ালেহা! তোর কত মাতা খাটানে লাগে! ডিমডা তুই খা!’
‘মা তুমি আমারে তো এই শিক্ষা দেও নাই! আমি আমার ভাইবোন রাখে নিজি খাবো কি করে!’
‘তুই খা বাবা’ -বলেই আহাদের মাথায়-বুকে আবেদা খাতুন হাত বুলিয়ে দেন।
আহাদ জানে মার কথা অমান্য করা অন্যায়। যে সন্তান মা-বাবার কথা শোনে না সে কোনদিন উন্নতি করতে পারে না।
তাই মার হাত থেকে ডিমটা নিয়ে নিপুণ হাতে খোসা ছাড়ায়। পুরোটা খোসা ছাড়ানো হয়ে গেলে আহাদ মতি, সোহান আর সোনালিকে ডাকে। বড় ভাইয়ের ডাক পেয়ে ওরা ছুটে আসে। ভাইয়ের পাশ ঘিরে বসে।
আহাদ একটা চাকু নেয়।
একটা প্লেটের উপর ডিমটি রেখে ঠিক চার ভাগ করে। তারপর এক এক ভাগ এক এক জনের হাতে তুলে দেয়। বলে- ‘খা! ডিম খুব মজা!’
ওরা গরম ডিম পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। একবারেই সেই ডিম মুখে পুরে দিয়ে খেতে থাকে। আহাদ, আর মা সে দৃশ্য দেখে পুলকিত হয়।
আহাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা সুখের স্বপ্ন। সে কল্পনা করে একদিন সে পড়ালেখা শিখে অনেক বড় হবে। এই অভুক্ত ভাইবোনের মুখে খাবার তুলে দেবে। পরণে উঠবে নতুন নতুন কাপড়। সেদিন ওদের আনন্দ কেমন হবে-এ কল্পনা করে শিউরে ওঠে আহাদ, সে সফল হতে পারবে তো! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।