২০৭৫ সাল। উন্নয়নের জোয়াড়ে দেশ থৈ থৈ করছে। না খেতে পেয়ে দেশের মানুষের শরীর কঙ্কাল হয়ে গেছে। আবুলের শরীরে তো তাকানোর জো নেই। বুকের হাড়গুলো হারমোনিয়ামের রিডের মতো হয়ে গেছে।
তবু আবুল তার হাড্ডিসার শরীর নিয়ে বেজায় খুশি। চলতে ফিরতে খুব সুবিধা হয় তার। হাড়ের সাথে হাড়ের যখন টোকা লাগে তখন অদ্ভুত সুন্দর এক ধরনের বাজনা বেজে ওঠে। সে বাজনার ব্যঞ্জণা যে কতোটা শ্রুতিমধুর তা না শুনলে বোঝার উপায় নেই। রাজপথে সরকারের সমর্থনে শান্তি মিছিল বের হয় তখন তো সুরের মুর্ছণা ঝরে পড়ে আকাশে-বাতাসে।
বিদেশী পর্যটকরা আসে মানুষের কঙ্কাল শরীর দেখার জন্য। বিগত কয়েক বছরে পর্যটন খাতেও ব্যাপক আয় হয়েছে।
সরকারী-বেসরকারী লোকজন মাঝে মাঝেই অনুবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে এ বাসা ওবাসায় ঘোরাঘুরি করে। তাদের সাথে সাদা চামরার লোকজনও আসে। অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে মাসের পর মাস খুঁজেও 'দারিদ্র' নামের কোনো বস্তু পাওয়া যাচ্ছে না।
সেদিন রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন রাষ্ট্রপ্রধান। তিন ঘন্টার ভাষণে তিনি কঙ্কাল শরীরের সুবিধার কথা তুলে ধরলেন। ভাত খেয়ে অযথা শরীর মোটা করে ঝামেলা বাড়ানোর দরকার নেই বলে তিনি মন্তব্য করলেন। খৈল ভূষির সকালেও রাতে এক চামচ করে খাওয়ার পরামর্শ দিলেন। দেশে দারিদ্র আর কোনো দিনও ভিঁড়তে পারবে না বলে তিনি মন্তব্য করলেন।
এর কারণ হিসেবে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরলেন চমকপ্রদ তথ্য দিলেন। বিদেশী ধনী কয়েকটি রাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার কঙ্কালসার মানুষ কিনবে। তাও আবার অত্যন্ত উঁচু দরে। ওদের চিড়িয়াখানা আর জাদুঘরে প্রদর্শনীর জন্য রাখবেন।
আবুল ও তার বাবা বাসায় বসে টিভিতে ওই ভাষণ শুনছিলো।
রাষ্ট্র প্রধানের নাদুস-নুদুস শরীর টেলিভিশনের পদায় যেনো আঁটছিলো না।
আবুল তার বাবাকে বললো, আচ্চা বাবা, উনার শরীরে এতো মাংস কেনো?
পাশের ঘর থেকে আবুলের মা এসে বললেন, শরীরে মাংস থাকার যে কতোটা যন্ত্রণা তা জানার জন্যই বিদেশী খাবার খেয়ে পরীক্ষা করছেন তিনি।
আবুলের বাবা বললেন, শুনেছো আবুলের মা বিদেশীরা চিড়িয়াখানায় রাখার জন্য নাকি এদেশ থেকে মানুষ কিনে নিয়ে যাচ্ছে।
আবুলের মা আত্মবিশ্বাসের সুরে বললেন, যাবেই তো এতো সুন্দর স্লিম মানুষ দুনিয়ার কোথাও আছে নাকি? বিভিন্ন দেশে দারিদ্র নিয়ে কথা হচ্ছে। আমি বুড়ি হতে চললাম আজ পর্যন্ত দারিদ্রের "দ"ও দেখতে পেলাম না।
খাই না খাই খুব সুখে আছি গো।
আবুলের বাবা আক্ষেপ করে বললেন, হ ঠিকই কইছো। সুখে সুখে শরীর শুকিয়ে খুব মজা পাচ্ছি।
আবুলের মা এত্তোসব শক্ত কথা বোঝেন না। তিনি খুব শান্তিতে আছেন- এটাই তার তৃপ্তি।
একদিন সকালে আবুল তার বাবার সাথে ব্যালকনিতে বসে আলুর খোসার স্যুপ খাচ্ছিলো। মাথায় ক্যাপ পড়ে ইয়াবড় অনুবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে তাদের বাসার সামনে দিয়ে কয়েকজন লোক হেঁটে যাচ্চিলো।
আবুল তার বাবাকে বললো, আব্বা, ওইসব যন্ত্রপাতি দিয়া কি হইবো?
আবুলের বাবা ভুষির আচার মুখে পুড়ে দিয়ে বললেন, কিচ্ছু না, বাজান। হেরা যন্ত্র দিয়া 'দারিদ্র' খুঁজতাছে।
আবুল বিষ্ময়ে বললো, কি কও বাজান দারিদ্র পাইতাছে না?
আবুলের বাবা উত্তর দিলেন, না, তুই কি কোথাও দেখেছিস নাকি।
দেখতে পাইলে আমারে খবর দিস। কেউ ' একজন দরিদ্র ব্যক্তিকে' দেখাইতে পারলে মিলিয়ন ডলার পুরস্কার পাওয়া যাইবো।
আবুল বললো, এইডা সহজ কাম। আমরাই তো দরিদ্র।
আবুলের বাবা মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন, নারে বাজান, সরকার আমগো দ্যাশের মানুষদের সুখী সমৃদ্ধ বলে ঘোষণা দিছে কয়েক বছর আগে।
ঘোষণার আগে দরিদ্রই ছিলাম।
আবুল আগ্রহভরে বললো, বাজান, দারিদ্র জিনিসটা দেখতে কেমন? সাদা নাকি কালো?
আবুলের বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, হুনছিলাম ২০৩০ সালের পর নাকি দারিদ্র দেখতে জাদুঘরে যাওন লাগবো। তোর মা একবার যাইতে চাইছিলো, মাগার সময় করতে পারিনি।
আবুল জো ধরে বললো, চলো না বাজান, জাদুঘরে যাবো। দারিদ্র দেখবো।
আবুলের বাবা হেসে বললেন, সমস্ত দেশটাই তো একটা আস্ত জাদুঘর দেখতাছস না।
আবুল বললো, হ বাজান মানুষজনগো দ্যাখতে হেব্বি লাগে। মনে হয় সব কবর থেইকা উইঠা আসছে। যাইকগা, আমি কইলাম কাল সকালে জাদুঘরে যামুই।
সকালে উঠে আবুল তার বাবার সাথে চলে যায় জাতীয় জাদুঘরে।
দুজনে মিলে অনেক খোঁজাখুজি করেও দারিদ্র নামের বস্তুটি দেখতে পেলো না। বের হয়ে আসার মুহূর্তে আবুল চিৎকার করে তারা বাবাকে ডাক দিয়ে বললো, বাজান পাইছি।
আবুলের বাবা কাছে এসে বললো, কোথায় পাইলি? আমারে একটু দেখানা বাজান।
আবুল আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে বললো, ওই যে দ্যাখো দেয়ালে ঝুলানো একটা ফ্রেমের নিচে লেখা আছে ' দারিদ্র'।
ফ্রেমে কি যেনো একটা ছবি সাঁটানো আছে।
দূর থেকে ভালো বোঝা যাচ্ছে না। ধীর পায়ে আবুল ও তার বাবা ফ্রেমটির কাছে এগিয়ে গেলো। গভীর আগ্রহভরে তাকালো ফ্রেমটিতে।
আবুল একটু বিরক্তির কণ্ঠে বললো, বাজান, এইডা তো আস্ত মানুষের ছবি। এই ব্যাটা তো খালি ভক ভকর করে।
নামটা যেনো কি?
আবুলের বাবা কোনো কথা না বলে আবুলকে নিয়ে জাদুঘরে কর্তব্যরত এক কর্মকর্তার কাছে গিয়ে বললেন, দেখতে আসলাম দারিদ্র'র ছবি। আপনারা এইডা কি ঝুলিয়ে রাখছেন?
কর্মকর্তা ইতস্তত করে বললেন, আসলে কয়েক বছর ধরে খোঁজাখুঁজি করেও 'দারিদ্র' পাওয়া যাচ্ছে না। দর্শনার্থীদের শান্ত করতে 'দারিদ্র"র জায়গায় নোবেল জয়ী ইউনুস মিয়ার ছবি সাঁটানো হয়েছে।
আবুল 'দারিদ্র' দেখতে না পেয়ে ব্যর্থ মনোরথে বাসায় ফিরে আসে। আবুলের বাবা পকেটের শেষ পয়সাটুকু নিয়ে মার্কেটে যান অনুবিক্ষণ যন্ত্র কিনতে।
কাল সকাল থেকে তিনিও নামবেন দারিদ্র খুঁজতে। কম তো নয় 'মিলিয়ন ডলার' পুরস্কার!।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।