মানুষ আমি খুঁজছি মানুষ আরো মানুষ হতে
সম্ভবত ১৯৮৭ সালের ঘটনা। আমি তখন স্কুলে পড়ি। পঁচিশে বৈশাখে রাষ্ট্রপতি লেজেহুমু এরশাদ আসিবেন শিলাইদহ কুঠিবাড়ীতে। উপলক্ষ জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জয়ন্তী অনুষ্ঠানের উদ্বোধন। উন্মাদনায় মজিয়া আছি আমরা।
এই উন্মাদনার কারণ তখনও জানিতাম না। এখনও জানিতে পারি নাই। বাড়ি থেকে সব মিলিয়া বারো মাইলের মতো দূরত্ব হইবে শিলাইদহ কুঠিবাড়ির। আমি আর আমার ঘনিষ্ঠ স্কুলবন্ধু সাইফুল প্ল্যান করিলাম গড়াই নদীর ঘাট পর্যন্ত দু’টাকায় রিক্সা ভ্যান, তারপর নদী পার হয়ে দুই দুই চারটাকায় আবার ভ্যানে সুড়–ৎ করিয়া পৌছাইবো কুঠিবাড়িতে। পরিকল্পনাটি ছিল যাপরনাই সরল।
আমাদের দু’জনের পকেট কুড়াইয়া প্রায় বারো টাকার মতো। নদী পারাপারে কিছুই লাগিল না। কারণ রাষ্ট্রপতির আগমন উপলক্ষে নদীর চিকন প্রবাহিত ধারার ওপর বেইলি ব্রীজ বানানো হইয়াছে। বৈশাখের প্রখর তাপদাহে গড়াইয়ের বালুকা পার হইয়া ঘোড়াই ঘাটে পৌছনো গেল। তৃষ্ণায় প্রাণ যায় যায়।
তখন কেবল উঠিয়াছে চিকন পাইপের আইসক্রিম। দুই টাকায় দুইটি কিনিয়া মুখে পুরিলাম। উঠিব রিক্সা ভ্যানে। কিন্তু সেদিন জনপ্রতি ভাড়া হাকিতেছে জনপ্রতি ১০ টাকা। চুন হইয়া গেল দুইজনের মুখ।
অগত্যা পদযাত্রায় ব্রতী হইলাম রাষ্ট্রপতিকে এক নজর দেখিতে কিংবা রবীন্দ্র স্মৃতির পরশ পাইতে। যানবাহন আর মানুষের চাপে প্রায় চ্যাপ্টা হইবার উপক্রম। তৃষ্ণায়, গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত হইবার যোগাড় হইলে একজন বলিল, আর মাইল খানেক.....। হাঁটিতেছি আর হাঁটিতেছি। দুই বন্ধুর চারটি পা গাছ হইয়া গিয়াছে।
ভাবিতেছি জুতা খুলিয়া হাতে তুলিবার মতো পা দুইটি খুলিয়া স্কন্ধে লইতে পারিলে বাঁচিয়া যাইতাম। একটি জায়গায় আসিয়া আর হাঁটিতে হইতেছে না। ভীড়ের চাপে এমনিতেই সামনে চলিয়া যাইতেছি। চারদিকের কঠিন চাপে দুয়েকজন উচ্চারণ করিতেছে এই বাচ্চা দুইটিকে একটু যাইবার সুযোগ দিন। আমাদিগকে বাচ্চা বলা হইতেছে শুনিয়া গোষ্মা হইলো।
কণ্ঠ উঁচাইয়া হেইয়ো হেইয়ো ধ্বনিতে সামনের মানুষজন ধাক্কাইতে লাগিলাম। জগদ্দল ভারী মানুষের চাপ ঠেলিয়া সামনে দিবার শ্ক্তি পাইলাম না। জনস্রোতে আধাকিলোমিটার আগাইলাম। ভাবিলাম একেবারে কুঠিবাড়ির কিনারে আসিয়া পড়িয়াছি। একজন বামে দেখাইয়া আরেকজনকে বলিতেছেন, এইখানে প্রেসিডেন্টের হেলিকপ্টার নামিয়াছিল।
দেখিলাম বিস্তীর্ণ এলাকার ধান মাটিতে শুইয়া পড়িয়াছে। মহামাণ্য রাষ্ট্রপতি আর তাহার নিকটস্থ অতি সম্মানীয়দের জুতোপিষ্ট হইয়াছে প্রায় ৩ হেক্টর জমির ধান। রীতিমত সেখানে মানুষ চলাচল ও কোলাহল করিতেছে। কিছু সরকারি কর্মকর্তার গাড়ীও থামিয়া রহিয়াছে সেইখানে। কিছু দোকানীও বসিয়া গেছে।
জিলাপী ভাজা চলিতেছে উজাড় ধানক্ষেতের জমিনে। সেইখানটাতে তখন জমিন সুঠাম হইয়া উঠিয়াছে। ধানের অস্তিত্ব নাই বেশিরভাগ জায়গায়। রাস্তা আর ক্ষেত একাকার। আমরা রাস্তা হইতে সেইদিকে নামিয়া পড়িলাম।
জানিলাম, কিছুক্ষণ আগে প্রেসিডেন্টের হেলিকপ্টার উড়াল দিয়াছে। রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানাদির উদ্বোধনপর্ব সম্পন্ন হইয়াছে। সামনের দিকে আর একতিল অগ্রসর হওয়া অগত্যা হইবে ভাবিয়া ফিরিবার মনস্থির করিলাম। হঠাৎ ভাগ্য প্রসন্ন হইলো, একটি বাসের ছাতে উঠিবার সুযোগ পাইলাম। ফিরিতে আর বেগ পাইলাম না।
তবে মনে মনে দুই বন্ধু পরিকল্পনা আঁটিলাম, স্কুলে যাইয়া অন্যান্য বন্ধুদেরকে বলিব, এরশাদকে একেবারে সম্মুখ হইতে দেখিয়াছি। তাহার সঙ্গে করমর্দন পর্যন্ত করিয়াছি।
পুরাতন এই স্মৃতি জাগিয়া উঠিয়াছে আজ সকালে। টেলিভিশনে দেখিতেছিলাম, প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ দিনাজপুরে গিয়াছেন বোরো ধান কাটিতে। কাটিয়াছেন।
ধানক্ষেতের আইল ধরিয়া হাঁটিতেছেন। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলিতেছেন। বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান জনপদের রাষ্ট্রপিতার পক্ষে এই কাজটি সত্যিই একখানি উদাহরণ বটে। কারণ, অতিতে সকলেই কৃষি নিয়া বড় বড় কথা বলিয়া এরশাদের মতো জুতোপিষ্ট করিয়াছেন জনগণের অন্ন। কৃষি আর কৃষককে এইভাবে ধুলায় মেশাইয়াছেন।
কিন্তু এইবার ফখরুদ্দীন যাহা দেখাইলেন, তাহা সকল রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য অনুকরণীয় হইবে বলিয়া বিশ্বাস করিতেছি। কারণ, কৃষি ছাড়া আর বাঁচিবার জো নাই। খাদ্য খাদ্য করিয়া ভেবলুর মতো ভ্যা ভ্যা করিয়া কাঁদিয়াও কাজ হইবে না, যদি কৃষির প্রতি দৃষ্টিপাত করিবার আন্তরিকতা না থাকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।