আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিভৃত সৈনিক -৩



৭ই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ কিভাবে প্রচারিত হল, তার পেছনেও ছিল কিছু সংগ্রামী মানুষের অসাধারণ বীরত্ব। সেই অজানা ঘটনা প্রথমবারের মত অনলাইনে। আজ শেষ পর্ব । আগে না পড়ে থাকলে প্রথম পর্ব পড়ে নেয়ায়র আমন্ত্রণ রইল। ছবিঃ একাত্তরের সেই সাহসী সৈনিক নাসের আহমেদ চৌধুরী নিভৃত সৈনিক -১ Click This Link নিভৃত সৈনিক -২ Click This Link ========== ঢাকা রেডিও থেকে তাহের সুলতান, আশফাকুর রহমান, আশরাফুল আলম, আরও অনেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেয়ার জন্য সীমান্তের ওপারে চলে গেল।

আমরা রেডিওতে থেকে সহযোগীতা দেয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। আমার সহকর্মী জালালউদ্দিন রুমি মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের জন্য রেডিও ছেড়ে দিল। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে পাঠানোর জন্য আমি এবং ফয়েজ চৌধুরী গণসঙ্গীত এবং দেশাত্ববোধক গানের টেপ নিয়ে বাসে করে আর্মির চোখকে ফাঁকি দিয়ে নারায়নগঞ্জে জালালউদ্দিনের কাছে দিয়ে আসতাম। রাস্তায় কতবার আর্মি আমাদের সার্চ করতো তার হিসাব ছিল না। যেহেতু আমি বহির্প্রচার বিভাগে কর্মরত ছিলাম, তাদেরকে বলতাম "নারায়নগঞ্জ আদমজী জুট মিলে কাজটাজ ঠিকমতো চলছে, দেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে এগুলো রেকর্ড করতে যাচ্ছি।

" তারা বুঝতে পারতো না। ছেড়ে দিত। রেডিওর পরিচালক আশরাফুজ্জামানকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গায় সৈয়দ জিল্লুর রহমান সাহেবকে আনা হলো। জিল্লুর রহমান সাহেব আমাকে খুব স্নেহ করতেন। একদিন তার কক্ষে আমার ডাক পড়লো।

সেখানে গিয়ে দেখি একজন আর্মি অফিসার বসে আছেন। জিল্লুর রহমান সাহেব পরিচয় করিয়ে দিলেন, "ইনি কর্ণেল কাশেম, তোমার বিরুদ্ধে ইনার কিছু অভিযোগ আছে। তুমি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিশে দেশ দ্রোহীতার কাজ করছো। আমি সুবোধ বালকের মতো অস্বীকার করলাম। কর্ণেল কাশেম তখন সরাসরি আমাকে প্রশ্ন শুরু করলেন।

"তুমি আওয়ামী লিগ কর। ৭ই মার্চের ভাষন তুমি রেকর্ড করেছিলে, এবং তুমি মঞ্চে শেখ মুজিবকে তার ভাষন প্রচার করতে দিচ্ছে না লিখে জানিয়েছিলে। " আমি বললাম, "না, আমি লিখিওনি কাউকে জানাইও নি। " তখন জিল্লুর রহমান আমাকে বাঁচানোর জন্যে বললেন, "He is a pity officer, whatever he does he does with the permission of his director." তখন কর্ণেল কাশেম তার ব্রিফকেস খোলার ভান করে আমাকে বললেন, "আমার কাছে তোমার ছবি আছে, মঞ্চে তুমি শেখ মুজিবকে চিরকুট দিচ্ছো। " যেহেতু আমি দেই নাই, তাই সাহসের সঙ্গে বললাম, "না আমি দেই নাই।

" তখন কর্ণেল আর ব্রিফকেস খুললেন না। জিল্লুর রহমান সাহেব বললেন, "সে Govt অফিসার, সে কোন পার্টি করে না, আমি তাকে খুব ভালভাবে জানি। " জিল্লুর রহমান সাহেবের কথায় কর্ণেল কিছুটা আস্বস্ত হলো। বললো "ঠিক আছে, তুমি যা যা করেছো এবং যা যা জানো, একটা কাগজে লিখে আমার কাছে নিয়ে এসো। " আমি আসল কথা গোপন করে মিথ্যে যা যা পারলাম লিখে দিলাম।

কর্ণেল চলে গেলেন। জিল্লুর রহমান সাহেব আমার মামার বিশেষ বন্ধু ছিলেন। মামা জনাব আলি হাসান সিএসপি, তখন পাকিস্তানের communication secretary ছিলেন। দু'জনে মিলে সেইদিনই আমাকে চট্টগ্রাম রেডিওতে বদলী করে দিলেন, এবং আমাকে বললেন, "তোমার নাম আর্মির লিস্টে আছে। যে কোন মুহুর্তে তোমাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাবে এবং নঁখের ভিতরে সুঁই ফুটিয়ে কথা বের করে নেবে।

তাই আজই তুমি চিটাগাং চলে যাও, আমরা এদিক সামলে নেব। " চট্টগ্রাম রেডিওতে গিয়ে জয়েন করলাম, কিন্তু সেখানে আমাকে কোন দায়িত্ব দেয়া হলো না। O.S.D করে রাখা হলো। হয়তো ঢাকা রেডিও থেকে আগাম জানিয়ে দেয়া হয়েছিল, তাই সবাই আমাকে একটু এড়িয়ে চলছে বুঝতে পারলাম। কোন উপায় না দেখে ঢাকার বার্তা বিভাগের ফয়েজ চৌধুরীকে ফোন করলাম, "Mother serious come sharp লিখে একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দে।

আমার এখানে ভাল লাগছে না, আমি ঢাকায় চলে আসি। " দু'দিনের মধ্যেই টেলিগ্রাম পেয়ে গেলাম। সেটা ছিল ৭১ সালের অগাস্ট মাস। বহু কষ্টে টেলিগ্রাম দেখিয়ে সাতদিনের ছুটি নিয়ে ঢাকায় চলে এলাম। এসে দেখি রেডিওর গেটে জানিয়ে রাখা হয়েছে আমাকে যেন ঢুকতে দেয়া না হয়।

আমি রেডিওর সামনে সাহবাগ হোটেল, বর্তমান PG হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আলম, রফিক, ফয়েজ সবাই এসে আমার সঙ্গে দেখা করতো। তারা টেপ দিলে আমি যথারীতি নারায়নগঞ্জে জালালের কাছে নিয়ে যেতাম। সেই যে চট্টগ্রাম থেকে এসেছিলাম, আর ফিরে যাইনি। আমার স্কুল জীবনের বন্ধু সিরাজউদ্দীন ভুইঞা মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় কর্মী ছিল।

সে কখন কোথায় বোমা ফাটাতো আমার সঙ্গে আলাপ করতো। যেমন "আজ শেরাটন হোটেলে, কাল আজিমপুর গার্লস স্কুলে বোমা ফাটাবো। " এইভাবে মুক্তিযোদ্ধারা অস্থির করে তুলেছিল সমগ্র দেশের ব্যবস্থাপনা। একটা মজার ঘটনা হঠাৎ মনে পড়ছে। তখনও আমি রেডিওর ঢাকা অফিসে দায়িত্বরত।

মুক্তিযোদ্ধারা বোমা মেরে ঢাকা বিমান বন্দরের রানওয়ে নষ্ট করে দিয়েছে, সব বিমান চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ একটি বিমান রিলিফ সামগ্রী নিয়ে কোনমতে একটা রানওয়েতে নেমেছে। সঙ্গে সঙ্গে সরকারের তরফ থেকে জানানো হলো সমস্ত প্রচার মিডিয়া এটা সগৌরবে প্রচার করবে, যে এয়ারপোর্টে কিছুই হয়নি। সবই ঠিকমতো চলছে। আর্মির ক্যাপটেন সব খবরের কাগজের সাংবাদিকদের এবং রেডিও থেকে আমাকে নিয়ে ঢাকা বিমানবন্দরে হাজির হলেন।

আমাদেরকে দূর থেকে এয়ারপ্লেন দেখিয়ে বললেন "আপনারা যান এবং প্রতিবেদন তৈরী করুন। সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দিন দেশের অবস্থা ভাল, এয়ারপোর্টের অবস্থা ঠিকই আছে। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের propaganda সব মিথ্যা। " জনাব এ.বি.এম. মুসা সবার আগে, পিছে পিছে আমরা প্লেনের দিকে যাচ্ছি। হঠাৎ পশ্চিম পাকিস্তানী এক আর্মির সিকিউরিটি গার্ড আমাদের পথ রোধ করে দাঁড়ালো।

জিজ্ঞেস করলো, "কিধার যাতা হ্যায়?" মুসা সাহেব বললেন, "ও প্লেন কে পাস যাতা হ্যায়। উসকা পাইলট কে সাথ বাতচিত কারেগা, নিউজ পেপার মে ছাপেঙ্গে। " "নিউজ পেপার, ও কিয়া হোতা হ্যায়?", জিজ্ঞেস করলো আমাদের। ভাবলাম ভাল লোকের পাল্লায় পড়া গেছে। মুসা সাহেব তাকে বুঝাবার জন্য বললেন, "ও যো জংগ খাবর কা কাগজ (যা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত হতো), উস তারহা ইঁহাকা কাগজ মে ছাপেগা।

" সে অন্য কোন কথাই বুঝলো না, শুধু জংগ কথাটা ধরে বললো, "ইহা কোই জংগ-ওয়ং নেহি চালেগা, ভাগো। " আমি ভাবলাম আমাকে হয়তো যেতে দেবে। আমি রেডিও পাকিস্তানের কর্মচারী, হাতে টেপ রেকর্ডার। তার কাছে গিয়ে বললাম, "হাম রেডিও পাকিস্তান সে আয়া হ্যায়। " আমার দিকে তাকিয়ে বললো "ও কোন সা পাকিস্তান হ্যায়? ইহা এক পাকিস্তান হ্যায়, দুসরা কোই পাকিস্তান নেহি - যাও ভাগো।

" আমরা সবাই ফিরে এলাম, কিছুতেই যেতে দিল না। মুসা সাহেব বললেন আমি এর প্রতিবাদ করবো। পরের দিন খবরের কাগজে ঠিকই বিমান অবতরণের কথা ছাপা হলো, কিন্তু প্রতিবেদন না করতে দেয়ার প্রতিবাদ সহ। বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতায় ১৯৭১ এর ৩রা ডিসেম্বর ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করলো। আমরা আমাদের ধানমন্ডির বাসার ছাঁদে উঠে আকাশে ভারতীয় মিগ আর পাকিস্তানের সেবার জেটের মধ্যে সামনা সামনি যুদ্ধ দেখতাম।

মিগের গতির সঙ্গে কিছুতেই সেবার জেট পেরে উঠতো না। সেবার জেটগুলো একের পর এক গুলি খেয়ে ধোঁয়ার কুন্ডলী পাকিয়ে নিচে পড়ে যেত। অনেক বাড়ির ছাঁদের উপর থেকেই সেবার জেটের প্রতি লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হতো। ৭ই মার্চ যেই রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, সেই একই ময়দানে ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনী তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করলো সম্মিলিত বাহিনীর হাতে আত্মসমর্পন করে। যে অত্যাচার অবিচার তারা করেছিল, সব কিছুর সমাপ্তি টানা হলো।

জন্ম নিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষনের সেই অমূল্য টেপ দু'টো যুদ্ধ চলাকালীন নয় মাস স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে নিয়মিত প্রচার করা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করার জন্য।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।