প্রান্তিক জনগোষ্ঠিগুলোর ভাষা ও জাতিগত অস্তিত্বের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও সমমর্যাদা দাবী করছি
আমাদের সামনের রাস্তায় যেদিন থেকে বাস চলা শুরু করলো
আমাদের সামনের রাস্তায় প্রথম যেদিন বাস চলল সেদিন আমরা ভাবলাম পৃথিবীটা আক্ষরিক অর্থেই ছোট হয়ে আসছে, খুশী হলাম, এবং মাত্র আধমাইল দুরবর্তী আদমপুর বাজারে যাবার বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে বুঝলাম প্রখর রৌদ্রে বসে থাকার মধ্যেও আনন্দ আছে। তাছাড়া বাসগুলোতে নতুন নতুন হিন্দী গান বাজছিল বলে আরেক ধরনের রোমাঞ্চ অনুভব করলাম মনে, প্রকৃতপক্ষে বাসের চারটি চাকা মানুষকে যার যার গন্তব্যে নেয়া ছাড়াও আর কি কি করতে সক্ষম সেটা উপলব্ধি করতে পারিনি আমরা, সেজন্যে মাথায় গতিবিজ্ঞানের বিভিন্ন হিসাব নিকাশ ক্রমাগত ঘুরতে লাগলো, যদিও বাসে উঠামাত্র “মেরা পিয়া ঘর আয়া...” শুনে আমাদের কিছুটা খটকা লেগেছিল, যেভাবে খেতে বসে ঝাল তরকারীর ভিতর মিষ্টি স্বাদ আবিষ্কার করে আমরা চিন্তিত হয়ে উঠি।
এভাবে ঘুম থেকে উঠার আগে পোঁ পোঁ ইত্যাদি শব্দ চিৎকারের নতুন উপনিবেশে জীবনে নতুন মাত্রা এনে দিল, আমাদের কয়েকজন বন্ধু প্রথম কয়েকদিন এমনি এমনি বাসে উঠতো, তারপর গ্রামের শেষমাথায় এসে “ড্রাইভার লামাও! ও ড্রাইভার” বলে তড়িৎ গতিতে নেমে যেতো আর ফিরে আসার পথ হাত-পা শরীর দুলিয়ে “মেরা পিয়া ঘর আয়া...” গাইতে গাইতে ...
পার্শ্ববর্তী তিলকপুরের জনৈক ব্যক্তির শ্রাদ্ধে যোগ দেবার উদ্দেশ্যে নতুন ফেইচুম পাঞ্জাবী পরিহিত কুঞ্জ খুড়া দৌড়াতে দৌড়াতে সড়কে উঠে কোনরকম বাসে উঠার জন্য পা তোলার সময় ফেইচুমের কোণায় পা দিয়ে ফেললেও সম্ভাব্য লজ্জাকর দুর্ঘটনা থেকে এ যাত্রায় রেহাই পেয়ে যান। তবে স্বল্পবয়সী এক তরুণী যে প্রায় ড্রাইভারের কাছ ঘেঁষে বসেছিল সে খুড়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিতেই কুঞ্জ খুড়া ভেতরে ভেতরে জ্বলে উঠেন ‘নির্লজ্জ মেয়েছেলে, মিয়াঙের সাথে কেমন গা ঘেষে বসেছে, হু!’। সিটে বসার পর হাতের বামপাশে বসা লালরঙা নারীটিকে দেখে তিনি চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন, সেকথা গল্পচ্ছলে আমাদের বলেছিলেন।
এরকমই তিনি, এভাবেই বয়ান করে যান জীবনের ছোট বড় নানান অভিজ্ঞতার কথা, এর কিছুদিন বাদে আমাদের বুঝতে কষ্ট হয়না - তার বখে যাওয়া কুপুত্রকে এরকম একটি বাসের ড্রাইভার বানানোর স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন তিনি। আমরাও স্বপ্ন দেখা শুরু করি, তবে তার পুত্রকে নিয়ে নয়, আমাদের নিজেদের জন্যে, আচ্ছা আমরাও তো দেখতে পারি; আদমপুর বাজার টু মৌলভীবাজার বাসের ষ্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে “মেরা পিয়া ঘর আয়া...”, আহ্ !
কিন্তু বাসের চারটি চাকা আদমপুর থেকে ভানুগাছ, ভানুগাছ থেকে মৌলভীবাজার, মাঙখেইমাঙ থেকে তিলকপুর এবং তিলকপুর থেকে ঘোড়ামারা পৌঁছে দিচ্ছিল। মাত্র ৩/৪ টাকায় এই সেবার মাধ্যমে আমরা অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হলেও এ সেবার মাধ্যমে আমাদের আর কি কি উন্নয়ন ঘটতে পারে সে সম্বন্ধে প্রথম প্রথম আমাদের কোন ধারনা ছিলনা। যদিও বাসস্ট্যান্ডে উঠতি তরুন সম্প্রদায়ের ব্যস্ততা দিন দিন বেড়েই চলেছিল, এবং কালো চশমা হাই হিল জুতাওয়ালী দু'একজন অচিনপুরের স্বর্গ থেকে ইন্দ্রাভিশপ্ত অপ্সরার মতো নেমে আসলে তাদের চোখের তারা কেঁপে উঠছিল। সেরকম আমাদের কুমাড়াও এমন একজনকে দেখে বাড়ী ফিরে জ্বর বাঁধিয়ে বসে।
জ্বর তীব্র হলে তার মুখ থেকে নিঃসৃত আশ্চর্য রসদগ্ধ বাক্যরাশির লজ্জায় ও অপমানে, শিয়রে বসা জননী চোখে অন্ধকার দেখে। আমরাও দেখি, আপসোসে, ইস কেন আমরা দেখলাম না , আমরা কয়েকজন তখন থেকে রোজকার ডিউটি ঠিক করে ফেলি পিয়া ঘর আয়া ... এবং আমাদের মধ্যে যাদের পুরোনো প্রেমিকা ছিল, নিঃসঙ্গ দুপুরে উরুৎ ফুরুৎ বাসগুলোর দিকে তাকিয়ে তারা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলা শুরু করলো।
* ফেইচুম - ধুতির মণিপুরী সংস্করন
* মিয়াঙ - অমণিপুরী
* কুমাড়া - জনৈক তরুনের নাম
(২য় পর্বে সমাপ্য)
গণ্পকার : শুভাশিস সিনহা সমীর। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার কবি, গণ্পকার ও নাট্যকার। জন্ম বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলায়।
প্রকাশিত গ্রন্থাবলী : ছেয়াঠইগির যাদু(২০০২), সেনাতম্বীর আমুনিগৎতো সেম্পাকহান পড়িল অদিন (২০০৩), নুয়া করে চিনুরি মেয়েক (২০০৫) ইত্যাদি।
মুল গণ্পের লিংক: Click This Link
অনুবাদ: কুঙ্গ থাঙ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।