আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আহমাদ মোস্তফা কামালের গল্প সম্পর্কিত ছোট আলোচনা

কবি

আহমাদ মোস্তফা কামাল এর তিনটি গল্প গ্রন্থের উপর একটা আলোচনা লিখেছিলাম ছোট কাগজ ''বাবুই" প্রথম সংখ্যা ২০০৬ এ। লেখাটি ব্লগে প্রকাশ করা হলো। আহমাদ মোস্তফা কামালের গল্প : আত্মহননের নির্জন পথ, নেই ফেরিওয়ালার চিৎকার...হাইড্রোলিক হর্ণ জীবন সব সময়ই আংশিক; এবং ক্ষমাহীন। জীবনের শেষ সীমানায় যে মেঘ জমে আছে তাকে ভুল করে কখনও কখনও অন্ধকার দেবদারু বনের মত ভয়াবহ নির্জনতম শ্মশান ঘাট বলে মনে হতে পারে। যেমন শরতের সাদা মেঘকে ফুল তোলা রুমালের মত উড়ে যেতে দেখেছিলো কেউ কেউ দক্ষিণা পবনে।

দেখাটা দৃষ্টি নির্ভর আর দর্শন উপলব্ধি নির্ভর। এই নির্ভরশীলতা কে আশ্রয় করে আমরা যে কোন ইলুশনের ভিতর নিজেকে বিস্তার করে নিতে পারি। জীবনকে একটা বনের ভিতর বাঘে খাওয়া হরিণের রক্তাক্ত হাড়ের মত দেখা যেতে পারে। জীবনকে ভাবা যেতে পারে একটা ভাবুক পাথর, যার গভীরে জমা হয়ে আছে সামুদ্রিক নোনা জল। জীবন কে আমি সেই দেবদারু বনের মতই দেখি।

তার সাথে গল্প হয়, সে আমাকে বৃক্ষ-বিশ্বের উপমাহীন আখ্যান শোনায়। জীবনকে ভালো লেগে যেতে থাকে। তবে এই কি জীবনের পাঠোদ্ধার! না এই বনের আড়ালে বসে থাকা অন্ধকার চিতা বাঘের চোখ বহুদূর থেকে আমাকে অনুসরণ করে চলেছে গোপনে গোপনে। ফলে শুরু হয় 'আমি' সম্পর্কিত অস্তিত্বহীনতা। অস্তিত্ব আবিস্কারের শেষ নীরিক্ষা হয়তো আত্ম-হনন।

কিন্তু তার পূর্বে! বহু ঘটনার জট পাকানো অস্তিত্ব নিয়েই উদাসীন হয়ে বহুপথ হেঁটে আসতে হয়। আর আমরা যদি এই সমস্ত উদাসীন দিন আর রাত্রির গল্প লিখে যেতে পারতাম তবে সেই গল্পের পাশে আহমাদ মোস্তফা কামালের গল্প গ্রন্থগুলো ম্লান হয়ে পরে থাকতো। এই গল্পগুলোর তাপমাত্রা থার্মোমিটারে ৯৮ ডিগ্রী সেলসিয়াসের একটু বেশ নিচেই। ফলে রোগীর যদি মৃত্য ঘটে মহাকালে, তবে তা পুষ্টিহীনতাজনিত নিম্ন উষ্ণতার কারণে। জীবনের প্রতি তীব্র ঋণাত্মক বোধ উস্কে উস্কে জ্বালিয়ে তিনি লিখে ফেলেন তার গল্পগুলো।

জীবনের উপর নির্লিপ্ত ঈশ্বরের চোখ ফেলে লেখককে লিখতে হয় পক্ষপাতহীন ভাবে, নতুবা সাজানো গোছানো সেটের বিপরীতে একজন ক্যামেরা-ম্যান আবিষ্কৃত হয়ে যায়। আহমাদ মোস্তফা কামালের গল্প সব সময়ই একটা আখ্যানের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হয়। তার গল্পের ভিতর একটা গল্পই থাকে। তিনি গল্প করতেই ভালোবাসেন। তবে তাঁর গল্পের চরিত্ররা যে পথে হাঁটেন তা বেশ নির্জন, চরিত্রের আশে পাশে কেউ থাকে না বললেই চলে।

সে পথে কোন ফেরিওয়ালার চিৎকার কিংবা এই যান-সভ্যতার কোন হাইড্রোলিক হর্ণ বাজতে শোনা যায় না। তারা অত্মহত্যা ছাড়া আরও ভীষণ কিছু করতে অপ্রস্তুত। আর সে সব চরিত্রগুলো বেশ রক্ষণশীল ভাবেই ভাবতে প্রস্তুত। ফলে চরিত্রের পিছনের পটভূমি আঁকিয়ে তুলতে তিনি ব্যর্থ হন অনেক সময়। সাধারণ একটা এক-তরফা গতির ভিতর দিয়ে তাঁর গল্প অগ্রসর হতে থাকে।

দ্বিতীয় মানব, পরাজয় অথবা বন্ধুর দিনলিপি গল্পের চরিত্রগুলো সেচ্ছায মৃত্যু বরণ করে। করতেই পারে। কারণ কামাল (দ্বিতীয় মানব) হয়তোবা সিজোফেনিয়ার রোগী। কিন্তু মেয়েটি (পরাজয়) কিংবা আশীষ (বন্ধুর দিনলিপি), আমার মনে হয় শুধু মাত্র লেখকের পরিকল্পনাতেই মরে যায়। হাতে বন্দুক, ওপাশে চাঁদমারি।

জীবনকে টার্গেট করে আত্মহননের গরম সীসা বৃষ্টির মত ছুটে আসতেই থাকে। মনে হয় তাদের মৃত্যু যেন অকারণ। লেখক এক একটা চরিত্র গড়ে তোলেন, অথচ তাদের উপর সঠিক মাত্রায় আলো না ফেলায় তারা ঠিক রক্ত মাংশের মানুষ হয়ে ওঠে না। তারা তাদের কিছু অভিজ্ঞতার কথা বয়ান করে সরে পরে। ফলে পাঠক একটা নির্দিষ্ট গন্ডির ভিতর আটকা পরেন।

বের হওয়ার আর কোন পথ খুঁজে পাওয়া যায় না। কোন গল্প বলার আগে যে পরিবেশ তৈরি করা দরকার তা তৈরি করতে ব্যর্থ হন আহমাদ মোস্তফা কামাল। পরিবেশ তৈরির সফলতার কারণে গল্প ছাড়াও ছোট-গল্প ঠিক দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। যে লোকটিকে আমি বরাবর মামা বলে জেনে এসেছি , তিনি আমাকে সবার্থে ‘মানুষ’ হিসাবে তৈরি করেছেন, তিনি এই অসীম প্রতিদান গ্রহণ করেছেন আমার মায়ের কাছ থেকে; মাকে বলাৎকার করে। [সম্পর্ক/ দ্বিতীয় মানুষ] অসাধারণ একটা গল্প হয়ে উঠতে পারতে সম্পর্ক।

কিন্তু চিত্রনাট্যের স্ক্রিপ্টের মত ভাগ করে অপ্রয়োজনীয় লেখক ভাষণ লেখার ক্ষতি করে বসলো। তাঁর টেকনিকই তাঁর গল্পে ধস নামায়। বর্ণনা বাচালতা পর্যায়ে উন্নীত হতে সময় লাগে না। এটা কি কোন গল্প হতে পারতো এই গল্পেও পাঠক তার বাচালতা বুঝে ফেলবে। এখানে যে সিরিয়ালটি করা হয়েছে সেটি মোটামুটিভাবে আমারই কথা।

কোথাও কোথও থার্ড ব্র্যাকেটে আমি মন্তব্য করছি আপনাদেও সুবিধার জন্য। আষীশের অধিকাংশ লেখাই অসমাপ্ত, অসম্ভব এক ক্লান্তি ওকে পেয়ে বসেছিলো। কিন্তু ওর চমৎকার লেখার হাত ছিলো বলেই—এগুলো বিরক্তি উৎপাদন করে না। প্রিয় পাঠক, আসুন এবার আমরা আষীশের অদ্ভুত স্বপ্ন ও কল্পনার জগতে প্রবেশ করি। [বন্ধুর দিনলিপি/ দ্বিতীয় মানুষ] আরও কোথও কোথাও মিলতে পারে এরুপ গল্প বলার টেকনিক।

তিনি সবই খণ্ড খণ্ড করে বলে দিতে চান। আলো- আঁধারির অধরা খেলায় আহমাদ মোস্তফা কামাল পারদর্শী নন। তিনি বেশ ভালো ভাবেই গল্প শুরু করেন। কিন্তু তার টেনশন বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেন না। অক্টোপাশ বেশ ভালোই শুরু হতে থাকে।

কিন্তু বাবা মেয়ের ডায়লগ বেশ দুর্বল ঠেকতে থাকে। আহমাদ মোস্তফা কামালের দ্বিতীয় গ্রন্থ আমরা (একটি গল্পের জন্য অপেক্ষা করছি) কে ঠিক আমি গল্প গ্রন্থ বলতে প্রস্তুত নই। একটা কাহিনীরই বিস্তার বলা যেতে পারে সবগুলো গল্পকে। ফলে তাতে একটু উপন্যাসের গন্ধ নাকে আসে। তার মূল প্রবনতাই গল্প বলা।

তাঁর গল্প ক্লিশে বর্ণনা-আক্রান্ত। গল্পের চরিত্রগুলোর ডায়লগ অধিকাংশই লেখকের ভয়েজে। চরিত্রগুলো বেশি কথা বলার সুযোগ পায় না। ফলে তাদের বৈশিষ্টের ভেরিয়েশন কমে যায়। অপেক্ষায় (অন্ধকাকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না বলে) পদ্মা পাড়ের ভাঙনের ছবি দূর থেকে দেখা সংবাদ-পত্রের নিউজের মত মনে হয়।

চরিত্রগুলো ভাসাভাসা, লেখকই প্রবল ভাবে উপস্থিত পুরো গল্প জুড়ে। তিনিই গায়ক এবং বাদক। শুধু অপেক্ষা নয় তার প্রায় প্রতিটি গল্পেই একজন গল্প বক্তা থাকে। পাঠককে একটা নির্দিষ্ট ভূগোল পর্যটন না করিয়ে, তাদের সামনে নিয়ে আসেন ঐ ভূগোলের মানচিত্র। ঐ পরিবেশে ঢুকে প্রকৃত উপলব্ধির অর্জন করতে পাঠককে বেশ বেগ পেতে হয়।

তবে কী তার লেখা অতলান্তে হারিয়ে যাবে ! লেখকই জানেন, কারণ লেখকই প্রথম ও শেষ পাঠক। আহমাদ মোস্তফা কামাল তার লেখাকেই না হয় একটু বাঁকা করে দেখুক; তবে হয়ত তিনি নিজেই ছাড়িয়ে যাবেন নিজের সীমানা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.