প্রান্তজন
আজ ১৫ ফেব্রুয়ারি একুশে পদকপ্রাক বাউল শাহ আবদুল করিম এর ৯৩তম জন্মবার্ষিকী। ১৯১৬ সালের১৫ ফেব্র“য়ারি সুনামগঞ্জের দিরাই থানার ধল গ্রামে জীবন্ত কিংবদন্তি এ বাউল জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের সকল সংকটে,সংগ্রামে এ মহান শিল্পীর ছিল সক্রিয় অংশগ্রগণ। শাহ আবদুল করিম একজন সমাজ সচেতন মানবতাবাদী লোকশিল্পী। তিনি সমাজের সকল অনাচার, ভন্ডামি আর কুসংস্কার তীব্র ঘৃণায় ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর মৃত্তিকাশ্রয়ী গানে।
প্রেমের কাব্যভাষা নির্মাণের পাশাপাশি মানুষের জয়গান গেয়েছেন গণমানুষের এই বাউল। মানুষের রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ে সচেতন আপাদমস্তক গান পাগল মানুষ আবদুল করিম শুধু গানে গানেই মানুষের কথা বলেননি, মঞ্চে ,ময়দানে মানুষের অধিকার নিয়ে লড়াই করেছেন। বিদ্রোহী প্রগতিবাদী স্বশিতি এই চারণশিল্পী ‘বঁাঁচতে চাই’ নামে সংগঠন করে মানুষকে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছেন,বিদ্রোহে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। প্রেমিক আবদুল করিম শুধু প্রেমিকা, স্ত্রী, স্রষ্টা আর মুর্শিদ প্রেমে বিভোর ছিলেন না, দেশপ্রেম ছিল আবদুল করিম চরিত্রের বড়গুণ। ইতিহাস সচেতন এই কবি শাসকের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের গান গেয়েছেন, প্রতিরোধের স্বপ্ন দেখিয়েছেন।
বাঙালির সকল মহৎ অর্জনকে হৃদয়ে ধারণ করে মানুষকে আগামীর পানে টেনেছেন। আবদুল করিম তাঁর জাগরণী গণসঙ্গীতের মাধ্যমে মানুষকে জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন। ব্যঙ্গ-বিদ্রোপ আর উপমা-উৎপোয় মানববিরোধী ছলচাতুরী আর প্রতারণার কৌশল ফাঁস করে দিয়ে, সাধারণ মানুষের পে কলম ধরেই তিনি ান্ত হননি সুরেলা কণ্ঠে উজ্জীবনী গান গেয়ে মানুষের বিপ্লবী চেতনাকে শানিত করেছেন ।
তাঁর গানে যখন বলা হয় -
জন্ম নিয়েছি যখন জীবনের গান গাই
মানুষ মানুষের মত বেঁচে থাকতে চাই \
তখনই অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার দীপ্ত অঙ্গিকার ভেসে উঠে।
শাসক- শোষকের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদী গান মানুষকে প্রেরণা যুগিয়েছে।
দেশ-জাতি, মাটি-মানুষ আর মানবিকতার পে দেশাত্মবোধক গান মানুষকে দিয়েছে সঞ্জিবনী সুধা। উজ্জীবিত করেছে দেশপ্রেমে। সচেতন করেছে অধিকার আদায়ে।
তিনি যখন কণ্ঠে ধারণ করেন
মানুষ হয়ে জন্মেছি তো, বাঁচতে চাই মানুষের মতো
চাই মানুষের সমাজ বিধান,
গাইরে বাংলার জয়গান। -
কিংবা
মানুষ যদি হইতে চাও, কর মানুষের ভজনা
সবার উপরে মানুষ, সৃষ্টিতে নাই যার তুলনা।
তখন মানবতাবাদী আবদুল করিম আমাদের সম্মুখে শ্রদ্ধায় উদ্ভাসিত হন।
মাটি ও মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা তাঁর অগণিত গীতিমালায় ফুটে উঠেছে। মানুষকে ভালোবেসেই তিনি দায় সাড়েননি, মানুষকে সচেতন করতে, তাঁর ন্যায্য অধিকার আর হিস্যা আদায়ে প্ররোচনা দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন -
মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, বছরে এক ফসল মিলে।
সে ফসল নষ্ট হইলে, প্রাণে বাঁচা দায়।
ঘরে বসে ভাবাগুনা, নৌকা বিনা চলা যায় না।
বর্ষার দিনে রুজি পায় না, গরীব নিরুপায়।
তিনি তাঁর ‘কালনীর ঢেউ’ গ্রন্থের একশ উনত্রিশ নম্বর গানে উল্লেখ করেছেন -
হাওর এলাকায় থাকি আমরা কৃষাণ,
হাড়ভাঙা পরিশ্রম করি ফলাই বোরো ধান।
এসে বন্যার জল, অকালে ডুবাইয়া নিল,
হাওরের ফসল মানুষ হয়েছে পাগল।
গরীবের নাই সহায় সম্বল বড়ই নিদান।
এদেশে তে ফসল রা বড়ই বিভ্রাট
দেশের যত নদী-নালা (সব) হয়েছে ভরাট।
...
নদী খনন না হইলে, নাই সমাধান।
...
হও হুশিয়ার, নইলে উপায় নাই যে আর,
ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার খুঁজে নেও সন্ধান।
শাহ আবদুল করিম শুধু পথ খুঁজে নিতে বলেননি, পথের সন্ধানও দিয়েছেন । মানুষকে বাঁচার জন্য কাজ করে যাওয়ার, নিজের কল্যাণের জন্য সংঘবদ্ধ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
ইতিহাস সচেতন গণশিল্পী শাহ আবদুল করিম ভাষা আন্দোলনের শহীদদের নামোল্লেখ করে শ্রদ্ধা জানিয়ে মানুষকে আহবান জানিয়েছেন Ñ
লভিব অধিকার, ঘুচাবো আঁধার
শপথ বারে বার মণপ্রানে।
আবদুল করিম বলে, শোষণমুক্ত হলে
হাঁসি ফুটিবে সবার বদনে ।
শাসক গোষ্ঠীর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বিদ্রোহী করিম যখন গেয়ে উঠেন
জুলুমের বিরুদ্ধে যখন জনতা রুখে দাঁড়ায়
দালাল গোষ্ঠী নেমে আসে বিভ্রান্তি ঘটায়রে।
উচিত কথা বলি যদি, শোষক দলে চোখ রাঙ্গায়।
তখন মানুষের ভেতর রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত হয়।
অধিকার আদায়ে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়। ভোট শিকারী প্রতারক রাজনীতিবিদদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অল্পশিতি করিম যখন গেয়ে উঠেন-
বলো ভোট দিব আজ কারে ?
...দুষ্ট লোক ইলেকশনে পাশ করতে চায় টাকার জোরে।
তখন বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থার দুদর্শার বাস্তব চিত্রই ফুটে উঠে।
সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে ধর্মকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল সম্পর্কে সচেতন অসা¤প্রদায়িক, সমাজতান্ত্রিক আবদুল করিম এর দৃপ্ত উচ্চারণ
সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ মিলে।
দেশের সম্পদ লুটে নিল, তিন ডাকাতের দলে।
...
কেউ বলে জাগো বাঙ্গালী উড়াও জয় নিশান।
কেহ বলে ধর্ম গেল জাগো মুসলমান।
...
বাউল আবদুল করিম বলে সুজা রাস্তা ধরো
শোষনমুক্ত সমাজ গড়ে বাঁচার উপায় করো।
শাহ আবদুল করিম বাংলাদেশের ইতিহাসের এক জীবন্তপাঠ। সকল প্রগতিশীল আন্দোলনে তাঁর গান জুগিয়েছে সাহস ও প্রেরণা।
কাগমারী সম্মেলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনী জনসভায় সংগীত উপহার জাতিকে করেছিল অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত।
তিনি তাঁর ‘কালনীর ঢেউ’ গ্রন্থের একশ’ তেতাল্লিশ নম্বর গানে বাংলাদেশের মুক্তির ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল ধারাবাহিকতা তুলে ধরেছেন।
তিনি উচ্চারণ করেছেন
মুক্তির তরে, চলছে জোরে, জীবন করে পণ
দেশে দেশে চলছে রোষে মুক্তিযোদ্ধার রণ,
...
ধোকাবাজী মূল পুঁজি, ভোট নেওয়া ভাই,
বিপ্লব ছাড়া সর্বহারা বাঁচার, উপায় নাই।
মহান মুক্তিযুদ্ধ বাউল আবদুল করিমকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল। মুক্তির গান গেয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস যুগিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস দেশের অভ্যন্তরে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, সহযোগিতা করেছেন।
নির্ভীক কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন-
বলো স্বাধীন বাংলা মোদের মাতৃভূমির জয়।
প্রাণ দিয়ে প্রতিজ্ঞা কর ছেড়ে দাও মরণের ভয়।
...
শপথ নেও বাঙ্গালী যত, বাঁচলে বাঁচব বাঁচার মত
আর আমরা হব না নত, যদি হয় বিশ্ব প্রলয়।
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রগতিবাদী কবি আবদুল করিমের স্বপ্নের বাস্তবায়ন, আশার অবলম্বন।
তাইতো তিনি গেয়ে উঠেন
মুক্ত কণ্ঠে গায় করিম মুক্তবাংলার গান,
বাংলার আকাশে উড়ছে মুক্তির নিশান
স্বাধীন বাংলায় রে।
বাংলা মোদের জন্মভূমি বাংলা মোদের দেশ
বাংলা মায়ের সেবা করে হউক্ না জীবন শেষ রে
বাংলা মোদের জন্মভূমি রে।
বাংলার প্রেমে বিভোর দেশপ্রেমিক বাউল আবদুল করিমের চেতনা প্রবাহে মাতৃভূমির স্থান সবার উপরে। দেশের প্রতি গভীর ভালবাসায়, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতায় আর ইতিহাসের প্রতি বিশ্বস্থতা আর শ্রদ্ধায় তিনি গেয়ে চলেছেন দেশের গান, মানুষের গান।
আমি বাংলা মায়ের ছেলে
জীবন আমার ধন্য যে হয়
জন্ম বাংলা মায়ের কোলে।
নিজের সকল অভাব অভিযোগ, দারিদ্রতা আর অত্যচারের করুণ কাহিনী পেছনে ঠেলে তিনি নতুন দেশ বিনির্মাণে ঝাপিয়ে পড়লেন সংগীতকে হাতিয়ার করে। মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে থাকলেন দেশ গড়ার অনুপ্রেরণা ।
উচ্চারণ করলেন Ñ
শান্তিকামী বাংলাবাসী সবার মুখে ফুটুক হাঁসি
শোষণের হউক চীর অবসান
এ আদর্শ সামনে রেখে হও আগুয়ান Ñ
গাইরে বাংলার গুণগান।
স্বাধীন বাংলাদেশে অনাচার আর অব্যবস্থাপনা বাউল আবদুল করিমের স্বপ্নভঙ্গের কারণ হয়ে উঠে। তাঁর মন কাঁদে।
কন্ঠ আওয়াজ তোলে -
কেবা শত্র“ কেবা মিত্র বুঝে উঠা দায়।
তাই তো দেশের অবনতি, সাধুর নিশান চোরের নায়।
...
কেউ হইল কালোবাজারী কেউ করতেছে মজুদদারী
কেউ করতেছে রিলিফ চুরি যেভাবে সুযোগ পায় \
স্বপ্নের বাংলাদেশ না পেয়ে, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের কার্যকলাপ দেখে হতাশ, মর্মাহত বাউলের মন কেঁদে উঠে। প্রতিবাদ করে। আবারও মানুষকে উজ্জীবিত করতে নতুন গান ধরেন, উচ্চারণ করেন
বাংলা স্বাধীন হইল পরে আবার দেখি তোমারে
বাঙ্গালীর দরদী সেজে আস্লে তুমি ছল করে।
...
সোনার বাংলা করল ছারখার সাম্রাজ্যবাদ শয়তানে।
দেশের শাসন ব্যবস্থায় শংকিত করিম নির্যাতনের ছবি আঁকেন। গভীর মমতায় মানুষের করুণ কাহিনী, রাজনৈতিক নেতাদের ছলচাতুরীর কাহিনী তাঁকে আহত করে। ভোগবিলাসী মানুষের বড়লোক হওয়ার ধান্ধা আর নীতি-নৈতিকতা বিসর্জনের চিত্র শাহ আবদুল করিমকে আঘাত করে।
তিনি ক্রন্দন করেন,
শোষকের শাসন ব্যবস্থা যেখানে রয়েছে জারি।
ভোটে মুক্তি আসিবে না শুটকির নায় বিড়াল বেপারী।
...
মিথ্যা কথায় বাজায় ডঙ্কা, রাস হয় গিয়ে লংকা
রাজনীতি নেতার সংখ্যা, অনেকগুণ বেড়ে গেছে
মনে মনে চিন্তা করি, রাজনীতি নয় দোকানদারী
স্বার্থ নিয়ে মারামারি ধর্মাধর্ম সব গেছে।
বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতির কোনো বিষয়ই ইতিহাসের পর্যবেক বাউল করিমের চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি। সকল অসঙ্গতি, ইতিহাসের বিয়োগান্তক ঘটনা,জাতির জনকের নির্মম পরিণতি, সামরিক- বেসামরিক স্বৈরাচার আর গণতন্ত্রহীনতার বাংলাদেশ তাঁর দুশ্চিন্তার কারণ, প্রতিবাদের ভাষা।
তারপরও আশাবাদী দেশপ্রেমিক বাউল স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান।
মাতৃভূমি আর মাতৃভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে অন্তর থেকে সুরারোপ করেন-
আমরা মজুর চাষী
দেশকে যদি ভালবাসি
সবার মুখে ফুটবে হাসি
দুঃখ যাবে দূরে।
বাংলাদেশের লোক সাহিত্যের অন্যতম প্রাণপুরুষ জীবন্ত কিংবদন্তি বাউল শাহ আবদুল করিমের জীবন পাঠ ইতিহাসেরই তো এক নিবীড়পাঠ। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে শাহ আবদুল করিম চর্চা একান্ত প্রয়োজন। বর্তমান সময়ের এই নিঃসীম অন্ধকারে, বিভ্রান্তিতে ও বন্ধ্যাত্বে শাহ আবদুল করিমের জাগরণী গান আমাদের এক পরম নির্ভরতা। মানুষকে সংহত, সংস্কৃত, মানবিক এবং জাগ্রত করে তুলতে বাউল শাহ আবদুল করিম এর পংক্তিমালা এক নির্ভরযোগ্য আশ্রয়।
অশীতিপর বৃদ্ধ এ জাত বাউল শাহ আবদুল করিমকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা । কামনা তিনি যেন দীর্ঘজীবন লাভ করেন। জয়তু শাহ আবদুল করিম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।