অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা সংসদে ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী প্রস্তাবে জামায়াতে ইসলামীকে সংগঠন হিসেবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারের মুখোমুখি করার প্রস্তবনা অনুমোদিত হওয়ায় আইনানুগ পদ্ধতিতে যুদ্ধাপরাধী কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধে সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে আইনানুগভাবে নিষিদ্ধ করার একটা সম্ভবনা তৈরি হয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা কিংবা তাদের ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে, লোভ লালসায় মানবতাবিরোধী অপরাধে কিংবা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নির্মম বাঙালী নিধনে সক্রিয় সহযোগিতা করেন নি বরং তারা সংগঠনের নির্দেশে সংগঠনের পরিকল্পনা অনুসারেই পরিকল্পিত ভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছেন এবং বিভিন্ন ধরণের মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত হয়েছেন।
রাজনৈতিক আদর্শের প্রভাবে সাংগঠনিক ভাবে গণহত্যায় সহযোগিতা করার অপরাধের দায় সম্মিলিত ভাবে এই সংগঠনের সকল নেতাকর্মীর উপরেই বর্তায়। ১৯৭১ সালের ৪ঠা এপ্রিল থেকে ১৪ই ডিসেম্বর পর্যন্ত অবরুদ্ধ বাংলাদেশে প্রকাশিত জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রামের বিভিন্ন প্রতিবেদনে জামায়াতে ইসলামীর নেতা কর্মীদের এই সাংগঠনিক স্বাধীনতাবিরোধী কার্যক্রমের সংবাদ ছড়িয়ে আছে।
জামায়াতে ইসলামী সাংগঠনিক ভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছিলো তার একটা প্রমাণ হতে পারে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরাও বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে এদেশে এসে গণহত্যায় সহযোগিতা করেছে, ১৯৭৩-৭৪ সালে সাধারণ ক্ষমার আওতায় মুক্তি পাওয়া এমন একজন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম পাকিস্তানী কোনো লেখকের জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস বিষয়ক লেখায়।
নাম মনে নেই, কেউ কখনও লিংক দিয়েছিলো সম্ভবত।
গণজাগরণ মঞ্চ ২১শে ফেব্রয়ারী মহসমাবেশ ডেকে আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেই অনুমিত হয়। সে সময়ের ভেতরে সংসদে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে কি না এ বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য জানা নেই কিন্তু সরকার যদি আগ্রহী হয় তাহলে তারা আগামী দুই দিনের ভেতরেই মানবতাবিরোধী অপরাধের সহযোগী হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে অভিযুক্ত করে আন্তর্জাতিক আইনে গঠিত ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করতে পারে। গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা জামায়াতকে আইনত নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে সরকারের এমন সবুজ সংকেত পেয়ে আন্দোলনের ফলাফল পাওয়ার জন্য একটা চুড়ান্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়ে আন্দোলন স্থগিত করতে পারেন, অথবা তারা সংসদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে জামায়াত নিষিদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করে আন্দোলন স্থগিত করতে পারেন। তারা আন্দোলনের ভবিষ্যত বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত নিবেন সেটা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তের বিষয়, তবে অনির্ধারিত কাল তারা রোদ জল বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাস্তায় অবস্থান করতে পারেন না।
সরকার এইসব আইনগত প্রক্রিয়া শুরু করলে সেটা এক ধরণের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়, সেটার সমাপ্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত রাজপথ অবরোধ করে বসে থাকার কোনো যুক্তি নেই।
ট্রাইব্যুনালের বিধি সংশোধনের ফলে কাদের মোল্লার বিচারের রায় পর্যালোচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে, কাদের মোল্লার বিচারের রায় বিষয়ে উপস্থিত জনগণ তাদের প্রত্যাশা স্পষ্ট ব্যক্ত করেছেন, কিন্তু আদালতের বিচারিক সিদ্ধান্ত নাগরিক হিসেবে মেনে নিতেই হবে, ট্রাইব্যুনাল ন্যায়বিচার করবেন এবং জনগণের প্রত্যাশা পুরণ করবেন এই আস্থাটুকু আমাদের রাখতে হবে। ৩ শতাধিক মানুষ হত্যার বিচারে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রদত্ত রায়ের অসন্তোষটুকু এই আন্দোলনের প্রধান ভিত্তি। আদালতে উত্থাপিত সাক্ষ্যপ্রমাণ এবং বিচারকের সিদ্ধান্ত সবগুলো বিবেচনা করে হাইকোর্ট সুপ্রীম কোর্ট তাদের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিবে।
সবগুলো দাবিই যে তাৎক্ষণিক পুরণ হবে এমনটা বিশ্বাসের কোনো কারণ নেই, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমার বিবেচনায় কখনও আসবে না এমন একটা সাংবিধানিক পরিবর্তন আসলে সাধারণের ভেতরে পরবর্তী সরকার আসলে এদের সাজা কমিয়ে দেওয়া বিষয়ে যে সংশয় সাধারণ মানুষের ভেতরে আছে সেটা দুর হয়ে যেতো।
একই সাথে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম যতদিন না সকল চিহ্নিত মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার সমাপ্ত হয় ততদিন পর্যন্ত অব্যহত থাকবে এই সাংবিধানিক নিশ্চয়তাটুকুও সংসদে উত্থাপিত হলে সকল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটুকু পুরণ হবে।
এই টেকনিক্যাল বিষয়গুলোর দিকে সরকার ও সংসদের নজর আছে এমনটা আশা করা যায় কিন্তু দ্রুততম সময়ে এই সংবিধান সংশোধনীগুলো উত্থাপন ও বাস্তবায়নের একটা সময়সীমা বেঁধে দেওয়া যেতে পারে মহাসমাবেশের ঘোষণায়, তিন চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদের যেকোনো ধরণের সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা আছে।
তবে এই আলোচনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টাই অনালোচিত রয়ে গেলো। জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান নেতা কর্মী এবং দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্যক্তিগত যোগ্যতায় অন্তর্ভুক্ত জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকরা রাজনৈতিক ভাবে জামায়াত নিষিদ্ধ হলে কি ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখাবেন ? সাধারণের আশংকা তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়ে বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকান্ডে জড়িত হবে এবং সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক এবং জামায়াতের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে এই নাশকতামূলক কর্মকান্ডের অর্থনৈতিক সহযোগিতা তারা পাবে। সুতরাং গণজাগরণ মঞ্চ থেকে অন্য একটি দাবি উত্থাপিত হয়েছে, জামায়াতের মালিকানাধীন সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রীয় নজরদারীর আওতায় আনতে হবে।
সরকারের নজরদারী কিংবা প্রশাসনিক অংশগ্রহন কি পর্যায়ে হবে এটা তেমন আলোচিত হয় নি। এই সম্পূর্ণ বিষয়টি আসলে এক ধরণের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ এবং বিভিন্ন মাত্রায় সেটা ঘটতে পারে।
অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থনৈতিক লেনদেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারীতে হতে পারে, তারা তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে এইসব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কোনো অর্থ যেনো এমন জঙ্গীবাদের অর্থায়নে ব্যবহৃত না হতে পারে সেটুকু নিশ্চিত করতে পারেন। সেক্ষেত্রে এইসব প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমানের কার্যক্রমকে বিন্দুমাত্র ব্যহত না করেও জঙ্গীবাদের অর্থায়নের উৎস বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব।
গত ৩০ বছরে পরিকল্পিত ভাবেই জামায়াত বিভিন্ন সেক্টরে মেধাবী ব্যক্তিদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে, এরা বর্তমানের সামাজিক ক্ষমতা কাঠামোর অংশ এবং এদের অধিকাংশই জামায়াতের প্রতি সহানুভুতিশীল।
এদের ব্যক্তিগত অনুদান বন্ধ কিংবা নজরদারির ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের নেই। এইসব জামায়াতের প্রতি সহানুভুতিশীল ব্যক্তিদের তালিকাও রাষ্ট্রের কাছে নেই। সুতরাং অর্থনৈতিক উৎস বন্ধ করলেও যে জঙ্গীবাদের অর্থায়ন থেমে যাবে এমনটা ভাবা বোকামী।
এই অর্থনৈতিক ভাবে স্বচ্ছল জামায়াতের প্রতি সহানুভুতিশীল সামাজিক এলিটদের কোনো না কোনোভাবে নিয়ন্ত্রন করতে হবে, এদের সামনে বিকল্প একটি রাজনৈতিক আদর্শ উপস্থাপন করতে হবে। সরকার জামায়াতের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দখল নিয়ে এদের কর্মীদের ভেতরে যারা জামায়াতের আদর্শে বিশ্বাসী তাদের কর্মচ্যুত করলে বেশ বড় একটা জনগোষ্ঠী বেকার হয়ে যাবে এবং তারা সরাসরি সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমে জড়িত হতে উদ্বুদ্ধ হবে যা কাম্য না।
সরকারের ন্যুনতম খবরদারী এবং জঙ্গীবাদী উত্থানে এইসব প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক প্রণোদনা বন্ধ করার কৌশল নিয়ে সরকার আন্তরিক ভাবে ভাবলে একটা সমাধানে পৌঁছানো যাবে। কিন্তু রাতারাতি এইসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সরকারের দখলদারিতে নিয়ে আসা এক ধরণের অস্থির পরিস্থিতি তৈরি করবে।
গণজাগরণ মঞ্চের সবগুলো দাবি মেনে নেওয়া সম্ভব কিন্তু সেটা সময়সাপেক্ষ পরিকল্পনার বিষয়, সেসব প্রশাসনিক, রাজনৈতিক সামাজিক অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো সামগ্রীক ভাবে নির্ধারণ করবে আমাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যত। সরকার বিচক্ষণতার প্রমাণ রাখবে এই আশাবাদ রেখে আন্দোলনকারীরা ২১শে ফেব্রুয়ারী শপথ নিয়ে নিজের নিজের বাসায় ফিরে যাক, যাওয়ার আগে তারা যদি সাধারণ জনগণকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান সবচেয়ে ভালো হয়। এই আন্দোলনে সক্রিয় সচেতন উপস্থিতির মাধ্যমে আন্দোলনকে সফলতার দিকে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্বটুকুর জন্যে সাধারণ মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কার্পন্য এখনও মঞ্চে বিদ্যমান।
আশা করি তারা এই সীমাবদ্ধতাটুকু কাটিয়ে সকল শ্রেণী ও পেশার জনগণকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে মহাসমাবেশে আন্দোলন শেষ করবেন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।