আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি অখ্যাত জীবনী- ০১

আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

একটি অখ্যাত জীবনী: প্রস্তাবনা দাদির জন্ম ১৯২৭ সালের পহেলা জানুয়ারি বৃহত্তর নোয়াখালিতে। তার পিতা একজন হাফেজ ছিলেন। ধর্মীয় পরিবেশে বড় হওয়ায়, ছোট বেলা থেকেই তার ধর্ম শিক্ষা শুরু হয়। আমি যতদুর জানি, দাদি স্কুলেও পড়েছিল চতুর্থ শ্রেনী পর্যন্ত। তার পিতার এক পালক মেয়ে ছিল রুনু।

রুনুর বাবা মা মারা যাওয়ায় দাদির বাবা রুনুকে দাদির সাথেই নিজ মেয়ের মত পালন করতে থাকেন। রুনু সম্পর্কে দাদির ভাগনি হত, যদিও তাদের বয়স ছিল একই। ছোটবেলা থেকেই তারা একসাথে বড় হয়। দাদি আর রুনুর মাঝে একটা বড় পার্থক্য ছিল। দাদি খুবই কাল অন্যদিকে রুনু ধপধপে ফর্সা।

দাদির বয়স যখন প্রায় ১০ তখন অন্য এক গ্রামের ফজল মিঞার ছেলে নুরুল হক (দাদার) সাথে দাদির বিয়ে হয়। দাদা তার গ্রামের প্রথম মেট্রিক পাস করা ছেলে। মেট্রিক পাস করার পর দাদা ফরিদপুরে কলেজে ভর্তি হয় এবং আইএ পাস করে। আইএ পাস দাদার গ্রামের প্রতি আগ্রহ ছিল না। সে সরাসরি কলকাতা গিয়ে, বৃটিশ সরকারের খাদ্য বিভাগে চাকুরি নেয়।

এর মাঝে দাদার গর্বিত পিতা তার জন্য মেয়ে দেখা শুরু করেছে। একদিন খবর আসল পাশের গ্রামের হাফেজ সাহেবের একটি বিবাহ যোগ্য মেয়ে আছে। মুরুব্বিদের নিয়ে দাদা গেল মেয়ে দেখতে। হাফেজ সাহেব ছেলেকে বললেন, “বাবা, মেয়ে দেখবার আগে তোমাকে একটা কথা বলে নিতে চাই। কথাটা শুনে যদি তোমার যদি আগ্রহ থাকে আমার মেয়েকে বিয়ে করার তবে তুমি মেয়ে দেখ।

নইলে, আমার মেয়েকে সামনে ডেক না। কথাটা হল, আমার মেয়ে অসম্ভব কাল”। হাফেজ সাহেবের সৎ স্বীকারোক্তি দেখে দাদা তার পিতাকে তৎক্ষনাৎ বিয়ের ব্যাপারে হ্যাঁ বলতে বলে। শিক্ষিত ছেলের সিদ্ধান্তের উপর তার পিতার ফজল মিঞার ভরশা ছিল। ঐ মাসেই দাদা ও দাদির বিয়ে সম্পন্ন হয়।

অবাক হবার মত হলেও সত্য যে সেই চল্লিশের দশকে দাদা দাদির বিয়েতে কোন যৌতুকের ব্যাপার ছিল না। বরং দেনমোহরের টাকা দাদা বিয়ের আগেই পরিশোধ করে এবং সেই টাকা দিয়েই হাফেজ সাহেব বিয়ের অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করেন। বিয়ের পর কিছুদিন দাদি নোয়াখালিতে থাকলেও, পরে দাদা দাদিকে কলকাতা শহরে নিয়ে যায়। এরই মাঝে রুনুর ও বিয়ে হয় এবং সেও স্বামীর সাথে কলকাতা পৌছে। শুরু হয়, দাদা-দাদির নতুন সংসার।

এরই মাঝে দাদা বদলি হয় বিহার প্রদেশে, খাদ্য কর্মকর্তা হিসেবে। সেখানে দাদি একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। বিহারীদের সাথে বাঙালি দাদা দাদির মিল হত না। ফলশ্রুতিতে, দাদা আবার বদলি নিয়ে কলকাতা চলে আসে। রুনুও তখন কলকাতা থাকত।

সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালীন। ঐ সময় স্বদেশী আন্দোলনও প্রায় তুঙ্গে। দাদা দাদি এক সমবায় সমিতির অফিসের পাশে দুইটি রুম ভাড়া নিয়ে থাকত। মূলতঃ সমবায় সমিতি ছিল, আন্দোলনকারিদের একটি ছদ্ম সংগঠন। কিন্তু, বৃটিশ সরকার ধরপাকড় শুরু করলে তারা দাদার কাছে পুরো অফিসটি মাত্র নাম মাত্র মুল্যে ভাড়া দিয়ে চলে যায়।

দাদা অফিসে চলে গেলে কিছুদিনের মধ্যেই দাদি অফিসের দুইটি রুমে হাস মুরগি পালন শুরু করে। সমিতির উঠানে শুরু করে, বিভিন্ন শাকের চাষ। দাদি মাঝে মাঝে সেগুলো বিক্রিও করত, যদিও ঘরের মহিলাদের ব্যবসার সাথে কোন ভাবে জড়িত থাকা দাদার সম্পূর্ণ অপছন্দের। তবুও, দাদাকে না জানিয়ে দাদি প্রায়ই একটি ছোট ছেলেকে দিয়ে শাক, মুরগি, ডিম প্রভৃতি বাজারে বিক্রি করাত। এদিকে সমগ্র ভারত ব্যাপি তখন পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে।

কলকাতার বিভিন্ন স্থানে প্রায়ই হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার খবর আসত। এ সময় দাদা সিদ্ধান্ত নেয় দাদিকে পূর্ববঙ্গের নোয়াখালিতে পাঠিয়ে দেবে। একদিন, দাদা দাদিকে ঠিকই নোয়াখালিতে পাঠায়। কিন্তু, চাকরির জন্য সে থেকে যায় কলকাতা। দাদি নোয়াখালিতে তার শশুর বাড়িতেই থাকা শুরু করে।

এর পরে সে আর কখনও কলকাতা যায় নি। যদিও কলকাতার কথা গুলো তার সারাজীবন মনে ছিল। আমার সাথে প্রায়ই ঐ দিন গুলোর গল্প করত। তার সব থেকে স্মৃতিময় গল্প ছিল বাসে চড়ার গল্প। কলকাতায় তখন প্রথম বাস সার্ভিস চালু হয় (দাদির মতে, বাস্তবে কখন হয়েছিল জানি না)।

দাদাকে না জানিয়ে দাদি ও রুনু তাদের সন্তানদের নিয়ে সেই বাসে চড়তে যায়। সেদিন বাসটা নাকি, নানা রকম মালাদিয়ে সাঁজানো ছিল। অসংখ্য বার আমার কাছে দাদি সেই বাসে চড়ার গল্প বলেছিল। এদিকে কলকাতায় দাঙ্গা ছড়িয়ে পরায় দাদার পক্ষেও আর কলকাতায় থাকা সম্ভব ছিল না। সেও পূর্ববঙ্গের পথে রওয়ান হল।

পথে হিন্দুরা আক্রমন করে, চেহারা সুরতে, চলন বলনে খাটি মুসলমান দাদা পক্ষে সে যাত্রা রক্ষা পাওয়া হয়ত সম্ভব হত না। যাত্রার সঙ্গী ছিল কিছু পরিচিত হিন্দু। ওরা দাদাকে পৈতা পরায় এবং হিন্দু ও তাদের আত্মীয় পরিচয়ে পূর্ব বঙ্গ পৌছে দেয়। এরপরেই শুরু হয় দাদা দাদির সংসারের নতুন পর্ব। (একটি অখ্যাত জীবনী -০২ )


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.