১লা জানুয়ারী ২০০১৷ এদিন বাংলাদেশে ঘটলো এক যুগান্তকারী ঘটনা ৷ ফতোয়াবাজির বিরুদ্ধে ঘোষিত হলো হাইকোর্টের রায় ৷ বিচারপতি গোলাম রব্বানী এবং বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা তাঁদের বিজ্ঞ রায়ে ফতোয়াবাজির স্বরূপ উন্মোচন করে নারী নির্যাতন ও গণবিরোধী এই প্রক্রিয়াকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন ৷ যদিও এই রায় এখন উচ্চতর আদালতের আপিল বিভাগে পুনর্বিচারাধীন, তবু অল্পকিছু স্বার্থান্বেষী ছাড়া দেশের শিক্ষিত সমাজ এবং সর্বস্তরের মানুষের কাছে তা অভিনন্দিত হয়েছে ৷
মাননীয় বিচারকদ্বয় মূল রায় ঘোষণার আগে বিগত একদশকে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত ফতোয়াবাজির মাধ্যমে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা উল্লেখ করে এই মর্মে ব্যাখ্যা দিয়েছিন যে, ফতোয়াবাজি আমাদের সমাজব্যবস্থায় পবিত্র ধর্মের নামে এক ঘৃণ্য কুসংস্কার ৷ তাঁদের এই মত সত্যভিত্তিক ৷
ইসলামী জীবনদর্শনের আলোকে আধ্যাত্মিক জীবন পরিচালনায় সঠিক ব্যাখ্যা এবং সত্যাসত্য নির্ধারণে ফতোয়া প্রদানের গুরুত্ব থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে ফতোয়াবাজি ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে ক্রিয়াশীল ৷ অন্তত সাম্প্রতিককালে এদেশে ফতোয়াবাজির স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে এই সত্য পরিলক্ষিত হয় ৷ ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলাম ধর্মের সূচনালগ্নে যখন আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, সাংবিধানিক বিধি এবং আইন ও বিচার বিভাগের অস্তিত্ব ছিল না তখন ফতোয়াই ছিল মুসলিম সমাজ-জীবনের মূল নিয়ন্ত্রক ৷
তখন ফতোয়া (রায় বা মতামত) প্রদান করতেন সর্বজনস্বীকৃত বিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ ইসলামী পণ্ডিতবর্গ ৷ কিন্তু আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় স্বাধীন সার্বভৌম আইন ও বিচারবিভাগই যেখানে ইহলৌকিক সমাজজীবনের নিয়ন্ত্রক, সেখানে প্রচলিত অর্থে ইহজাগতিক ক্রিয়াকর্মে ধর্মভিত্তিক রায় গৌণ ৷ তাছাড়া লক্ষ্য করা যায়, ব্যক্তিভেদে ধর্মভিত্তিক রায় প্রায়শই বহুমাত্রিক এবং পরস্পরবিরোধী ৷
সামপ্রতিক-কালে এদেশে স্বল্প ধর্মীয় শিক্ষা, অমানবিক অনুদার দৃষ্টিভঙ্গী, যুক্তিহীনতা এবং সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে ধর্মভিত্তিক রায়-প্রদানকারীরা সমস্যাপূর্ণ কোন বিষয়ে কখনও একমত হতে পারেন না ৷
আধুনিক আইন এবং বিচারব্যবস্থাতেও মাননীয় বিচারকগণের মধ্যে যে মতানৈক্য হয় না এমন নয়৷ একারণে বিভক্তরায়ের বিধানে গ্রহণযোগ্য এবং সেই মতানৈক্যপূর্ণ বিভক্ত রায়ের নিষ্পত্তিকল্পে উচ্চতম আদালতের দ্বারস্থও হতে হয় ৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার রায়ই এর প্রমাণ ৷ কিন্তু ধর্মভিত্তিক রায়ে ব্যক্তিভেদে মতানৈক্য, বহুধাবিভক্ত সিদ্ধান্ত ও পরস্পর বিরোধিতা বহুলাংশে যুক্তিহীন, অজ্ঞতাপ্রসূত, কাল্পনিক ও স্বেচ্ছাচারী ৷
সে-সব ঐকমত্যহীন বহুধা-বিভক্ত ধর্মভিত্তিক (?) রায়ে ধর্মীয় অনুশাসনের যুক্তির চেয়ে স্বেচ্ছাচারিতা এবং গোষ্ঠীস্বার্থ হাসিলের প্রবণতাই প্রবল ৷ উদাহরণ হিসেবে ঈদের আলিঙ্গন নিয়ে অতিসামপ্রতিককালে ফতোয়াবাজির কথা উল্লেখ করা যায় ৷
বগুড়া জেলার আদমদিঘি থেকে একজন সংবাদদাতা জানিয়েছেন : ঈদের জামাতের পর কোলাকুলি সংক্রান্ত দু-ধরনের নতুন ফতোয়া নিয়ে সাধারণ মুসলি্লরা পড়েছে বিপাকে ৷ চিরাচরিত নিয়ম হিসেবে ঈদগাহ্ মাঠে ও বাইরে তিনবার কোলাকুলি করা হয় ৷ কিন্তু এবার সান্তাহার কলেজ মাঠে পেশ ইমাম বলেছেন, তিন বার কোলাকুলি নয়, এখন থেকে একবার কোলাকুলি করতে হবে এবং এটাই প্রকৃত সুন্নত ৷ আবার সান্তাহার হাইওয়ে ওয়ার্কসপ মসজিদের মাঠে পেশ ঈমাম আবদুস সালাম নুরী নতুন ফতোয়া দিয়ে বলেন, 'ঈদের জামাতের পর নয়, কোরবানির পশু জবেহ করার পর কোলাকুলি করতে হবে ৷' (সংবাদ ১১ মার্চ ২০০১)
আরেকজন সংবাদদাতা জানিয়েছেন : ঈদে কোলাকুলি নাজায়েজ ৷ এই ফতোয়া দিয়েছে উখিয়ার কাতারী হুজুর ৷ কক্সবাজার জেলার উখিয়া থানার... সোলতানিয়া আজিজুল হক মাদ্রাসার শিক্ষক আমীর হোসেন কাতারী ঈদের নামাজের পরে একের সঙ্গে অন্যের কোলাকুলি করাকে ইসলামের চোখে সম্পূর্ণ নাজায়েজ বলে ফতোয়া দিয়েছেন ৷ (আজকের কাগজ, ১৪ মার্চ ২০০১)
বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু ৷ এরকম পরস্পরবিরোধী ফতোয়া এদেশের সরলপ্রাণ সাধারণ মানুষকে শুধু সংশয়ান্বিতই করে না, নিষিদ্ধ কর্মের (!) ফলে পাপবোধের (!) আশঙ্কায় আতঙ্কিতও করে ৷ শুধু তাই নয়; এই ধরনের পরস্পরবিরোধী ফতোয়ার কারণে ধর্মভীরু সাধারণ মানুষ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে তথাকথিত হুজুরের নির্দেশে মরণপণ লড়াইয়ে মত্ত হয়ে পড়ে ৷ ফলে খুন-জখম হয়, ধর্মীয় উন্মাদনায় ৷ তারপর মামলা-মোকদ্দমায় জড়ায় ৷ সমাজের শান্তি বিনষ্ট হয়, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে ৷
ফতোয়ার ফলশ্রুতিতে তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনায় বহু রক্তক্ষয়ের বিষাদময় চিত্র আমাদের পূর্বাপর সামাজিক ইতিহাসের অন্যতম অনুষঙ্গ এবং লক্ষণীয় উপাদান ৷
কিন্তু প্রশ্ন হলো এরকম ফতোয়ার পেছনে কি কোন ধর্মশাস্ত্রগত ভিত্তি আছে? পবিত্র কোরান-হাদিস বা শরিয়তে কি ঈদের আলিঙ্গন করা না-করার ব্যাপারে কোন বিধি-বিধান রয়েছে? যদি থেকে থাকে তবে এদেশে ইসলাম প্রচারের সুদীর্ঘ আট'শ বছরের মধ্যে এরকম বিধিবিধানের কথা কখনও শোনা গেল না কেন? যে পেশ ঈমামদ্বয় পরস্পরবিরোধী ফতোয়া দিয়েছেন, তাঁরা কিন্তু ঈদের আলিঙ্গন সিদ্ধ-নিষিদ্ধ বা একবার-তিনবার নিয়ে ইসলামী বিধি-বিধানের কোন সূত্র উল্লেখ করেন নি ৷
ওঁদের চেয়ে বহুগুণ জ্ঞানী-গুণী ইসলামবোদ্ধা এবং ইসলামী জীবনাচরণ ব্যাখ্যা দানে বিশেষজ্ঞ একালেও বাংলাদেশে নিতান্ত কম নেই ৷ তবু ঐসব ক্ষুদে ইমাম ও বামন বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকেই আমাদের জানতে হচ্ছে ইসলামী জীবনাচরণের টীকা ও ভাষ্য ৷
আসলে মৌলবাদী রাজনীতির অনুষঙ্গ ফতোয়াবাজির মূল কথা হলো : এর দ্বারা তারা বাঙালী সংস্কৃতিকেই আক্রমণ করতে চায় ৷ ধ্বংস করতে চায় বাঙালীর হাজার বছরের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র ও সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির সোপানগুলোকে৷ বাঙালীর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যে অপতত্পরতা আমরা লক্ষ্য করেছি পাকিস্তানী শাসনের চবি্বশ বছরব্যাপী, সেই প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রেতাত্মারা এখনও তত্পর 'জগতের আনন্দ-যজ্ঞে' মিলনমুখী বাঙালীর ঐতিহ্যময় সামপ্রদায়িক সমপ্রীতিতে বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টায়৷ আফগানিস্তানের তালেবানরা যেমন পবিত্র ইসলাম ধর্মের নামে ফতোয়া দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নিদর্শন পুরাকীর্তিগুলোকে, তেমনি বাংলাদেশেও তাদের দোসররা বিলুপ্ত করতে চাচ্ছে বাঙালীর মর্মগত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ৷
তবে পার্থক্য এই যে, আফগান তালেবানরা রাষ্ট্রযন্ত্রের ধারক হওয়ার কারণে (এখন নেই) ওদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিধ্বংসী কুক্রিয়া অক্ষিগোচর ও সরব ৷ আর বাংলাদেশী তালেবানরা এখনও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু সম্পূর্ণরূপে স্পর্শ করতে পারেনি বলে এদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিধ্বংসী অপকর্ম নীরব এবং মনোগত ৷
চলবে.......
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।