লেখক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
আগের পর্ব
এই সিরিজ শুরু করার একটা ঐতিহাসিক শানে নুযুল আছে। গত বছর আগস্টে লেবানন প্রসঙ্গে অরূপ-সাদিকের বচসা থেকে মাথায় আসে। ইতিহাস, বিশেষত গণ সংগ্রামের ইতিহাস কি সত্যিই অবান্তর? ঔপনিবেশিক শোষনের বিরুদ্ধে জনগনের সংগ্রাম কি ঐতিহাসিক সিগনিফিকেন্স হারিয়েছে? আজকের ফাটকাবাজীর উন্নয়ন তত্ত্বগুলো কি মুহুর্তের ইশারায় ইতিহাসের দগদগে ঘা গুলো শুকিয়ে ফেলতে পারে? ইতিহাস কতিপয় বিচ্ছিন্ন ঘটনার নিরাসক্ত সমাবেশ হলে সমাজবিজ্ঞানে প্রাক্সিসের মাজেজা কি? কোন উপাদান ব্যবহার করে? ইতিহাসের রেফারেন্স অস্বীকার করে কিভাবে "উপাদান"কে "উপাদান" হিসেবে চেনা যায়? ইতিহাসের ব্যাখ্যাকে সুনির্দিষ্ট অবস্থানের রাজনৈতিক স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত করার বিষয়টা ঠিকাছে। তাতে গণযুদ্ধের সমর্থকরা বরং শক্তিশালীই হয়। নিরপেক্ষ ইন্টারপ্রিটেশানের অস্তিত্ব অস্বীকার করতেই শ্রেণীর প্রসঙ্গ আসে।
সুতরাং রাজনৈতিক অবস্থানের অভিযোগ কোন অভিযোগ নয়, তথ্য। সেখানে ১৯৭১ এ গ্রামবাসী যখন শান্তি কমিটি সদস্যের চোখ ট্যাটা দিয়ে তুলে ফেলেন সেটা ইতিহাসে রাজনৈতিকভাবে বিজয়ী পক্ষের ব্যাখ্যাতেই স্থান পায়। সেখানে তেমন কোন সমস্যা নেই। গত অন্তত শ'দেড়েক বছরে উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রামে সবচাইতে সক্রিয় ছিলেন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। প্রতিষ্ঠান তাকে অনবরত ম্যানিপুলেট করেছে।
গণসংগ্রামের লিখিত ইতিহাসে তাই বর্ণহিন্দুদের উল্লেখ কৃষক বিদ্রোহের তুলনায় বেশী থাকে। স্বাধীন ভারতের ইতিহাস লেখক চতুরতার সাথে সার্চ লাইট ফেলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রাতিষ্ঠনিক বিকাশের উপর।
১৯৪৭ পরবর্তী পাকিস্তান শুরু থেকেই ফ্যাসিস্টদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় পুঁথিপত্র তাদের কাছে অবান্তর বিষয়। তারা অশিক্ষা এবং কুপমন্ডুকতাকে ইসলামের গ্লোরি হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। সাম্প্রদায়িকতা ছিল তাদের রাজনীতির একমাত্র পুঁজি।
লিখিত ইতিহাস দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা প্রমাণ করা যায় না। সুতরাং শুরু থেকেই তাদের অবস্থান ইতিহাস বিরোধী ছিল। বর্ণাশ্রম থেকে মুক্তি পেতে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ইসলাম গ্রহণ কোন অবস্থাতেই মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ র তথাকথিত দ্বিজাতিতত্ত্বকে হালাল করে না। কারণ জিন্নাহর সমর্থনের ভিত্তি ছিল মুসলমান জমিদাররা, যারা কার্যত বর্ণহিন্দুদের ব্যবসার অংশীদার ছিল। সবচাইতে বড় কথা ১৯৪৬ এর সাম্প্রদয়িক দাঙ্গার সময় পূর্ব বঙ্গের হিন্দু জমিদারদের সম্পত্তি দখল দরিদ্র বা ভুমিহীন কৃষকরা করেনি।
তারা সেটা সমর্থনও করেন নি। কোন একটা হত্যাকান্ডে নিরীহ কৃষকদের অংশগ্রহণ ছিল না। পুরো ঘটনাটাই ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে ঘটানো। ১৯৪৭ এ পূর্ব আর পশ্চিমবাংলার মাঝের দেওয়াল শুধুমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া মাড়োয়াড়ি আর আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ "রমজান"দের চোরাকারবারীর স্বার্থ উদ্ধার করেছে। শ্রেণী সংগ্রামের নির্দেশনা ছিল তার ঠিক বিপরীতে।
পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধগুলো এসেছিল সেই ডিরেকশান থেকেই যারা সক্রিয়ভাবে ১৯৪৬ এর দাঙ্গার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। জমিদারী প্রথা অফিসিয়ালী উঠে গেলে ১৯৪৬ এর দাঙ্গার বেনিফিশিয়ারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতা পাবার পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়। বিপরীতের সংগ্রাম ঠেকাতে সিপিআই এর ঐতিহাসিক বিভ্রান্তির সুযোগে আবারো প্রতিষ্ঠাণ প্রভাবিত প্লাটফর্ম জন্ম নেয়। তবে পাকিস্থান আমলের রাজনৈতিক সংগ্রামের খুব উল্লেখযোগ্য একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কখনোই শ্রেণী সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়া। এই প্রবণতার প্রভাবই মার্কিনপন্থী আওয়ামী লীগকে শেষ পর্যন্ত অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারস্থ হতে বাধ্য করে।
১৯৬৬তে পার্টি ভেঙে গেলে লাভবান হয় শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ। যার প্রমাণ হচ্ছে ১৯৭০ এর নির্বাচনে ১৯৬৮-৬৯ এ নিহত গরুচোরদের আওয়ামী ঘোমটা পড়ে পীঠ বাঁচানো।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এই পীঠ বাঁচানোরাই শান্তি কমিটিতে যোগদেয়। ১৯৭১ এর মার্চ থেকে ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে(পাকিস্থানের পক্ষে) সক্রিয় অবস্থানকারীদের সকলেই ব্যতিক্রমহীনভাবে দ্বিজাতিতত্ত্বের বেনিফিসিয়ারী জোতদার-মহাজনদের শ্রেণীভুক্ত। যারা ১৯৭২ সালে অতিদ্রুত আওয়ামী লীগে যোগদান করে নিজেদের পীঠ বাঁচান।
(অনেক জোতদার বা তাদের ছেলেপুলেরা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বলে দাবী উঠতে পারে কিন্তু তাদের সংখ্যা কৃষক-শ্রমিক-ছাত্রদের অনুপাতে নগন্য। ) পুরো যুদ্ধের সময় জুড়ে আওয়ামী নেতৃত্বের একাংশের মাথা ব্যাথা ছিল কিভাবে মুক্তিবাহিনিতে বামপন্থীদের যোগদান ঠেকানো যায়। মুজিব বাহিনির জন্মের প্রেক্ষাপট সেটাই।
শেখ মুজিবের আমলে রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত জোতদারদেরই জয়ী করে, যে কারণে তাজউদ্দিন আহমেদকে মন্ত্রীসভা থেকে বিতাড়ন করা হয়। জোতদারদের বিজয়কে স্থায়ী করতে ঘটে ১৫ আগস্টের সামরিক অভূত্থান।
শেষ মুজিবের আমলে ঢালাও জাতীয়করণের মাধ্যমে কলকারখানাকে অকার্যকর করা এবং জিয়ার আমলে লোহালক্করের দামে বিকিয়ে দেওয়ার বেনিফিসিয়ারী সেই জোতদার মহাজনরা যারা সেই ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষ থেকে যাবতীয় রাজনৈতিক ফেনোমেনার বেনিফিসিয়ারী। শুধুমাত্র ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় টুকুতে তারা কার্যকর প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। এর বাইরে তারা বাকি সবকিছুতেই শক্তিশালী হয়েছে, হচ্ছে।
"উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম" নামের পরিভাষাকে মেনে নিলে অটোমেটিক্যালি আলোচনা "ওয়ার্লড সিস্টেম থিওরি" বিরোধী অবস্থানে চলে যায়। সেক্ষেত্রে "ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাপিট্যালিজম" এর অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়।
যার অর্থ যেকোন সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণ পুঁজির কেন্দ্রীভবনের সাথে জড়িত। সেক্ষেত্রে সব্চাইতে বেশী গণবিরোধী অবস্থানে পড়েন সামরিক-আমলাতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠী। আর তাদের সহায়ক হিসেবে ব্যতিক্রমহীনভাবে অঞ্চলভেদে ধর্ম অথবা জাতীয়তাবাদ ব্যবহারকারী ফ্যাসিস্ট চক্র।
এই ফ্যাসিস্ট চক্রকে সাম্রাজ্যবাদ সরাসরি অর্থ এবং অস্ত্রানুকুল্য দিয়ে গড়ে তুলেছে প্রতিবাদকারী জবাই এর উদ্দেশ্যে। সুতরাং সাম্রাজ্যবাদের বহুমুখী প্রচারকদের মধ্যে এই সংগঠিত সশস্ত্র চক্রটিই প্রধাণ।
এদের বিরোধীতার ক্ষেত্রে যার অবস্থান যতটা সক্রিয় তার ভিত্তিতেই প্রতিরোধের চৈতন্যগত অবস্থান নির্ধরিত হয় এবং হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।