অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা
আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন বেসরকারী টিভি চ্যানেলের এক সাংবাদিক, বেশ পরিচিত মুখ, সাংবাদিক হিসেবেও বেশ মানবিক- তার স্ত্রী এবং পুত্র নিয়ে ছোটো সংসার - প্রতিবেশী বলেই তাদের জীবনযাপনের কতিপয় দৃশ্য আমাদের চোখে পড়তো প্রতিদিন- গুরুজনেরা বলে গেছেন চোখ কান খোলা রাখতে, সে উপদেশ সচেতন ভাবে মানতে না চাইলেও অভ্যাসে পরিণত হয়েছে সেটা এখন।
তার গৃহীনি সুবেশী মহিলা এবং তার সন্তান মিলে এই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি, ঢাকা শহরের ফ্ল্যাট বাড়ী সংস্কৃতিতে প্রতিবেশী হিসেবে যতটুকু সৌহার্দ সম্ভব ততটুকু শালীনতা মেনেই পারস্পরিক সম্পর্ক জিইয়ে রাখা, দেখা হলে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ভালো আছেন? সব ঠিক আছে? আসবের বেশী আসলেই আলোচনা আগায় না-
ঢাকা শহর থেকে সবুজ আর ফাঁকা জমি নির্বাসিত- সব কিছু দমিয়ে তেঁড়ে ফুড়ে উঠে যাচ্ছে বহুতলা এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স, সেখানের ৫ বাই ৩ বারান্দা আর ১২ বাই ১০ এর ড্রইংএ শিশুরা কতটুকু চঞ্চল হতে পারে? তবে সাংবাদইক সাহেবের গৃহীনি কড়া ধাতের মাল। ছেলেকে সুবোধ ও সুশীল বানাতে চাইছেন।
ছেলেটার বয়েস যখন ২ বছরের মতো তখন আমরা এই বাসায় এসে উঠি- তখন থেকেই তাকে নিয়মানুবর্তী করে গড়ে তোলার চেষ্টা , তার নির্ধারিত সময়ে খাওয়া, নির্ধারিত সময়ে খেলা, নির্দিষ্ট একটা অঞ্চল দৌরাত্বপনার জন্য , এবং এর পরে আছে আরও নানা রকম নিয়মের বাহার।
তবে মহিলা মাইরের উপর ঔষধ নাই এই মতাদর্শে বিশ্বাসী- এ কারণেই নিয়মের বরখেলাপ হলেই কুমির মাতা তত্ত্বাবধায়ক সরকার হয়ে উঠেন।
২ বছরের বাচ্চার বোধ কতটুকু আমি জানি না- তবে তাকে নিয়মিত পেটানো হয় নিয়ম ভাঙার অভিযোগে- প্রতিবেশীসুলভ কৌতুহল বা সহমর্মিতা দেখানোর সুযোগ নেই এই বদ্ধ সংস্কৃতিতে।
এগিয়ে যেতে চাইলেও দ্বিধা- তাদের সন্তান- তারা যেভাবে ভালো মনে করবে সেভাবেই বড় করবে- ওটা তাদের মুরগি তারা গলা দিয়ে কাটুক আর ল্যাজ দিয়ে- আমাদের কি? আমাদের আসলেই বলবার কিছু নেই। তাই এর পরও সাংবাদিক সাহেবের সাথে দেখা হয়- সৌহার্দ বিনিময় হয় তবে বলা হয় না যে জনাব আপনার শিশুকে এভাবে পিটায়েন না- সম্পর্কের গভীরতা এমন নয় যে তাকে এসব কথা বলা যায়।
সময় গড়ায় ছেলেটার বয়েস বাড়ে- অসহায়সিঁড়ির মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে শিশুটার কান্না আর বিলাপ শুনে বিষন্ন হওয়া, কখনও নিস্পৃহ বোধ করা কখনও গভীর দুঃখবোধ থেকে উদাস সিগারেট ধরিয়ে পায়চারি করা-
আমার কৃতকর্ম এর বেশী আগাতে পারে নি- নিজেকে অসহায় লাগলেও যেহেতু কোনো ইশ্বরের দ্বারে নত হতে পারি না তাই ঠোঁট কামড়ে থাকি- ঠোঁট ফুটে প্রার্থনাও আসে না- শিশুটাকে নির্যাতনের মানসিক সমস্যা কাটিয়ে উঠুক সাংবাদিক গৃহীনি- আমাকে যেনো সিঁড়ির মাঝপথে দাঁড়িয়ে এই বিলাপ শুনতে না হয়-
মা আর মেরো না- আমি ভালো হয়ে থাকবো- মা প্লীজ মা প্লীজ- এবং থাপ্পড়ের শব্দে শিউরে উঠবো না- এইটুকু কামনা করতে পারি।
বরং হাঁফ ছেড়ে বাঁছলাম যখন আমাদের বাসা ছেড়ে কয়ে কবাসা পরেই তারা হিজরত করলো- মর্মবেদনা থেকে পরিতৃপ্তি- অমানবিক দৃশ্যের মর্মান্তিকতা আমাদের ততক্ষণই কষ্ট দেয় যতক্ষণ সেটা চোখের সামনে পর্দার মতো ঝুলে থাকে- এই দৃশ্য উবে গেলেই আমাদের ভেতরে সাময়িক স্বস্তিবোধ জাগে- এমনই সস্তি নিয়েই দিন কাটছিলো।
ঢাকার বর্ষা মর্মান্তিক- যেখানে থাকি সিটি কর্পোরেশনের নির্দেশে সেখানের জল ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যাবস্থা উন্নত করবার টেন্ডার হয়েছে- রাস্তা খুঁড়ে ড্রেন বানানো হয়েছে- তবে ফলাফল হয়েছে ভয়াবহ- আগে এখানে পানি জমতো না- তবে এখন সামান্য বৃষ্টিতেই এক হাঁটু পানি জমে যায়-
এমনই এক আষাঢ়ের দিনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম এই বর্ষায় একটা নৌকা কিনে ফেলতে হবে- গলি থেকে বড় রাস্তা পনিতে ছয়লাব- দুরে একটা রিকশা আসছে- তৃষ্ণার্ত কাকের মতো সেদিকে তাকিয়ে থাকি-
রিকশা থামলো, জাঁদরেল সাংবাদিক পত্নী এবং তাদের সন্তান রিকশায়- ছেলেটা কোনো এক স্কুলে ভর্তি হয়েছে- পরনে স্কুলের পোশাক- মহিলা যথারীতি পরিপাটি বেশবাসে সন্তানকে রিকশা থেকে নামাচ্ছেন- মহিলার অন্য হাতে রিপোর্ট কার্ড- ঢাকা শহরের স্কুলগুলোতে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শেষ- শিশুটা বৃষ্টির ভেতরে শক্ত হয়ে ঘাড় ঘোঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে- মহিলা বললেন চলো ভেতরে চলো-
ছেলেটার চোখের কোণে মেঘ জমে- ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলছে মা আগে বলো তুমি মারবে না-
আগে বাসায় চলো-
প্লীজ মা মনি তুমি রাগ করো না-
আগে বাসায় চলো- মহিলা শিশুর হাত ধরে টানছেন-
আর হবে না মা- অংক আর ভুল হবে না- আমি প্রমিজ করতেছি-
তুমি আগে বাসায় চলো
প্লীজ লক্ষী মামনি তুমি রাগ করিও না- বাসায় নিয়ে মারবে না বলো-
সাংবাদিক পত্নি ছেলেটার হাত ধরে টানছেন- ছেলেটা মায়ের হাত ধরে ঝুলে আছে
হঠাৎ ফিতে আটকে যাওয়া ক্যাসেট প্লেয়ারের মতো একটানা আগে বাসায় চলো শব্দটার সাথে ছেলেটার মুখভঙ্গী একটা করুন হাস্যরসের সম্ভবনা জাগায়- তবে মহিলার শক্ত চোখমুখ- ছেলেটার মিনতি আর আষাঢ়ের বর্ষা- অনেক দিন পরে এমন একটা মর্মান্তিক দৃশ্যের মুখোমুখি হয়ে অসহায় লাগে-
ধুশ শালা বলে ক্ষণিক দেখা দৃশ্যটাকে স্মৃতি থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাই-এবং পালানোর তীব্র তাগিদ থেকে পানি ভেঙে সামনে আগাই-
অবশ্য স্মৃতি থেকে মুছে যাওনা কোনো ভাবেই দৃশ্যটা- বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ভেজা চোখ মুছলাম- আমার কি যায় আসে? শালার সাংবাদিকের বাচ্চা সাংবাদিকের বৌ মানুষ করতেছে- তাদের পারিবারিক অমানবিকতা নিয়ে আমার কষ্ট পাওয়ার কি আছে? আমার সামর্থ্যই বা কতটুকু? এমন নির্যাতিত শিশুদের সব পীড়ন আমি পিঠ পেতে নিতে পারি না- পারবোও না- বরং এই ভেবে একটু ভালো লাগতে পারে সমাজটা এমনই- এখনও সামজে এমন অনেক বর্বর বাস করে-
শিশু নির্যাতনে শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয় হয়তোবা তবে এসব দৃশ্য দেখে সাধারন মানুষেরও মানসিক বিপর্যয় ঘটে-
সামাজিক বোধ নামের ইন্দ্রিয়বোধহীন চামড়া চাপিয়ে ঘুরি তাই স্পষ্ট বলতে পারি না খানকি মাগী বাচ্চাকে মারতেছিস ক্যান- তুমি চুতমারানি কোনো দিন কোনো অংক ভুল না কইরাই পোয়াতি হইয়া গেছো শালা হারামজাদী-
তবে বলতে পারি না মুখের উপরে ভেতরে আগুন নিয়ে বৃষ্টিতে হাঁটি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।