আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রক্তিম ধূসরতা (পর্ব-২)

ছায়া ছায়ায় পথ হেটে চলি--ছায়া আমার সামনে ও পিছে।

প্রথম পর্ব ‍রমা, তুমি ফিরে এসো। তোমার দুঃশ্চিন্তায় তোমার মা শয্যাসায়ী থেকে এখন কবরসায়ীর পথে। শুধু কবরে নামানো বাকি। তোমার ছোট ভাইও তোমার মতো পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

তোমার বোন তোমার রুম দখল করে ফেলেছে। তার ধারণা তুমি আর ফিরে আসবেনা। আমি চাই তুমি ফিরে এসে সবার সব স্বপ্ন ভেঙ্গে দাও। ইতি তোমার বাবা পর্ব দুই এর শুরু এখানে... রীপু মেয়েটা অসাধারণ। পড়ছে বুয়েটে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে লেভেল-ওয়ান, টার্ম-টুতে।

রমার সাথে রীপুর পরিচয়টাও বলা যায় একটা দূর্ঘটনা। রমা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে সবেমাত্র সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। শুরু থেকেই তার পদার্থ বিজ্ঞানের প্রতি একটা ঝোক ছিল। তার থিউরি অনুসারে পদার্থ বিজ্ঞান হলো এমনি একটি বিষয় যার উদ্ভাবকদের অধিকাংশই ছিল একটু পাগলাটে ধরনের। এমনই এক পদার্থ বিজ্ঞানী হলো আইনস্টাইন।

তার অনেক উদ্ভাবণের মধ্যে রিলেটিভিটি বা আপেকিতা হলো একটি কালজয়ী আবিস্কার। আইনস্টাইন যখন রিলেটিভিটি থিউরি আবিষ্কার করলো তখন প্রায়ই বিভিন্ন সেমিনারে এর উপর বক্তব্য রাখতে হতো। পদার্থ বিজ্ঞানে তার এই নতুন তত্ত্ব নিয়ে বিজ্ঞান মনস্কাদের হুমরি খেয়ে পড়ার অবস্থা। তো দেখা গেল সে তার সব সেমিনারেই রিলেটিভিটির এক কথাই বলছে। ‘রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতা হলো এমন একটা বিষয়, একজন পুরুষকে যদি গরম উনুনের পাশে কিছুক্ষণের জন্যও দাঁড় করিয়ে রাখা হয় তার কাছে মনে হবে অনেক অনেক সময় ধরে এই নরকে সে দাঁড়িয়ে আছে।

আর যদি সেই মানুষটাই কোনমেয়ের পাশে হাত ধরে কিংবা আরও অন্তরঙ্গভাবে দীর্ঘ সময়ের জন্য থাকে তার কাছে মনে হবে এক পলকেই তার স্বপ্নের মুহূর্ত শেষ হয়ে গেল!’ তো একবার এমনই এক সেমিনারে বক্তব্য রাখার আগে আইনস্টাইনের গাড়ির ড্রাইভার তাকে বললো -- স্যার, আপনি তো আপেকিতা বিষয়ে সব সময় একই কথা বলছেন। এগুলোতো আমিও পারি। আমিও জানি। এই কথা শুনে আইনস্টাইন তাৎণিকভাবে ওই ড্রাইভারকে বললো --আজকে তুমি আমার জায়গায় সেমিনারে বক্তব্য রাখতে পারবে, আর আমি ড্রাইভার হয়ে গাড়ি চালাই! তো যেই কথা সেই কাজ। ড্রাইভার আইনস্টাইনের রিলেটিভিটির ওপর বক্তব্য শুরু করলো।

এবং যথারীতি ভালোভাবে শেষও করলো। বিপত্তি ঘটলো শেষ করার পর। উপস্থিত সবাই তার কাছে রিলেটিভিটির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করতে থাকে। এ অবস্থায় সবাইকেই সে একই উত্তর দিলো। -ওহহো... এটা, এটাতো আমার ড্রাইভারও জানে।

আর এদিকে ড্রাইভার মানেই তো আইনস্টাইন। সেও একের পর এক প্রশ্নের সরল উত্তর দিয়ে সবার মনের প্রশ্নের তৃষ্ণা মিটিয়ে দেয়। এমনই ছিল পদার্থ বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিজ্ঞানীরা। একটু পাগলাটে ধরনের। রমাও এমনই হতে চায়।

রমার রেজাল্টও খারাপ না। ভালোই। প্রায় প্রতিদিন বিকেলেই রমা বুয়েটের মেকানিক্যাকেল ভবনের সামনের রাস্তা ধরে হাটে। অনেক অভ্যাসের মধ্যে এটি তার একটি। রমার আরেকটি অভ্যাস হলো ক্ষুধা নেশা করা।

সারাদিন না খেয়ে এ উদ্ভট নেশা করতে হয়। অবশ্য পকেটে যখন টাকা থাকেনা তখনই সে এ নেশা করে। খালি পেটে হাটাহাটি করলে শরীরটা একটু ঝিমঝিম করে। ভারসাম্য রাখতে কষ্ট হয়। এ অবস্থায় তার হাটতে দারুণ লাগে।

নিজেকে রাজপথের রাজা মনে হয়। পকেটে টাকা নেই অথচ রাজা! ভাবতেই আনন্দ! বিকেল, তখনো সন্ধ্যা হয়নি। আলো আধারী দেখে বোঝার উপায় নাই এখন কি সকাল না কী সন্ধ্যা। রমার এমন অনেক হয়েছে দুপুরে ঘুমিয়ে জেগে উঠে বুঝতেই পারছেনা তখন সন্ধ্যা না পরদিন সকাল। ঝাপসা আলোয় রমা দেখতে পায় একটা মেয়ে একা একা বসে আছে।

একটু দূর থেকেই মেয়েটাকে সে দেখছিল। মেয়েটা হাতে বই নিয়ে বসে আছে। হয়তো কিছু ভাবছে। আনমনে। খুব অসহায় মনে হচ্ছিল তাকে।

মেয়েদের প্রতি রমার কোন কালেই কোন আকর্ষন ছিল না। অথচ আজ কেমন যেন অন্যরকম মনে হচ্ছে। ক্ষুধা নেশা করলে সুখ দুঃখের স্থায়িত্ব কম হয় তা রমার জানা। অথচ আজ মনে হচ্ছে তার স্থায়িত্ব অনেক বেশি । রমা মেয়েটার কাছে গিয়ে কি কি প্রশ্ন করবে তার একটা খসরা তৈরি করে নিল।

একটু সাহস করেই মেয়েটার কাছে এগিয়ে গেল সে। --‘এক্সকিউজ মি, আপনার কাছে একটা সিগারেট হবে। ’ মেয়েটা রমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকালো। চোখে-মুখে বিরক্তির স্পস্ট ছাপ। --‘কি ব্যাপার কথা বলছেন না যে?’ এমন একটা ভাব করছেন মনে হচ্ছে ভীনগ্রহ থেকে কোন এলিয়ান এসে আপনার সাথে কিচির-মিচির করে কথা বলছে আর আপনি বুঝতে পারছেন না।

এবার মেয়েটা মুখ খুললো। --‘...ফাযলামী করার জায়গা পাননা, না?’ --মেয়েদের কাছে সিগারেট থাকে না কী? মেয়েটা যে সাহসী তা রমা প্রথমেই বুঝতে পেরেছিল। অন্য কেউ হলে ভয়ে চিৎকার শুরু করে দিত অথচ সে শুরু করছে না। এই সাহসীকতার ব্যাপারটা রমার মনে ধরেছে। --কেন, আপনার কাছে কি মনে হচ্ছে আমি ফাযলামী করছি? --আমি জিজ্ঞেস করেছি আপনার কাছে সিগারেট আছে কী না।

আপনি বললেইতো পারেন ‘আমার কাছে নেই’। তখন না হয় আমি অন্য কিছু চাইতাম! যেমন, আপনার কাছে কি একটা স্টিক হবে। স্টিক মানে বুঝেছেন তো? মানে গাঁজা। মেয়েটা এবার একটু উচু স্বরেই রমাকে ধমক দিয়ে বললো, --আমি কি গাঁজাখোর না স্মোকার যে আপনি আমার কাছে ওসব চাইছেন। মেয়েদের কাছে গাঁজা, সিগারেট চাইতে লজ্জা লাগে না? শুনেছি ঢাকায় অনেকরকম পাগল আছে।

দেখেতো তেমন মনে হচ্ছে না। রমা তখন উত্তরটা পেয়ে একটু হাসিহাসি মুখ করে মেয়েটার দিকে তাকালো। হাসির কারণটা হলো রমা যখনই কাউকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার জন্য প্রশ্ন করে তখন সেই প্রশ্ন গুলোর উত্তরগুলোও সে ভেবে নেয়। রমার খসরা প্রশ্নগুলোর যে উত্তর আশা করেছিল মেয়েটা সেটাই দিয়েছে। রমা কিছুন নিরব থাকার পর মেয়েটার পাশে বসলো।

--বললো, মেয়েদের কাছে যা থাকে তা কিন্তু তারা দিতে পারে না! যা থাকেনা তাই দিতে চায়। --যেমন ধরুন, আমি আপনার কাছে ৫০টাকা চাইলে আপনি আমাকে দিবেন না। অথচ আপনার হৃদয়ে স্থান চাইলে আপনি দিয়ে দিবেন। অবশ্য একটু অন্যরকম করে চাইতে হবে। ভিুকের মতো! --আফা, আফা গো, আফনের হৃদয়ে একটু জায়গা দিবেন, একটু - এক ইঞ্চি, না এক ইঞ্চিও না মাইক্রো ইঞ্চি।

দেন্নাগো আফা, দেন্না। একটু ঘেনর-ঘেনর, পেনর-পেনর করলেই দিয়ে দিবেন। রমার উদ্ভট কথা শুনে মেয়েটা হাসি হাসি মুখ করে রমাকে জিজ্ঞেস করে --আচ্ছা বলুন তো আপনি কে? আমি কী আপনাকে চিনি? রমার উত্তর-আমি রমা, আপনি আমাকে চেনেন না। --কি ব্যাপার এভাবে রোবটের মতো কথা বলছেন কেন? একেবারে কাট-কাট উত্তর। --আসলে আমার নেশা কেটে গেলে আমি এভাবেই কথা বলি।

এখন আমার নেশা কেটে গেছে। ভয় পাবেন না এটা অন্য রকম নেশা একমাত্র আমিই করি। ‘ুধা নেশা’। সুতরাং ... --আচ্ছা ভালো কথা, আপনার পরিচয়টাতো জানতে পারি? মানে কি করা হয়, কোথায় থাকা হয় এই সব। --আমি রমা, আগে-পিছে কিচ্ছু নাই।

শুধু রমা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে পড়ি, থাকি শহীদুল্লাহ হলে, রুম নম্বর-৩২২। তবে সবসময় থাকিনা, মাঝে-মধ্যে। এমনিতে আমার আস্তানা এয়ারপোর্ট রোডের খিলেেত। বাসা নং-ডি/ ৩৩।

এই হলো আমার ঠিকানা বৃত্তান্ত। --যদি কিছু মনে না করেন আসলেই আপনার কাছে কী ৫০টাকা হবে। সময় করে বাসা থেকে নিয়ে আসবেন। টিএ, ডিএ দেওয়া হবে। নাকি আপনি ঠিক করেছেন টাকা দিবেন না, অথচ আপনার হৃদয়ে স্থান দেবেন? বলেই হো...হো করে হেসে উঠে রমা।

রমার হাসি দেখে মেয়েটা হতচকিত হয়ে কারণটা জিজ্ঞেস করে। --ঐ যে বললাম, আপনি মেয়ে মানুষ! যা দিতে পারবেন না তাই দিতে চান। সেদিন রীপু মেয়েটা রমাকে হৃদয় দেয়নি ঠিকই তবে টাকা দিয়েছিল। সেই থেকেই রীপুর সাথে রমার পরিচয়। রমা জানতো রীপু মেয়েটা ওর বাসায় আসবে।

প্রথমে শহীদুল্লাহ হলে খোঁজ করবে, তারপর খিলেেতর আস্তানায়। কি কারণে আসবে তাও রমা জানে। তিনদিনের মাথায় রীপু ঠিকই রমার বাসায় আসে। অনেকটা কৌতুহলবশতঃ সে রমার বাসায় আসে। সে ভেবেছিল ছেলেটা তাকে ভুল ঠিকানা দিয়েছে কিংবা তার পরিচিত! কিছুদিনের মাথায় রীপুর সাথে রমার একটা সম্পর্ক হয়ে যায়।

এখন নিয়মিত সে রমার বাসায় আসা-যাওয়া করে। অবশ্য রমার বাসাটাকে বাসা বললে ভুল হবে। একটা মাত্র রুম সাথে এটাচ্ড বাথ। রুমে একটা চৌকি, কাপড় রাখার ভাঙ্গা-চুরা একটা আলনা আর বই ছাড়া কিছুই নেই। পড়ার টেবিলও নেই।

বই গুলো চৌকির উপর ছড়ানো ছিটানো। যে কেউ দেখলেই বুঝবে অনেক দিন এই বইগুলো ছোঁয়াও হয়নি। তারপরও অগোছালো বইয়ের ফাঁক দিয়ে ময়লা বেডশীটটা দেখা যাচ্ছে। বিছানার ওপর কোন বালিশ নেই। বুদ্ধিমানরা বালিশ ব্যবহার করে না।

কারণ মাথাটা একটু উচু হয়ে থাকে বলে চিন্তা-ভাবনা হয়ে যায় নিুগামী ! রমা চায় তার চিন্তা-ভাবনা সবসময়ই উর্ধ্বগামী থাকুক! অবশ্য এটা রমার নিজস্ব থিউরি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।