আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রক্তিম [ গল্প । সম্পূর্ণ ]



এক - বাম বুকে গুলিটা লাগলো । রিসাত তার দুই হাত দিয়ে ক্ষতস্থান চেপে ধরলো । তার সারা শরীর কুঁকড়ে আসছিল । আস্তে আস্তে বসে পড়লেন তিনি । হঠাৎ করে তার ঠোঁটের এক পাশে কিঞ্চিত হাসি দেখা গেলো ।

তা উক্ত জায়গায় উপস্থিত কারোরই চোখ ফাঁকি দিলো না । যেন সবাইকে দেখানোর জন্যই । রশিদ সাহেবের বুকের উপরে চাপানো পাথরটা সরে গেলো যেন আর মাথার উপরে থাকা পাহাড়টা যেন হঠাৎ করেই গলে পড়ে গেলো । শুধু তার নয় উক্ত এলাকার সবার মনে যেন আজ একটি শান্তির হাওয়া বয়ে গেলো । দুই - পুরো নাম মোহাম্মাদ রিসাত উদ্দিন ।

গনিতের উপর পড়াশোনা শেষ করে একটি প্রাইভেট স্কুলে শিক্ষকতা করেন । একা থাকেন কাটাসুরের একটি বাড়ির এক তলায় এক রুমের বাসায় । স্কুলের ক্লাস শুরু হয় সকাল আঁটটায় । রিসাত বের হয় সাড়ে সাতটায় । হেঁটে হেঁটে যান ।

স্কুল লালমাটিয়ায় । নতুন নিয়োগ হওয়ায় এখন শুধু সিক্স , সেভেন আর ক্লাস এইটের গণিত ক্লাস নেন । পরবর্তীতে নাইন টেনের ক্লাস নিতে পারবেন বলে তাকে বলা হয়েছে । স্কুলে প্রত্যেক স্যারের একটা নাম দেয় ছাত্ররা । তারও একটা নাম আছে ।

তাকে ছাত্ররা ' সিদে ' নামে ডাকে । তার চরিত্র ' সাদাসিধে ' এই জন্য প্রথম অক্ষর আর শেষের অক্ষর নিয়ে শর্টকার্টে তাকে ' সিধে ' ডাকে । বিষয়টা রিসাত জানে । তবুও না জানার ভান করে থাকে । কারণ নামটা তার ভালো লেগেছে ।

অন্যান্য স্যারদের নাম বড়ই ভয়াবহ । তিন - একদিন ছুটির দিন বাসায় বসে পেপার পড়ছিলেন । পাশের বাসার দুলাল সাহেব রুমে আসলো । '' রিসাত সাহেব কি ব্যস্ত নাকি ? '' '' না । পেপার পড়ছিলাম আর কি ।

'' '' তা একটু সাহায্য করতে পারবেন ? '' '' কেমন সাহায্য বলেন ? পারলে করে দেই । '' '' তেমন কিছু না । কিছু মুরগি কিনে এনেছি । বুয়াটা আজকে আসে নি এখনও তো দুপুরে রাঁধবে । এখন একটা একটু জবাই করতে হবে ।

গিন্নি আবার রক্ত ভয় পায় । না হলে আপনাকে বিরক্ত করতে আসতাম না । '' '' বাজার থেকে কেটে আনলেই পারতেন । '' '' ওরা কীভাবে না কীভাবে কাটে । মনের ভিতর খুত খুত থেকেই যায় ।

এই জন্য বাসায় করি । কি পারবেন ? '' '' চলেন । '' '' ধন্যবাদ । '' মুরগি ধরার দায়িত্ব পড়লো রিসাত সাহেবের উপর । দুলাল সাহেব যখন ছুরি মুরগির গলার উপর দিয়ে চালিয়ে দিলেন ।

তখন মুরগির গলা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো । সাথে ছিল একটি ঘ্রাণ । রিসাত সাহেব রক্তের প্রবাহ দেখতে থাকলেন । আর এমন একটা ঘ্রাণ তিনি নাকে পেলেন যেটি এর আগে কোনদিন তিনি পান নি । ঐ ঘটনার পর তিনি প্রায়ই টাওন হলের বাজারে যেতেন যেখানে মুরগি , হাঁস জবাই করা হয় ।

ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হওয়া দেখতেন । আর সেই ঘ্রাণ নিতেন । এক পর্যায়ে এটি নেশা হয়ে গেলো । এই রকম দৃশ্য না দেখলে আর ঐ ঘ্রাণ না নিলে তিনি স্বাভাবিক থাকতে পারতেন না । আর একটা জিনিসের নেশা এক পর্যায়ে তার তেজ হারায় ।

রিসাত সাহেবের আর ঐ দৃশ্য আর ঐ ঘ্রাণে এক পর্যায়ে পুষালো না । তিনি এরপর থেকে রাতে বের হয়ে কারওয়ান বাজারে যেতেন । যেখানে শত শত গরু জবাই করা হয় । এতে তিনি শান্তি পেলেন । রক্তের পরিমাণ ঢের বেশি ।

আর আরেক ধরনের ঘ্রাণ তিনি পেতে লাগলেন । এ যেন আলাদা অনুভূতি । এই কারণে তার ক্লাস নেয়ার উপর কোন প্রভাব পড়তে লাগলো না । তিনি স্বাভাবিকভাবেই জীবন যাপন করতে লাগলেন । তবে এই নেশাও একদিন উবে গেলো ।

আরও নতুন কিছুর সন্ধানে মন ও শরীর উভয়ই আনচান হয়ে উঠলো । তিন - খবরের কাগজ সকাল সাতটার দিকে দিয়ে যায় । চা খেতে খেতে খবরের কাগজের উপর চোখ বুলাতে থাকেন । সেদিন খবরের কাগজের প্রথম পাতায় একটি লাশের ছবি দেখলেন । ছবিটা দেখে একটি চিন্তা তার মাথায় খেলো গেলো ।

চিন্তাটা আসতেই তিনি ঘাবড়ে গেলেন । চা পুরো না খেয়ে পেপার না গুছিয়ে কোন রকম দরজা তালা দিয়ে তিনি বের হয়ে গেলেন স্কুলের জন্য । এই দিন তিনি ঠিক মতো ক্লাস নিতে পারলেন না । স্কুলের হেডমাষ্টার রতন সাহেব তাকে বললেন ,'' ছুটি তো নেন না একদিনও । টানা ক্লাস করাতে করাতে ক্লান্ত হয়ে গেছেন ।

এইবার একেবারে সাতদিনের ছুটি নেন । '' রিসাত সাহেবও সাই দিলেন । এরপর ছুটি চেয়েএকটি দরখাস্ত লিখে দিলেন । আর সাথে সাথেই অনুমদিত হয়ে গেলো । বাসায় এসে গোসল আর খাওয়া দাওয়া সেরে তিনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন ।

কিন্তু সকালের সেই চিন্তাটা তার মাথায় এসে ঘোরা ঘুরি করতে লাগলো । ভয় আর সেই কাজ করার প্রতি এক দ্বিমুখী আকর্ষণ অনুভব করলেন । প্রতিটাই প্রচুর প্রবল । এই অবস্থা আর সহ্য করা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না । তিনি আবার গোসল করার জন্য বাথরুমে গেলেন ।

অনেকক্ষণ ধরে গোসল করলেন । এই চিন্তা থেকে কিন্তু তিনি মুক্তি পান নি । ক্লান্ত হয়ে এক পর্যায়ে ভেজা শরীর নিয়েই বিছানায় তিনি শুয়ে পড়লেন । ঘুম ভাঙল রাত এগারোটার দিকে । আবার সেই চিন্তা ।

'' এখন মানুষের গলা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হওয়ার দৃশ্য দেখার পালা । সেই রক্তের ঘ্রাণ দেয়ার পালা । '' এই চিন্তা থেকে একটুর জন্য হলেও মুক্তির জন্য তিনি ব্লেড দিয়ে নিজের আঙ্গুলের উপর কেটে ফেললেন , সেই ঘ্রাণ নিয়ে মাথাকে ঠান্ডা করার জন্য । অল্প সময়ের রসদ জোগাল সেটি । কারণ পরিমাণ কম ।

শরীর আর মানতে চাইল না । পশুর মতো আচরণ শুরু করলো । একটি ছুরি পাঞ্জাবির পকেটে গুঁজে দরজা বন্ধ করে রওনা হলেন । রাস্তায় রাস্তায় হাটতে লাগলেন । তার খোঁজ একজন মানুষ শুধু আর আশে পাশে কিছুই থাকবে না ।

কিন্তু যে জায়গায় কোন গাড়ি নেই সেই জায়গায় কোন মানুষই নেই আবার যে জায়গায় আছে দুটোই আছে । মিলছে না । হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন রাত একটা বাজে । দূরে একজনকে দেখতে পেলেন তখন তিনি । শরীর যেন অনেকদিন ধরে খুদার্ত ।

এমন আচরণ করে উঠলো । আশে পাশে তেমন কিছুই নেই । এই রকম সুযোগ আর হয়তো পাওয়া যাবে না । মানুষটা কাছে আসার পড়ে বুঝা গেলো লোকটা বেশ বয়স্কই । এতো রাতে রাস্তায় কি করছে ? এরপর রিসাত সাহেব চিন্তা করলেন তাতে তার কি ? তাকে আগে তার শরীর ঠাণ্ডা করতে হবে ।

রিসাত সাহেব দৌড়ে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে লোকটাকে ফেলে দিলেন । শক্ত করে বাম হাত দিয়ে মুখটা চেপে ধরলেন আর ডান হাত দিয়ে ডান পকেটের ছুরিটা বের করে গলার উপর চালিয়ে দিলেন । ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো । তিনি রক্ত দেখতে থাকলেন । কি সুন্দর রক্ত ।

কি তার ঘ্রাণ । অপূর্ব । অপূর্ব । এর থেকে সুন্দর আর কি হতে পারে ? তার শরীর ঠাণ্ডা হল । নিজের শরীরের নিয়ন্ত্রণ যেন বুঝে পেলেন ।

এরপর তিনি দেখতে পেলেন সেই লোকটি আর কেউ নন তার স্কুলের হেডমাস্টার রতন সাহেব । রিসাত সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন । এ তিনি কি করলেন ? তবে তার তৃপ্তি এর পরিমাণও কম ছিল না । ছিল নতুন নেশার উম্মাদনা , ছিল সুখ খুঁজে পাওয়ার শান্তি । তিনি শিক্ষক মানুষ বলে পকেটে কাগজ কলম থাকে ।

তিনি ছোট একটি কাগজ বের করলেন । এরপর লিখলেন , '' এ যেন এক নতুন প্রাপ্তি , নতুন রক্তের ঘ্রাণ , নতুন রক্তের রং । '' কি জন্য লিখলেন তিনি নিজেও ঠিক বুঝতে পারলেন না । তবে মনে হয় মুহূর্তের কথা একটু লিখে রাখা । তিনি কাগজটি লাশের পাশে রেখে চলে গেলেন ।

জামায় বেশখানিকটা রক্ত লেগে ছিল । রাত গভীর । মানুষ নেই বললেই চলে । তাই একটু কম চিন্তা মাথায় নিয়েই রিসাত সাহেব হেঁটে বাসায় বলে এলেন । কেউ তাকে দেখে নি ।

তিনি জামা ছেড়ে তখনই ধুয়ে দিলেন । পরের দিন তো আর স্কুলে যাওয়া লাগবে না তিনি ছুটি নিয়েছেন আগেই । শরীরে লেগে থাকা রক্ত পরিষ্কার করে তিনি শুয়ে পড়লেন । এই রকম ঘুম যেন আগে কখনো তিনি ঘুমান নি । শান্তির ঘুম ।

মাথায় কোন প্রকার চিন্তার অস্তিত্ব নেই । শুধুই তিনি আর ঘুম পরস্পরকে জড়িয়ে রয়েছেন । একজন যেন অপরজনকে বহুদিন পড়ে পেলো । কি সেই ক্ষণ । কি সেই মিলন ।

তিনি মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না বলে তাকে তার বাসায় এসে হেডমাস্টার সাহেবের মৃত্যুর খবর দিয়ে যায় গণিত বিভাগের আরেকজন শিক্ষক নাম রিয়াজ । '' লোকটার কোন দুশমন তো ছিল না । ছাত্রদের সাথে রাগারাগি বেশি করতেন মানলাম । কিন্তু কোন ছাত্রর পক্ষে এই কাজ করা সম্ভব না । আর তিনি যে রাতে বের হয়েছেন এই খবরই বা পাবে কীভাবে ? '' '' হুম ।

' '' আমি নিশ্চিত পরিবারের কেউ ই এই কাজ করেছে । বাসা থেকে যেই বের হয়েছে লোক লাগিয়ে মেরে ফেলেছে । গ্রামে নাকি বেশ জমি জমা আছে । তবে পুলিশ বলছে কাজটা কোন অদক্ষ লোকের করা । '' '' হুম ।

'' '' আপনার মনে হয় এখনও ঘুমের ঘোর কাটে নি । আর ঐ যে পুলিশ টাকা দিলেই বলবে আপনি খুন করেছেন । '' রিসাত বেশ ভয় পেয়ে কেঁপে উঠলো । রিয়াজ সাহেবের চোখ এরালো না । '' আরে আমি এমনেই বললাম ।

ভয় পাওয়ার কি আছে ? '' কিছুতেই যেন নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারছিল না রিসাত সাহেব । জিনিসটা বুঝতে পেরে রিয়াজ সাহেব বেশ লজ্জিত হলেন তাকে এইরকম বিব্রত পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়ে । ক্ষমা চেয়ে চলে গেলেন , জানাজার নামাজে শরিক হওয়ার জন্য বলে । পাঁচ - দুই দিন কেটে গেলো । আগে ছুটির দিনগুলো যেভাবে কাটতো সেভাবেই কেটে যেতে লাগলো ।

কিন্তু আবার সেই পশুত্ব ফিরে আসতে কতদিন ? রিসাত সাহেব চিন্তা করলেন , ''একটু হাওয়া পরিবর্তন করে বাহিরে থেকে ঘুরে এলে কেমন হয় ? ছুটি আরেকটু না হয় বাড়িয়ে নিলাম । '' তিনি সমুদ্র সৈকত দেখতে যাবেন বলে মনঃস্থির করলেন । টিকিটও কেটে ফেললেন । বাস রাতে ছাড়বে । ঐদিন সকালে বাড়ির মালিক রায়হান সাহেব এলেন ।

হাসি- খুশি , সহজ সরল মানুষ । রুমে ঢুকার অনুমতি চেয়ে অনুমতির জন্য দেরি না করে ঢুকে গেলেন । '' তা কেমন আছেন ? বারিয়ালা হয়েছি বলে তো লাট সাহেব হয়ে যাই নি । ভাড়াটিয়াদের একটু খবর টবর নিতে হয় । তাই আসলাম ।

কোন সমস্যা নেই তো ? '' '' নাহ কোন সমস্যা নেই । '' '' বললেন না তো কেমন আছেন ? '' '' আছি কোন রকম । '' '' কোন রকম ? '' এর উত্তর কি দিবেন রিসাত সাহেব বুঝে উঠতে পারলেন না । '' আচ্ছা যাক ও কথা । তা ব্যাগ গুছাচ্ছেন যে ? কোথাও যাবেন নাকি ? '' '' হু ।

একটু কক্সবাজার যাবো । '' '' একটু কেন ? পুরা গেলে সমস্যা কি ? '' বলে তিনি হেসে উঠলেন । নিজের মতো করে উত্তর দেয়ার জন্য রিসাত সাহেব বলে উঠলেন '' শরীর টা ঠিক ভালো যাচ্ছে না । তাই ঐ দিকে যাচ্ছি । হাওয়া বদল আর কি ।

'' '' তা কতদিনের জন্য ? '' '' দেখি । যতদিন ভালো লাগে আর কি । '' '' ভালো । ভালো । তবে আপনার স্কুল ? '' '' ছুটি নিয়েছি ।

'' '' আমার ঐ মেয়েটার জন্য আচার আনবেন আর এক কেজি লইটকা শুটকি আইনেন । বেশি কিছু না । '' '' ঠিকাছে । মনে থাকলে । '' '' শিক্ষক মানুষ ।

কিছু ভুলে নাকি ? '' এর উত্তরের আশা না করেই বলতে থাকলেন । '' বুঝছেন , রাতে ইজিচেয়ারে করে বাইরে বসে থাকি । এই ধরেন এগারোটা থেকে বারোটা পর্যন্ত । হালকা বাতাস শরীরে লাগে । ভালোই লাগে ।

চিন্তা কম কম মনে হয় । এর চেয়ে বেশি থাকতে ইচ্ছা করলেও পারি না । ঘুম ধরে । '' রিসাত সাহেবের মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ । তাই দেখে আর কথা বাড়ানো উচিত হবে না চিন্তা করে রায়হান সাহেব বিদায় নিয়ে চলে গেলেন ।

রিসাত সাহেব চিন্তা করেন , '' লোকটার এখনও তেমন বয়স হয় নি । কিন্তু এখনই কথা বেশি বলার বাতিকে ধরেছে । '' রাত বারোটায় বাস । এগারোটার দিকে বের হলেন । সামনে ইজিচেয়ারে রায়হান সাহেব বসে আছেন ।

তার সাথে আগ বাড়িয়ে কথা না বলে রিসাত সাহেব চলে গেলেন । কলা বাগান থেকে বাস ছাড়বে । একটু হেঁটে পড়ে রিক্সা নিবেন বলে ঠিক করলেন । কিছুক্ষন হাঁটার পর তার মনে পড়লো তিনি হাতের ঘড়িটা আনেন নি । দেয়াল ঘড়ি দেখে বের হয়েছেন ।

বাসার সামনে রায়হান সাহেবকে আধো শোয়া অবস্থায় দেখে সেই রাতের শারীরিক ও মানসিক পরিস্থিতে তিনি পড়ে গেলেন । তিনি নিজের উপর থেক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে শুরু করলেন । ঘরে ঢুকলেন । হাত ঘড়ি নিলেন । এরপর চোখ গেলো ছুরির দিকে ।

তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে লাগলেন । কিন্তু মন যেন বলছে , '' সেই দিনের ঘ্রাণ মনে নেই । মনে নেই কি সেই রক্তের গন্ধের কথা । মনে না থাকলে আরেকবার নিয়ে দেখ । '' নিজে নিতে না চাইলেও হাত ছুরি নিয়ে পকেটে ঢুকালো ।

দরজা তালা দিয়ে ব্যাগ নিয়ে ইজিচেয়ারের কাছে গেলেন । ঘুমিয়ে পড়েছেন রায়হান সাহেব । মনকে মানাতে ব্যর্থ হলেন রিসাত সাহেব । ইজিচেয়ারের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি । বা হাত দিয়ে শক্ত করে মুখ চেপে ধরে ডান হাতের ছুরি গলার উপর চালিয়ে দিলেন ।

ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো । রক্তটা সেইদিনের তুলনায় বেশি লাল । ঘ্রাণটাও একটু ভিন্ন । আজ জামায় রক্ত লাগে নি । হাতে যা লেগেছিল ছিটে ফুটা বাহিরের কলে গিয়ে ধুয়ে নিলেন ।

স্বাভাবিক মানুষের মতো হেঁটে চলে গেলেন মহাম্মাদপুর বাস স্ট্যান্ড । একটা রিক্সা নিলেন কলাবাগানের উদ্দেশে । বাস ঠিক সময় ছেড়ে দিলো । চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলেন । সেইদিনের সেই ঘুম আবার ফিরে এলো ।

বাস চলতে লাগলো । ছয় - বাস যখন চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছালো তখন রিসাত সাহেবের কক্সবাজার যাওয়ার ইচ্ছা উবে গেলো । তিনি বাস থেকে নেমে গেলেন । চিন্তা করলেন আশে পাশের কোন হোটেলে থেকে এরপর আবার ঢাকায় ফিরে যাবেন । যেই চিন্তা সেই কাজ ।

' পিয়াসা ' নামের একটি তিন তারকা হোটেলে উঠলেন । তখন ভোর ছয়টা বাজে । গোসল ছেড়ে ঘুম দিলেন । সাত - স্কুলের হেডমাস্টার রতন সাহেবের খুনের সময় একজন শিক্ষকই অনুপস্থিত ছিলেন । তার নাম ছিল রিসাত ।

তবে তাকে সন্দেহ করাও ছিল বড়ই কঠিন । তাকে সন্দেহ করে কোন কথা বললেই সবাই রেগে যেতো । আর সে ছুটি আগেই নিয়েছে । আর লাশের কাছে পাওয়া নোটের হাতের লেখার সাথে তার স্কুলে পাওয়া হাতের লেখার কোন মিল ছিল না । তাই বেশি দূর আগানো যায় নি ।

আর এই দিকে রায়হান সাহেবের মৃত্যুও একই ধরনের আর এখানেও একটি নোট পাওয়া গেছে । যেখানে লেখা ছিল - '' নতুন রক্তের রং , নতুন রক্তের ঘ্রাণ , নতুন প্রাপ্তি । '' এই লেখার সাথে সেদিনের লেখার হুবহু মিল আছে । সুতরাং এইবার রিসাত সাহেবকে সন্দেহের তালিকায় উপরে রাখতে কোন বাধা নেই । যদিও জিনিসটা প্রকাশ্যে বলা যাচ্ছে না ।

সে যে এই ধরনের কাজ চিন্তাও করতে পারে না তাই সবাই বলছে । মোহাম্মাদপুর থানার ওসি রশিদ সাহেবের উপর দায়িত্ব পড়েছে এই কেসের । উপরে রিপোর্ট করতে গিয়ে তাকে ঝাড়ি খেতে হয়েছে বেশ । কারণ তাদের কথা রিসাত সাহেবকে আগেই ধরা উচিত ছিল । সময় অনেক গড়িয়ে গেছে ।

তবুও ট্রান্সফার বাচাতে না পারলেও অন্তত চাকরিটা বাচাতে পারবেন যদি কেসটা এক দুই দিনের মধ্যে সমাধান করে দিতে পারেন । তিনি কিছুতেই বুঝাতে পারলেন না তাদের যে , '' রিসাত সাহেবের হিস্টোরি এতোই ক্লিয়ার যে তার বিরুদ্ধে কোন স্টেপ নিলে তার আশে পাশের মানুষ গণ্ডগোল শুরু করবে । যারা খুন হয়েছে তাদের আত্মীয় স্বজন পর্যন্ত তার উপর কোন সন্দেহ পোষণ করে না । '' রশিদ সাহেবের চাকরি বাঁচানো নিয়ে কথা । একটা সুরাহা করতেই হবে ।

কিন্তু তাকে ধরার তেমন কোন ক্লু তারা পাচ্ছেন না । তবে তার প্রতিবেশীর কাছ থেকে জানতে পেরেছেন তার বাহিরে যাওয়ার কথা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখেছেন এগারোটার দিকে । আর খুন হয়েছে এরপরে । ঠিক মিলাতে পারছেন না । আর কোথায় গিয়েছেন তাও কেউ বলতে পারলো না ।

রশিদ সাহেব রিসাত সাহেবের রুমের তালা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকলেন । বাসায় ধারালো কিছুই নেই । হয়তো সাথেই নিয়ে গেছে । তার মানে আরেকটা খুন হতে পারে । এরপর ছোট একটা ডাইরি পেলেন ।

আর সেটি খুলে অবাক হয়ে গেলেন এই যে সেই হাতের লেখা । আরেকটি পৃষ্ঠা পেলেন যেখানে পরীক্ষার জন্য প্রশ্ন করা হচ্ছে সেই লেখাটি স্কুলে রিসাত সাহেবের পাওয়া হাতের লেখার সাথে মিলে । রশিদ সাহেব পুরোই হতভম্ব । তিনি আশে পাশের মানুষদের জিজ্ঞেস করলেন তিনি কি একা থাকতেন নাকি তার সাথে আর কেউ থাকতেন ? কারণ একই জায়গায় দুই ধরনের হাতের লেখা । এক্সপার্টদের পরামর্শ নিয়ে জানতে পারলেন দুটি পুরোই বিপরীত ধাঁচের কারো পক্ষে এটি সম্ভব নয় ।

তবে দুই হাতেই লিখতে পারলে সম্ভব । রিসাত সাহেবের রুম দেখে বুঝা যাচ্ছে তিনি কোথাও কিছুদিনের জন্য গিয়েছেন আর চলে আসবেন । কারণ অনেক জিনিসই রেখে গিয়েছেন । বেশ কিছু টাকার একটা ব্যাগও আলমারির ভিতরে আছে । যেহেতু রিসাত সাহেব কোথায় গিয়েছেন জানা যাচ্ছে না তাই রশিদ সাহেব ঠিক করলেন বাসার আশে পাশে লোক রাখবেন ।

যেন আসার সাথে সাথে ধরা যায় । আট - দুপুরের দিকে রিসাত সাহেবের ঘুম ভাঙল । ঘুমের ঘোর কাটতে সময় লাগলো । কিছুক্ষন পর বাহিরে হই চই এর শব্দে তিনি বাহিরে তাকালেন দেখলেন কয়েকজন মিলে একজনকে মারছে । এর কারণে তার মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে ।

এই রক্ত দেখে রিসাত সাহেব অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন । তার আবার নেশা ডাক দিয়েছে । তিনি বুঝতে পারলেন না , এতো তাড়াতাড়ি তো নেশা ডাক দেয় না । কালকে রাতেই তো নেশার ডাকে সারা দিলেন । আবার এখন কেন ? তবে নেশার ডাক প্রবল হতে লাগলো ।

পাঞ্জাবির পকেটে হাত চলে গেলো অজান্তেই আর সেখানে বিদ্যমান ছুরির অস্তিত্ব টের পেলেন । তা নেশার ডাককে প্রশমিত করলো । তিনি খাবার রুমে দিয়ে যাওয়ার জন্য রিসিপ্সনে ফোন করে বললেন । বেশ অশস্তিকর মুহূর্তের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন । ওয়েটার এসে খাবার রাখলো টেবিলে ।

চলে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে যাচ্ছিল যখন তখন রিসাত সাহেব তাকে ডাক দিয়ে বসতে বললেন । এরপর জিজ্ঞেস করলেন বাহিরে তখন কি হচ্ছিল ? '' স্যার । তেমন কিছু না এক চোরকে ধরে পিটানো হচ্ছিল । '' কথা বলতে বলতে রিসাত সাহেব ছেলেটির পিছনে চলে গিয়েছেন । তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন ,' কেন ? কি চুরি করেছে ? '' বলেই আর অপেক্ষা করলেন না শুধু বললেন , '' আমায় মাফ করিস ।

'' মুখ চেপে ধরে পাঞ্জাবির পকেট থেকে ছুরি বের করে চালিয়ে দিলেন । তবে এইবার তার কষ্ট হচ্ছে । কিন্তু শরীরকে ঠাণ্ডা করার জন্য এর বিকল্প যে নেই । এক পর্যায়ে চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে । কি যে কষ্ট ।

তা কাউকে বলার নয় । ছেলেটার চোখগুলো বড় বড় করে মৃত্যুর পরও রিসাত সাহেবকে দেখছে । আস্তে আস্তে ঘোলা হয়ে যাওয়া চোখগুলোকে রিসাত সাহেব বন্ধ করে দিলেন । একটা কাগজে লিখলেন , '' এই বোধ হয় শেষ রক্ত দেখা , এই বোধ হয় শেষ রক্তের ঘ্রাণ নেয়া । '' তিনি নিজের শরীরে লাগা রক্তগুলোকে পরিষ্কার করে নিলেন ।

ছুরি ধুয়ে আবার পকেটে রাখলেন । বিছানায় শুয়ে নিজেকে শান্ত করে নিলেন । কিছুক্ষনপর নিচে গেলেন বিল পরিশোধ করতে । বিলের রসিদ যখন লেখা হচ্ছিল তখন রিসাত সাহেব তার পাঞ্জাবির পকেট হাতড়াচ্ছিলেন । তার ডাইরিটা কোথায় ? তিনি একটা কাগজ চাইলেন ম্যানেজারের কাছে ।

কাগজে কি যেন টুকে রাখলেন । এরপর রিসাত সাহেবকে এক জায়গায় স্বাক্ষর দেয়ার জন্য বললেন ম্যানেজার সাহেব । রিসাত সাহেব স্বাক্ষর করলেন । এরপর ম্যানেজার সাহেব বললেন , '' স্যার , আপনি দুই হাতেই লিখতে পারেন দেখি । কাগজে লিখলেন ডান হাতে আর স্বাক্ষর বাম হাতে ।

'' '' হুম । জরুরি কিছু লেখা বাম হাতে লিখি আর ডান হাতে সাধারণ লেখা লিখি । '' '' আমি এই প্রথম দেখলাম , স্যার । বেশ অবাক হলাম । ধন্যবাদ ।

আবার আসবেন । '' হোটেল থেকে বেরিয়েই ঢাকার জন্য টিকেট কাটতে গেলেন বাস কাউন্টারে । এক ঘণ্টা পরে বাস আসবে । টিকেট কেটে ফেললেন । বাসে উঠলেন ঢাকার উদ্দেশ্যে ।

চিন্তা করতে লাগলেন , '' তিনি এ কি করে চলেছেন ? '' নয় - চট্টগ্রামে ঘটে যাওয়া খুনের ঘটনা রশিদ সাহেবের কাছে ততক্ষণে পৌঁছে গেছে । আর তিনি ম্যানেজারের সাথে কথা বলে জেনেছেন , খুনের ধরন , রেখে যাওয়া নোট সম্পর্কে । যা আগের ঘটে যাওয়া খুনের সাথে অবিকল মিলে যায় । আর রিসাত সাহেবের দুই হাতে লেখার সক্ষমতার কথাও জেনেছেন । এখন রশিদ সাহেব নিশ্চিত ' রিসাত সাহেব ' ই খুনি ।

আর তিনি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন । রশিদ সাহেব সকল প্রকার প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন । দশ - দুপুর তিনটা এর দিকে রিসাত সাহেব ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন । রাত দশটার দিকে কলাবাগান বাস স্ট্যান্ডে নামলেন । এরপর রিক্সা করলেন বাসার জন্য ।

বাসার সামনে রিক্সা থেকে নামলেন । ভাড়া চুকিয়ে রুমের জন্য হাঁটা ধরলেন । ঐদিকে রসিদ সাহেব প্রস্তুত । ঘরে ঢুকার আগেই ধরে ফেলবেন । আর উপর থেকে নির্দেশ পেয়েছেন ধরে রাখার দরকার নেই কেস ডিসমিস যেন অন দা স্পট হয় ।

তাকে রশিদ সাহেব থামতে বললেন । তখন চারপাশ থেকে আরও কয়েকজন জড়ো হলো । রিসাত সাহেব ঘাবড়ে গেলেন । তখন তার মনে পড়লো , '' আমি একজন শিক্ষক হয়ে জেলে যাবো ? আমার ছাত্ররা কি বলবে ? কি শিখবে ? '' তিনি তখনই পকেটের ছুরি বের করলেন । পুলিশরাও তখন যার যার পিস্তল বের করলেন ।

তাকে আত্মসমর্পণ করার জন্য হলো । কিন্তু সেই সকল কিছুই যেন রিসাত সাহেব শুনতে পেলেন না । তার মাথায় হাজার হাজার চিন্তা খেলা করতে লাগলো । তিনি এক পুলিশ অফিসারের দিকে ছুরি ছুড়ে মেরে ঘুরে দৌড় দেবার আগেই রশিদ সাহেব গুলি করলেন । গুলিটা রিসাত সাহেবের বাম বুকে লাগলো ।

তিনি তার দুই হাত দিয়ে ক্ষতস্থান চেপে ধরলো । তার সারা শরীর কুঁকড়ে আসছিল । আস্তে আস্তে বসে পড়লেন তিনি । নিজের ফিনকি দিয়ে বের হওয়া রক্ত দেখে আর সেই রক্তের ঘ্রাণ পেয়ে আপনা থেকেই ঠোঁটের এক পাশে হাসির উদ্ভব হলো । যা সবাই দেখলো ।

আর রশিদ সাহেবের চাকরিও বেচে গেলো । '' যায় জ্বলিয়া যায় , পরাণ আমার , নিভাই সেই জ্বালা অন্যের পরাণ নিয়া । ''

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।