ছয় -
বাস যখন চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছালো তখন রিসাত সাহেবের কক্সবাজার যাওয়ার ইচ্ছা উবে গেলো । তিনি বাস থেকে নেমে গেলেন । চিন্তা করলেন আশে পাশের কোন হোটেলে থেকে এরপর আবার ঢাকায় ফিরে যাবেন ।
যেই চিন্তা সেই কাজ । ' পিয়াসা ' নামের একটি তিন তারকা হোটেলে উঠলেন ।
তখন ভোর ছয়টা বাজে । গোসল ছেড়ে ঘুম দিলেন ।
সাত -
স্কুলের হেডমাস্টার রতন সাহেবের খুনের সময় একজন শিক্ষকই অনুপস্থিত ছিলেন । তার নাম ছিল রিসাত । তবে তাকে সন্দেহ করাও ছিল বড়ই কঠিন ।
তাকে সন্দেহ করে কোন কথা বললেই সবাই রেগে যেতো । আর সে ছুটি আগেই নিয়েছে । আর লাশের কাছে পাওয়া নোটের হাতের লেখার সাথে তার স্কুলে পাওয়া হাতের লেখার কোন মিল ছিল না । তাই বেশি দূর আগানো যায় নি ।
আর এই দিকে রায়হান সাহেবের মৃত্যুও একই ধরনের আর এখানেও একটি নোট পাওয়া গেছে ।
যেখানে লেখা ছিল -
'' নতুন রক্তের রং ,
নতুন রক্তের ঘ্রাণ ,
নতুন প্রাপ্তি । ''
এই লেখার সাথে সেদিনের লেখার হুবহু মিল আছে । সুতরাং এইবার রিসাত সাহেবকে সন্দেহের তালিকায় উপরে রাখতে কোন বাধা নেই । যদিও জিনিসটা প্রকাশ্যে বলা যাচ্ছে না । সে যে এই ধরনের কাজ চিন্তাও করতে পারে না তাই সবাই বলছে ।
মোহাম্মাদপুর থানার ওসি রশিদ সাহেবের উপর দায়িত্ব পড়েছে এই কেসের । উপরে রিপোর্ট করতে গিয়ে তাকে ঝাড়ি খেতে হয়েছে বেশ । কারণ তাদের কথা রিসাত সাহেবকে আগেই ধরা উচিত ছিল । সময় অনেক গড়িয়ে গেছে । তবুও ট্রান্সফার বাচাতে না পারলেও অন্তত চাকরিটা বাচাতে পারবেন যদি কেসটা এক দুই দিনের মধ্যে সমাধান করে দিতে পারেন ।
তিনি কিছুতেই বুঝাতে পারলেন না তাদের যে , '' রিসাত সাহেবের হিস্টোরি এতোই ক্লিয়ার যে তার বিরুদ্ধে কোন স্টেপ নিলে তার আশে পাশের মানুষ গণ্ডগোল শুরু করবে । যারা খুন হয়েছে তাদের আত্মীয় স্বজন পর্যন্ত তার উপর কোন সন্দেহ পোষণ করে না । ''
রশিদ সাহেবের চাকরি বাঁচানো নিয়ে কথা । একটা সুরাহা করতেই হবে । কিন্তু তাকে ধরার তেমন কোন ক্লু তারা পাচ্ছেন না ।
তবে তার প্রতিবেশীর কাছ থেকে জানতে পেরেছেন তার বাহিরে যাওয়ার কথা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখেছেন এগারোটার দিকে । আর খুন হয়েছে এরপরে । ঠিক মিলাতে পারছেন না । আর কোথায় গিয়েছেন তাও কেউ বলতে পারলো না ।
রশিদ সাহেব রিসাত সাহেবের রুমের তালা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকলেন ।
বাসায় ধারালো কিছুই নেই । হয়তো সাথেই নিয়ে গেছে । তার মানে আরেকটা খুন হতে পারে । এরপর ছোট একটা ডাইরি পেলেন । আর সেটি খুলে অবাক হয়ে গেলেন এই যে সেই হাতের লেখা ।
আরেকটি পৃষ্ঠা পেলেন যেখানে পরীক্ষার জন্য প্রশ্ন করা হচ্ছে সেই লেখাটি স্কুলে রিসাত সাহেবের পাওয়া হাতের লেখার সাথে মিলে । রশিদ সাহেব পুরোই হতভম্ব । তিনি আশে পাশের মানুষদের জিজ্ঞেস করলেন তিনি কি একা থাকতেন নাকি তার সাথে আর কেউ থাকতেন ?
কারণ একই জায়গায় দুই ধরনের হাতের লেখা । এক্সপার্টদের পরামর্শ নিয়ে জানতে পারলেন দুটি পুরোই বিপরীত ধাঁচের কারো পক্ষে এটি সম্ভব নয় । তবে দুই হাতেই লিখতে পারলে সম্ভব ।
রিসাত সাহেবের রুম দেখে বুঝা যাচ্ছে তিনি কোথাও কিছুদিনের জন্য গিয়েছেন আর চলে আসবেন । কারণ অনেক জিনিসই রেখে গিয়েছেন । বেশ কিছু টাকার একটা ব্যাগও আলমারির ভিতরে আছে ।
যেহেতু রিসাত সাহেব কোথায় গিয়েছেন জানা যাচ্ছে না তাই রশিদ সাহেব ঠিক করলেন বাসার আশে পাশে লোক রাখবেন । যেন আসার সাথে সাথে ধরা যায় ।
আট -
দুপুরের দিকে রিসাত সাহেবের ঘুম ভাঙল । ঘুমের ঘোর কাটতে সময় লাগলো । কিছুক্ষন পর বাহিরে হই চই এর শব্দে তিনি বাহিরে তাকালেন দেখলেন কয়েকজন মিলে একজনকে মারছে । এর কারণে তার মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে । এই রক্ত দেখে রিসাত সাহেব অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন ।
তার আবার নেশা ডাক দিয়েছে । তিনি বুঝতে পারলেন না , এতো তাড়াতাড়ি তো নেশা ডাক দেয় না । কালকে রাতেই তো নেশার ডাকে সারা দিলেন । আবার এখন কেন ?
তবে নেশার ডাক প্রবল হতে লাগলো । পাঞ্জাবির পকেটে হাত চলে গেলো অজান্তেই আর সেখানে বিদ্যমান ছুরির অস্তিত্ব টের পেলেন ।
তা নেশার ডাককে প্রশমিত করলো ।
তিনি খাবার রুমে দিয়ে যাওয়ার জন্য রিসিপ্সনে ফোন করে বললেন । বেশ অশস্তিকর মুহূর্তের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন ।
ওয়েটার এসে খাবার রাখলো টেবিলে । চলে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে যাচ্ছিল যখন তখন রিসাত সাহেব তাকে ডাক দিয়ে বসতে বললেন ।
এরপর জিজ্ঞেস করলেন বাহিরে তখন কি হচ্ছিল ?
'' স্যার । তেমন কিছু না এক চোরকে ধরে পিটানো হচ্ছিল । ''
কথা বলতে বলতে রিসাত সাহেব ছেলেটির পিছনে চলে গিয়েছেন ।
তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন ,' কেন ? কি চুরি করেছে ? '' বলেই আর অপেক্ষা করলেন না শুধু বললেন , '' আমায় মাফ করিস । ''
মুখ চেপে ধরে পাঞ্জাবির পকেট থেকে ছুরি বের করে চালিয়ে দিলেন ।
তবে এইবার তার কষ্ট হচ্ছে । কিন্তু শরীরকে ঠাণ্ডা করার জন্য এর বিকল্প যে নেই । এক পর্যায়ে চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে ।
কি যে কষ্ট । তা কাউকে বলার নয় ।
ছেলেটার চোখগুলো বড় বড় করে মৃত্যুর পরও রিসাত সাহেবকে দেখছে । আস্তে আস্তে ঘোলা হয়ে যাওয়া চোখগুলোকে রিসাত সাহেব বন্ধ করে দিলেন ।
একটা কাগজে লিখলেন ,
'' এই বোধ হয় শেষ রক্ত দেখা ,
এই বোধ হয় শেষ রক্তের ঘ্রাণ নেয়া । ''
তিনি নিজের শরীরে লাগা রক্তগুলোকে পরিষ্কার করে নিলেন । ছুরি ধুয়ে আবার পকেটে রাখলেন ।
বিছানায় শুয়ে নিজেকে শান্ত করে নিলেন ।
কিছুক্ষনপর নিচে গেলেন বিল পরিশোধ করতে । বিলের রসিদ যখন লেখা হচ্ছিল তখন রিসাত সাহেব তার পাঞ্জাবির পকেট হাতড়াচ্ছিলেন । তার ডাইরিটা কোথায় ? তিনি একটা কাগজ চাইলেন ম্যানেজারের কাছে । কাগজে কি যেন টুকে রাখলেন ।
এরপর রিসাত সাহেবকে এক জায়গায় স্বাক্ষর দেয়ার জন্য বললেন ম্যানেজার সাহেব । রিসাত সাহেব স্বাক্ষর করলেন । এরপর ম্যানেজার সাহেব বললেন , '' স্যার , আপনি দুই হাতেই লিখতে পারেন দেখি । কাগজে লিখলেন ডান হাতে আর স্বাক্ষর বাম হাতে । ''
'' হুম ।
জরুরি কিছু লেখা বাম হাতে লিখি আর ডান হাতে সাধারণ লেখা লিখি । ''
'' আমি এই প্রথম দেখলাম , স্যার । বেশ অবাক হলাম । ধন্যবাদ । আবার আসবেন ।
''
হোটেল থেকে বেরিয়েই ঢাকার জন্য টিকেট কাটতে গেলেন বাস কাউন্টারে । এক ঘণ্টা পরে বাস আসবে । টিকেট কেটে ফেললেন । বাসে উঠলেন ঢাকার উদ্দেশ্যে ।
চিন্তা করতে লাগলেন , '' তিনি এ কি করে চলেছেন ? ''
নয় -
চট্টগ্রামে ঘটে যাওয়া খুনের ঘটনা রশিদ সাহেবের কাছে ততক্ষণে পৌঁছে গেছে ।
আর তিনি ম্যানেজারের সাথে কথা বলে জেনেছেন , খুনের ধরন , রেখে যাওয়া নোট সম্পর্কে । যা আগের ঘটে যাওয়া খুনের সাথে অবিকল মিলে যায় । আর রিসাত সাহেবের দুই হাতে লেখার সক্ষমতার কথাও জেনেছেন । এখন রশিদ সাহেব নিশ্চিত ' রিসাত সাহেব ' ই খুনি । আর তিনি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন ।
রশিদ সাহেব সকল প্রকার প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন ।
দশ -
দুপুর তিনটা এর দিকে রিসাত সাহেব ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন । রাত দশটার দিকে কলাবাগান বাস স্ট্যান্ডে নামলেন । এরপর রিক্সা করলেন বাসার জন্য ।
বাসার সামনে রিক্সা থেকে নামলেন ।
ভাড়া চুকিয়ে রুমের জন্য হাঁটা ধরলেন ।
ঐদিকে রসিদ সাহেব প্রস্তুত । ঘরে ঢুকার আগেই ধরে ফেলবেন । আর উপর থেকে নির্দেশ পেয়েছেন ধরে রাখার দরকার নেই কেস ডিসমিস যেন অন দা স্পট হয় ।
তাকে রশিদ সাহেব থামতে বললেন ।
তখন চারপাশ থেকে আরও কয়েকজন জড়ো হলো ।
রিসাত সাহেব ঘাবড়ে গেলেন । তখন তার মনে পড়লো , '' আমি একজন শিক্ষক হয়ে জেলে যাবো ? আমার ছাত্ররা কি বলবে ? কি শিখবে ? ''
তিনি তখনই পকেটের ছুরি বের করলেন । পুলিশরাও তখন যার যার পিস্তল বের করলেন । তাকে আত্মসমর্পণ করার জন্য হলো ।
কিন্তু সেই সকল কিছুই যেন রিসাত সাহেব শুনতে পেলেন না । তার মাথায় হাজার হাজার চিন্তা খেলা করতে লাগলো ।
তিনি এক পুলিশ অফিসারের দিকে ছুরি ছুড়ে মেরে ঘুরে দৌড় দেবার আগেই রশিদ সাহেব গুলি করলেন । গুলিটা রিসাত সাহেবের বাম বুকে লাগলো ।
তিনি তার দুই হাত দিয়ে ক্ষতস্থান চেপে ধরলো ।
তার সারা শরীর কুঁকড়ে আসছিল । আস্তে আস্তে বসে পড়লেন তিনি । নিজের ফিনকি দিয়ে বের হওয়া রক্ত দেখে আর সেই রক্তের ঘ্রাণ পেয়ে আপনা থেকেই ঠোঁটের এক পাশে হাসির উদ্ভব হলো ।
যা সবাই দেখলো । আর রশিদ সাহেবের চাকরিও বেচে গেলো ।
'' যায় জ্বলিয়া যায় , পরাণ আমার ,
নিভাই সেই জ্বালা অন্যের পরাণ নিয়া । ''
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।