আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রক্তজবা, শাপলা, কদম....সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

তবুও জীবন যাচ্ছে কেটে জীবনের নিয়মে।

টিলার আয়তন কতোটুকু সঠিক বলতে পারবো না। জায়গা-জমির মাপজোক সম্পর্কে আমার কোনই জ্ঞান নেই। তবে সহানীয় হিসেবে অনুসারে এগারো কিয়ার (সিলেটি)। এখানকার সবার টিলার উপরেই বাড়ি।

মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হতো টিলার বাশের সিড়িগুলো বেয়ে অন্য কারো বাড়ি যেতে। আমাদের আশেপাশে প্রচুর হিন্দু বাড়ি। আমাদের বাড়ির সীমানার সাথেই ছিল শ্বশান। মরা মানুষ পোড়ানো দেখতে অনেকের যেখানে বমি আসতো, সেখানে আমরা এগুলো দেখে বড় হয়েছি। সারা রাত জেগে পাশের টিলায় কীর্তন গান হচ্ছে।

সুরের কোন বালাই নেই। বাদ্য যন্ত্র শুধু ঢুল আর করতাল। তারপর ও আমাদের কাছে বেশ লাগতো। কোন হিন্দু বিয়েতে আমাদের দাওয়াত অবশ্যমভাবী। ঢুলের শব্দ, আর বাশির শব্দে কি আর ঘরে থাকা যায়।

ওখানে গেলে তো বাতাসা , মিষ্টি, ফল ফ্রি। । কখন কার বাড়িতে বিয়ে সেটা অনেক আগেই টের পাওয়া যেতো। স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে অনেকের দাদা,চাচা ছিল যার বিয়ে বাড়িতে ঢুল, বাশি বাজাতো। ওদের কাছ থেকে ও আগাম খবর মিলতো।

বাড়ির নীচ দিয়ে যখন ওরা বাজনা বাজিয়ে পুজো নিয়ে মন্দিরে রওয়ানা, আমরা সাথে সাথে দৌড়ে রাস্তায়। উদ্দেশ্য বাতাসা, তিলুয়া। মন্দির আর মসজিদ পাশাপাশি। মধ্যখানে একটা ছোপ পুকুর। মন্দিরের পাশেই ছিল অনেক বড় দুটো হরতকি গাছ।

লবন দিয়ে অথবা লবন ছাড়াই কষা, তিতা হরতকিগুলো ছিল আমাদের দুপুরের লাঞ্চ। । অথবা কারো বাড়ির সীমানার জঙ্গলের ভীতরের নটকলগুলো। দেখতে ফলের মতো হলেই হতো। খেতে পারলেই হলো।

অখাদ্য হোক কোন সমস্যা নেই। বাড়িতে বনে জঙ্গলে অসংখ্য নাম না জানা ফুল ফুটতো। বড় বোনেরা শখ করে বাগান করতো। আমরা মালির কাজ করতাম। তবে ঐ জংলি ফুলগুলো কখনোই বাগানে শোভা পেতো না।

বাড়ির সামনে ছিল শান বাধানো পুকুর। পুকুর পাড়ে কামিনী ফুল আর বিরাট কৃষনোচুড়া গাছ (বানান ভুল)। জবাফুল এতো বেশি ছিল যে স্কুলের ছুটিতে এগুলো দিয়ে রান্না-বাটি খেলা হতো। কলকিফুলের(আমরা বলতাম মাইক ফুল) বিরাট গাছ (লতা বড় হতে হতে গাছের মতো হয়ে গিয়েছিল)। কখনো ফুল পাড়তে হলে লম্বা কাঠি দিয়ে পাড়তে হতো।

পুকুরে প্রথমে ছিল সাদা পদ্ম। ওগুলোতে একটা ফল হতো। সহানীয় ভাষায় আমরা এগুলোকে বেট বলি। খেতে বেশ মজা। একদিন কোথা থেকে দাদী একটা আলুর মতো কান্ড নিয়ে এসে বলে এটি পুকুরে ফেলে দিতে।

ঐটা নাকি লাল পদ্ম। কয়েক মাসের মধ্যে পুরো পুকুর লাল পদ্মে ছেয়ে গেলো। বেশি হয়ে গেলে মাঝে মাঝে অনেক কষ্টে উপড়ে ফেলতে হতো। গন্ধরাজ, কামিনী, কদম, ঘন্টাফুল (সহানীয় ভাষায়), দুধ ফুল (সহানীয় ভাষায়), নয়নতারা, সন্ধ্যমালতি, বেলি আর ও নাম না জানা ফুল। তখন নাম জানার কোন ইচ্ছেই ছিল না।

দেখতে সুন্দর, ব্যস ঐটাই ফুল। ভোরে ঘুম থেকে উঠে মক্তবে যেতে দেখা যেতো হিন্দু বাড়ি থেকে লোকজন এসে পুজোর জন্য ফুল নিয়ে যাচ্ছে। আমরা চিল্লাফাল্লা শুরু করে দিতাম। ওরা মুচকি হাসতো। পিছন থেকে মা ধমক দিয়ে বলতো তাড়াতাড়ি মক্তবে যেতে।

অনেকেই ফুল নিতো কিন্তু গাছ পুরো খালি হতো না। হিন্দু বাড়িগুলোতে ছিল আমাদের লোভনীয় কিছু ফলের গাছ। আমলকি, তেতুল, আমড়া (বরিশালী আমড়া না। এগুলো প্রচন্ড টক), লুকলুকি(সহানীয় ভাষায়, দেখতে বরইয়ের মতো। খাওয়ার পর দাত প্রচন্ড লাল হয়ে যেতো), নটকল।

এগুলোর লোভে স্কুলে যাওয়ার সময় গাছে ঢিল দিয়ে দৌড়। ফলের সিজনে ওরা আমাদের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যেতো। যতো খুশি খাও। গাছ থেকে পেড়ে তেতুল, আমড়া, নটকল। তবে আমলকি গাছ ছিলো অনেক বড়ো।

গাছে উঠার সাহস হতো না। ওরা যেদিন বেশি করে পাড়তো সেদিন আমাদের বাসায় পাটিয়ে দিতো। একসাথে অনেকগুলো আমলকি খাওয়া সম্ভব না। তাই হামান-দিস্তা য় লবন, মরিচ দিয়ে ভর্তা। কি যে অমৃত ছিল।

নারকেল গাছ ছিল মাত্র 2টা। ওগুলো যে পরিমান নারকেল ধরতো তাতে আমাদের কিছুই হতো না। নারকেলের পাতা দিয়ে বাশি বানানোর প্রতিযোগিতা ছিল। কার বানানো বাশি কতো সুন্দর করে বাজে। যখন হোস্টেলবাসি হয়ে গেলাম।

3/4 মাস পর বাড়িতে গেলে হিন্দু বাড়ির লোকজন দেখা করতে আসতো। আমাদের জন্য গাছের ফল রেখে দিতো। কখনো কোন বিয়েতে উপসহিত থাকতে না পারলে বাড়িতে মিষ্টি পাঠিয়ে দিতো। টিলাটায় আগে অনেকগুলো চা-গাছ ছিল। সব কেটে মাত্র 4টা গাছ ছিল স্মৃতি হিসেবে।

সময়ের সাথে সাথে পুকুর ভরাট হয়েছে। নাম না জানা ফুলের জায়গায় দামী ফুল শোভা পাচ্ছে। কৃষনচোড়া, কদম গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। নতুন ভিটামিনে ভরপুর অনেক ফলের গাছে ও ফল ধরিতেছে। হিন্দুবাড়িগুলো ও কেমন বদলে গেছে।

সবাই সবকিছু বিক্রি করে ইন্ডিয়া পাড়ি দিচ্ছে। তেতুল গাছ, আমলকি গাছ আর নেই। অথচ মায়ের মুখে শুনেছিলাম যুদ্ধের সময় আমাদের পুকুরে ওদের মুর্তিগুলো ডুবিয়ে রাখা ছিল। একে একে বাড়ির লোকজন ও কমে গেলো। মেইন রাস্তা থেকে বাড়ির উঠোন পর্যন্ত ঢালাই করা পথ।

মাটির রাস্তায় অথবা ঘাসে এখন আর বৃষ্টির সময় পিছলে পড়ার কোন সম্ভাবনা নেই। অথচ কোন এক সময় বৃষ্টি শেষ হলে কাগজের নৌকা বানিয়ে পানিতে দৌড়াদৌড়ি করে কাপড় ময়লা করে মায়ের হাতের আদর । নারকেল গাছের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু কেউ এখন আর বাশি বানায় না। গ্রামের মেঠো পথ এখন পিছঢালা রাস্তা।

জীবনটা অসম্ভব রকম যান্ত্রিক হয়ে গেছে। এখানে এখন গাছে অনেক রকমের ফুল ফুটেছে। গত সপ্তাহে ক্যামেরা, বাইসাইকেল আর ছোট বোনকে নিয়ে বের হয়ে অনেকগুলো ছবি তুলেছি। প্রতিটা ঘরের ব্যালকন, বাগান বিভিন্ন কালারের ফুল শোভা পাচ্ছে। পার্ক দিয়ে হেটে যেতে যেতে মাঝে মাঝে 2/1 টা ফুল ছিড়ে গন্ধ শুকে দেখি কোন গন্ধই নেই।

অথচ আমাদের বেলী, গন্ধরাজ, কামিনী ফুটলে অনেক দুর থেকে ও গন্ধ পাওয়া যেতো। সবই এখন অতীত। [ইংলিশ][[/ইংলিশ] সবার মতো আজকে আমি ও অফিস ফাকি দিয়ে ব্লগে। এখানে বেশিরভাগ ব্লগারই মনে হয় অফিসে বসে ব্লগিং করে। কারন শুক্রবারে ব্লগে খুব একটা লোকজন দেখা যায় না।

শুধু অফিস ডে তে ব্লগ ভরপুর। নিজের অনেক কাজ বাকি। substation automation protocol 61850 develop করতে হবে। প্রজেক্টের কাজ। মাঝে মাঝে পুরাতন দিনের স্মৃতি গুলো খোচায়]


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।