সন্ধ্যার আঁধারে আমি যদি হারিয়ে যাই বন্ধু, আমাকে মনে রেখো তোমার ঘরের ধূপ-আগরের সুবাসে- তোমার ঘরের প্রদীপের আলোয়, আমাকে ফেলে দিও না বাসি ফুলের মত। মনের ঘরেই রেখো বন্ধু পথের ধারের ফুলটি ভেবে। আমি যে জলসাঘরে ...www.jolsaghor.com মোহিনীপুরের রাত্রি ঊষার রঙ মাখিয়া যবনিকার আড়ালে মুখ লুকাইতেছে- তাহার আয়ু কয়েক পলক মাত্র হইল। ধরণীর এই অর্ধভাগ আড়মোড়া ভাঙিয়া তখনও চক্ষু মেলে নাই, অপর অর্ধভাগ পরিশ্রান্ত দিবাবসানে সন্ধ্যার আঁচলে মুখ লুকাইতেছে- তাহা নিশ্চিত করিয়া বলিতে পারি। আর এইখানে- শূন্য পেয়ালা লুটাইয়া পড়িয়াছে, সারা রাত্রি ব্যাপিয়া তারের আন্দোলনে আন্দোলিত শ্রান্ত বীণা শেষ কান্নার সুর তুলিয়া শায়িত হইয়া আছে।
ছিন্ন হইয়া ছড়াইয়া ছিটাইয়া বিক্ষিপ্ত কিছু মণির দানা মণিহারের শোক গাহিতেছে। অবহেলায় পড়িয়া থাকা এক গাছা নূপুর তাহার যুগলকে খুঁজিতেছে।
কেহ কেহ ভুলিয়া- বিস্মৃত হইয়া তাহাদের পাদুকা ফেলিয়া গিয়াছে। কেহবা মদমত্ত হইয়া একখানা লইয়া গিয়াছে, অপরখানা ধূলায় পড়িয়া পদ-কর্তার আগমনী প্রহর গুণিতেছে। তাহাদের পায়ের ছাপ তাহাদের রজনীপ্রীতির সাক্ষ্য বহন করিতেছে- অন্ধের মত বলিতে পারে কেহ আসিয়াছিল, কিন্তু কে আসিয়াছিল সেই পরিচয় দিবার বেলায় অপারগতার শিকলে মূক হইয়া রইয়াছে।
রক্তলাল জবাকুসুমের মত সূর্য ঈষাণ কোণ হইতে একটি দক্ষিণে হেলিয়া বিরাজমান হইয়াছেন। তাহার কিরণ নিযুৎ ক্রোশ পথপরিক্রমা করিয়া যাহার আবীর কপোলকে রাঙ্গাইয়া, যাহার শুষ্ক অধরে লালীমা ছড়াইয়া, যাহার নয়ন-পাপড়ীর নিবুনিবু তন্দ্রাকে দূরে সরাইয়া তাহাকে জাগরণের গান শুনাইলো তিনি আর কেহ নন- তিনি নিশিরানী। আড়মোড়া ভাঙিয়া জলঘাটের দিকে পা বাড়াইতেই তাহার চোখে পড়িল- শিশিরসিক্ত, সদ্য বৃন্তচ্যুত একটি জবা কেহ তাহার পাদুকায় রাখিয়া গিয়াছে। ইহাতে নিশিরানী আশ্চর্য হইলেন না। গত ফাল্গুনের পূর্ণিমা হইতে কাহারও মনে তাহার তরে প্রেমের ব্যধি শিকড় গজাইয়াছে- তাহা এতদিন ধরিয়া তিনি দেখিয়া আসিতেছেন।
বিরক্ত হইয়াছেন। কখনও উতসুক হইয়াছেন। অগোচরে পুষ্পদাতার পরিচয় জানিবার চেষ্টা করিয়াও ব্যর্থ হইয়াছেন। ইহার কারণ, নিশিরানীর অপরিচিত নাগর বড়ই সুচতুর, মনোদেবীর পাদুকায় নিত্যকর্মের মত পুষ্পাঞ্জলি না দিয়া তিনি পর্যায়ক্রমিক অঞ্জলি প্রদান করেন। কেহ তাহার অর্ঘদানের দিনক্ষণ ঠিক করিতে পারে না।
অদ্যাবধি তাই- রসিক নাগর অপরিচিত রইয়া গিয়াছেন।
গত রাত্রিতে যখন নিশিরানীর মণিহার ছিন্ন হইয়া লুটাইল- তখন তাহার কন্ঠে এক করুণ রাগিনী পাখা মেলিয়াছিল। এতদিন তাহার সুর অগুণিত প্রেমিকের হৃদয় আন্দোলিত করিয়াছে। কিন্তু কাল সেই রাগিণী তাহার নিজেরই হৃদয় আন্দোলিত করিল। তাহার মনে হইল, শেষ লগ্ন দুয়ারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।
তাহাকেও অস্তাচলের পথ ধরিতে হইবে। এই যে এত এত প্রেমিক, কেহই তাহার সেই পথে সহচর তো দূর- পথচারী হইবে না। হোঁচট খাইয়া ভূলুণ্ঠিত হইলে কেহই তাহাকে হাতে ধরিয়া উঠাইবে না। পিপাসায় কেহই তৃষ্ণার জল আঁজলা ভরিয়া আনিবে না। তাহার অস্তিত্ব-অবসানে কেহ কেহ কিঞ্চিত ব্যথা পাইতে পারে- কিন্তু কেহই চোখের জল ঝরাইবে না।
…এমনই জীবনের কথা ভাবিতে ভাবিতে নিশিরানী অসময়ে আসর ছাড়িয়া শয়নমন্দিরের পালঙ্কে নিজেকে সঁপিয়া দিয়াছিলেন। তাহার সকল প্রেমিক মদমত্ততায় প্রতিবাদ করিয়া, ক্রোধিত হইয়া, কেহ কেহ নেশার ঘোরে ব্যথাতুর হইয়া, কাঁদিয়া কাঁদিয়া, স্বরচিত গালি অথবা গীত গাইয়া ফিরিয়া গিয়াছিল।
বলাবাহুল্য, আজিকে নিশিরানীর অন্তর আদ্র হইয়া আছে, কুসুম হইতেও অধিক কোমল হইয়া আছে। আজিকে অপরিচিত প্রেমিকের প্রতি তাহার বিরক্তির উদ্রেক হইল না, অভিমান হইল। আজিকে তাহার অধরে বিদ্রুপ রসের শ্লেষের হাসি ফুটিয়া উঠিল না, আঁখির কোণে জল আসিল।
সেই জল গড়াইল না। গড়াইয়া পড়িলেই হয়তো অন্তরকে বৃষ্টি শেষের আকাশের মত পরিস্কার করিয়া তোলিত। কিন্তু যে জল গড়াইতে গিয়া বাধা পাইল, সেই জল অন্তরে বাঁধভাঙা প্লাবনের মত বহিল। হৃদয়ের মরানদীতে এতদিন যত খড়খুটো-শৈবাল জমিয়াছিল, তাহাদের বিদূরিত করিয়া প্রণয়-হিল্লোলের স্রোতস্বিনী করিয়া তুলিল। নিজেকে তাহার অপরাধী মনে হইল।
মনে হইল- তিরস্কার করিয়া যাহার প্রেমকে দূরে সরাইয়া রাখিয়াছেন সেইজন না কত ব্যথা পাইয়াছে এই যাবত। নিজেই নিজেকে ভর্তসনা করিলেন- তাহার তুল্য পাতকী আর কেহ নাই, পাতকী বলিয়াই তো এহেন জীবন তাহার গলায় আসিয়া পড়িয়াছে। দেবতাকে চিনিয়া নিতে ভুল হয় বলিয়াই তো পাতকীর সনে পাতকী জীবনের বসবাস চলিতেছে। ইহা তো তাহার অজানা কোন জনমের কিঞ্চিত পূণ্যকর্মের ফলাফল যে তাহার অপরিচিত দেবতা তাহাকে ছাড়িয়া যান নাই। এইমতে ভাবিতে ভাবিতে নিশিরানী দাসীকে ডাকিলেন, দাসী একখানা পত্র, লেখনি আর কালি নিয়া আসিল।
নিশিরানী লিখিলেন- কে তুমি, অনাথের নাথ হইয়া আসিয়াছ? অহল্যার শাপমোচন হইয়াছিল পদস্পর্শে, আর তুমি পতিতের পাবন হইয়া পাতকীর পদে অঞ্জলি দিয়াছ। কোন জনমের পূণ্যফলে এমন বিধি বিধাতা লিখিয়াছিল? যদি এই দাসীর তরে একটু কৃপা হয়, স্বরূপে দেখা দিও। এই দাসীর মরণের আগে দুয়ারে আসিয়া দাঁড়াইও। …লিখিতে লিখিতে নিশিরানীর নয়ন জলে ভরিয়া গেল। এইবার জল আর বাধা মানিল না।
কপোল বাহিয়া বহিতে লাগিল। নিশিরানী পত্রখানা ভাঁজ করিয়া পাদুকার নিকটেই জবাফুলের চাপ দিয়া রাখিয়া গেলেন।
অদূরে একজড়া চোখ এই দৃশ্য দেখিল। তাহারও চোখ ছলছল করিয়া উঠিল। সে ইষ্টদেবতায় প্রণাম করিয়া মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিল- আমি যাইবো, তাহার কাছে যাইবো, আগামী প্রভাতের ঊষার ছটায় নিজ করপটে শিশিরে সিক্ত একটি রক্তজবা নিয়া তাহার সম্মুখে দাঁড়াইবো।
তাহার হইবো। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।