বাংলাদেশ নিয়ে ভাবনা, প্রত্যাশা ও সম্ভাবনার সংগ্রহমালা
বিকেল চারটার দিকে আবীর ভাইয়ের ফোন, "এই তুমি বাসায় আছো..আমি আসছি"। বেশ অবাক। হঠাৎ করে গরীবের বাসায় হাতীর পা। বেশ ধমক দিয়ে আবীর ভাই বললেন, "ফাইজলামি বন্ধ করো। আসছি গল্প করতে"।
যেই আবীর ভাইকে দাওয়াত দিয়েও আনা যায়নি, তিনি আজ নিজেই যেচে আসছেন দেখে একটু অবাক হয়ে পড়লাম।
যাক, আমার আবীর ভাইয়ের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই। আবীর ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছেন। আমার তিন ব্যাচ সিনিয়র। বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয়তাবাদী ছাএ দলের নেতাদের সাথে তার ভাল খাতির ছিল।
তিনি নিজে লাইমলাইটে ছিলেন না, তবে যারা ছিল তাদের সাথে তার নিয়মিত ওঠাবসা ছিল। এরশাদের পতনের পর বিএনপি যখন ক্ষমতায় এলো তখন আবীর ভাই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বেশ গুছিয়ে নিয়েছিলেন। তবে আমার কাছে তাকে মডারেট বিএনপি'র মানুষ বলেই মনে হয়েছে। আমাদের প্রজন্মের অনেকেই যারা জিয়ার সৈনিক হিসেবে গর্বিতভাবে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে মাথায় তুলে নেচেছে তাদের মধ্যে আবীর ভাই একজন। মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয়তাবাদের খাঁটি মিশ্রণ ঘটিয়ে তরুণদের মধ্যে একটা ক্যারিজমা ও জাতীয়তাবাদী ইমেজ তৈরীতে তিনি নিজে অত্যন্ত সিদ্ধহস্ত এবং সেজন্য পুরস্কৃতও।
আমার সাথে আবীর ভাইয়ের সম্পর্কটা বেশ ক্যাজুয়াল। বিশ্ববিদ্যালয়ে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে উঠছে তখন আবীর ভাই বিদায় নিলেন। তারপরেও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন আড্ডায় দেখা হয়ে যেতো। কারও কোন বিপদাপদে চ্যানেল আপ করতে হলে তার সাহায্য ও জনদরদী ভাবের ঘাটতি কখনও হয়নি। তিনি ব্যবসা করেন।
গুলশানে দুটো খাবার রেস্টুরেন্ট নিয়ে বেশ চমৎকার অবস্থায় আছেন। তার পাশর্্ব ব্যবসা আর কিছু আছে কি-না বা থাকলে কিরকম তা কখনও জিগ্যেস করিনি। আমি ছাপোষা চাকরি করি। আমার ব্যবসায়িক মনোবৃওি নেই, ধান্ধাও নেই। নেহাতই ইন্টেলেকচুয়াল আড্ডায় দেশ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক-ঝগড়া-বিবাদ-গুজব-গোপন সংবাদ- সবকিছুতে আবীর ভাই নিজস্ব একটা থিওরী হাজির করে জমিয়ে রাখেন।
তাতে আড্ডাটা বেশ গাড়ো ও জমাট ভাব নেয়। সেখানেই আমাদের একধরণের বিনী সুতোর সখ্যতা।
সেই আবীর ভাই নিজের থেকে আড্ডা মারতে আসছেন দেখে আমি নিজেও প্রমাদ গুণলাম। মনে হলো, একটা অজানা আশংকা, জল্পনা-কল্পনার থলি নিয়ে তিনি আসছেন। আজকাল ঘরের বাইরে আড্ডাটা তেমন নিরাপদ না।
আবীর ভাইয়ের কথায়, দেয়ালের কান নাকি অনেক লম্বা হয়। আর তার রেস্টুরেন্টের ব্যবসার কারণে তিনি নিজেও জানেন হরেক ধরনের লোকজনের আনাগোণার কথা। অনেকে যে শুধু খেতে আসেন না, চেহারাও মাপতে আসেন তার ফিরিস্তি অনেকবার শুনেছি। অনেকে কয়েকবার এক্সপেরিমেন্ট করে না-কি সাক্ষাৎ ফলও পেয়েছে। কোড কথার সূএ ধরে টিকটিকি এসে হাজির।
তার এই গাল গল্পগুলো সত্যি না হলেও আমার কাছে বেশ রোমাঞ্চকর মনে হতো।
ঠিক মেপে মেপে পাঁচটার দিকে আবীর ভাই হাজির। দরজায় নক। ড্রইং রুমে বসে যথারীতি ম্যাগাজিন ঘাঁটা শুরু। আমি যেতেই সেই আগের মতো বুকে জড়িয়ে পিঠে চাপড় দিয়ে বললেন, কি খবর? ডিস্টার্ব করলাম না-কি? আমি বলি, "ছুটির দিন।
সব শপিং করতে গেছে। বাসায় আমি একা। ভালই হলো। আড্ডা হবে নে"। তাকে ড্রইং রুম থেকে নিয়ে আসলাম আমার স্টাডী রুমে।
এখানেই আমাদের গত আড্ডা হয়েছিল। রাজাকার জামাতীদের সাথে বিএনপি'র গাঁটছড়া বাঁধা নিয়ে পিঞ্চটা গতবার একটু বেশী দিয়ে দিয়েছিলাম বলে ক্ষেপে চা না খেয়েই চলে গিয়েছিল। তবে তিনি রাগটা আমার উপর বেশী করেছিলেন, না তার প্রিয় দলের অকর্মণ্য নির্বোধ নেতাদের উপর করেছিলেন, সেটা আমাকে বুঝতে দেননি।
তাই আজকে প্রথমেই বলে ফেললাম, "আবীর ভাই, আজকে আগেই চা দিয়ে দিতে বলি। রাগ করে উঠে গেলেও যাতে আমার কোন অমঙ্গল না হয়"।
তিনি হাসতে থাকেন। হাসতে হাসতে বলেন, "না আজকে রাগ করবো না"। আমি একটু তাজ্জব। বলি, "কেন?" আবীর ভাই বললেন, "আমরা এখন সেমসাইডে। সব শেষ"।
আমি বলি, "শেষ মানে?"। তিনি বলে উঠলেন, "বড়ো দুই দলের জীবনাবসান ঘটেছে। এখন কুলখানি চলছে। তারপরে, আবার নতুন করে বিয়ে শাদী হবে। নতুন কুটুমরা নতুন পোশাকে আসবে।
একটু উৎসব উৎসব ভাব আসবে"। ক্ষমতার দরজায় ফিতা ধরে দেশবাসী আবার আবদার-আর্জি জানাবে। লোকজন খোশমেজাজে খোশ আমদেদ জানাবে নতুন কুটুমদের"। আমার হাসি চেপে রাখতে পারলাম না।
আমি বললাম, "তাহলে তো ভালই।
বড়ো দল শেষ। এখন ছোট দল বলতে তো একটাই আছে। তারা এখন জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে আসবে। সৎ লোকের গড়াগড়িতে দেশ উদ্ধার পাবে। চারদিকে সুখের বাতাস বইবে।
টুনাটুনীরা গাছে গাছে গান করবে"। আবীর ভাই আমাকে থামিয়ে বললেন, "মিয়া খালি ফাউ ক্যাঁচাল দাও কেন? ফেউরা সবসময়ই পিছে পিছে থাকে। তারা কিন্তু আগে আসে না। এখন নতুন বোতলে পুরনো মদ বিক্রি হবে"। আমি থামিয়ে বললাম, "ভালই তো।
যতো পুরনো হয় ততো নাকি দাম বাড়ে। তিনি বলে উঠলেন, উল্টোও হতে পারে। পুরনো জিনিস এক্সপায়ারড হতে পারে। খেলে প'রে ফুড পয়েজনিং হতে পারে"। আমাদের হাসি ও গাল গল্পের মধ্যে এক প্রস্থ চা শেষ হয়ে গেল।
বেশ ভালভাবেই টের করতে পারছি, আবীর ভাই খুব বিষন্নতায় ভুগছেন। তার বিষন্নতা কৃএিম, সংক্রামিত না জেনুইন তা বোঝার চেস্টা করছি। তিনি বললেন, "মনে আছে এরশাদের ক্ষমতা নেওয়ার পর পর রাস্তায় অনেক মহিলার পেটে আলকাতরা লাগিয়ে শালীনতা ফেরানোর চেস্টা করা হয়েছিল। তার পর প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সেই ভয়কে অমূলক বলে চালিয়ে দেওয়ার চেস্টা করা হয়। এতে আর যাই হোক না কেন অনেক ইসলামিস্টরা আহলাদে দুইপা চেয়ারের মধ্যে তুলে বসে পড়েছিলেন।
ঠিক সেরকম চমক দেওয়ার পালা চলছে। নৈতিকতা, শালীনতা, স্থিতি, স্বস্তি, নিরাপওা, আইন, সততা, স্বচ্ছতার চমক দিয়ে পুরো জাতিকে খুশীতে বাকবাকুম পায়রা মুখস্থ করানো হচ্ছে। লোকজন খুশী। শেষবারের মতো দেশ উৎরে গেল। মার্কেটিং চলছে নতুন পণ্যদ্রব্যের।
লোকজন নতুন মাল খেয়ে আনন্দে বুঁদ হয়ে থাকবে। তারপর আবার শুরু হবে পুরনো ব্যবসা। জাতীয়তাবাদ সুশীল সমাজের নতুন সংজ্ঞায় পুনরুজ্জীবিত হবে। পাকিস্তানী গণতন্ত্র, ইন্দোনেশিয়ান বা থাইল্যান্ডের মডেলের গনতন্ত্র আমাদের দারিদ্র ও হতাশা দূর করবে। যাকে ঠেকানোর দরকার ছিল, তাকে সহজে ঠেকিয়ে দেওয়া হলো"।
কথাটা বলেই আবীর ভাই যেন আড্ডার মধ্যে একটা তৃপ্তির মুড খুঁজে পেলেন। আমি মজা করেই বললাম, "আবীর ভাই, আপনাকে পুরনো ফরম্যাটে পেয়ে খুব জোশ লাগছে। না, ভয় নেই। আপনার অ্যানালাইসিস নিয়ে আমার মনে বিন্দুমাএ সন্দেহ নেই। আপনার র্যাডিকাল আইডিয়াটা যে মরেনি তাতেই আমি খুশী"।
আমি বললাম, "ইন্টারেস্ট রেইট কিন্তু কমবে না। মহাজনী সুদী ব্যবসায় অভ্যস্ত লোকজন যখন ক্ষমতার ক্রীম পাবে তখন কিন্তু পুরো দেশই নিলামে উঠবে। দারিদ্র উওরনের চেয়ে দারিদ্রকে সহনীয় করার মধ্যে বনেদী মহাজনীরা চিরকালই স্বস্তি খুঁজে পেয়েছে। তাই, ঋণ দেয়া কিন্তু বন্ধ হবে না। বরং অক্সিজেন দিয়ে রুগী বাঁচিয়ে রাখা হবে।
রুগী মরলে কিন্তু ক্লিনিক ব্যবসার বারোটা বেজে যাবে। মুমূর্ষ রোগী যতো বেশীদিন বাঁচে ব্যবসার জন্য ততই মঙ্গল"।
স্টাডী রুমের দরজায় বেশ জোরে ধাক্কা। বেশ বিরক্ত হলাম। আবীর ভাইয়ের মুখ থেকে হাসি উবে গেল।
একটা আশংকার ছায়া। বেশ বিরক্ত হয়ে দরজা খুলতেই বেয়ারা কাজের ছেলেটা বললো, "স্যার, ড্রাইভার চলে এসেছে। আপনার না-কি সকাল সকাল কোথায় যাওয়ার কথা"। চোখ মুছে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, স্টাডী রুমে টানা টেবিলের উপর দু'টো চায়ের কাপ পড়ে আছে। বোধ হয় গতকাল রাতের...।
নিয়মিত পড়ুন বাংলা গ্রুপ ব্লগিং [link|http://deshivoice.blogspot.com/|
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।