আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি 'মামুলি'মৃতু্য সংবাদ

'... আমাদের আশার কোনো পরকাল নাই'

আমাদের ফটোসাংবাদিক জাবীদ অপু ঝড়ের গতিতে অফিসে আসেন, আবার ছবি নামিয়ে দিয়ে ঝড়ের গতিতে চলে যান। গতকালও তাই হলো। দুপুর আড়াইটার দিকে ঝড়ের গতিতে তিনি ক্যামেরা নিয়ে এলেন। কম্পিউটারে বসে ছবিগুলো সব নামিয়ে দেখালেন। হঠাৎ একটি ছবিতে আমার চোখ আটকে গেলো।

একজন মানুষ চোখ বন্ধ করে রস্তায় শুয়ে আছে। তাকে ঘিরে মানুষের ভীড়। অপু জানালেন, ছবিটা এক রিকশাচালকের। রিকশা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎ করেই পরে মারা গেছে সে। কাজী শাহেদকে (যিনি এই ব্লগে কেএস মান্না নামে লেখেন) পাঠালাম স্পটে।

বাড়ি থেকেও ঘুরে আসতে। শাহেদ ফিরে এসে যা জানালেন, তা হলো, বাসের হেলপার বেনু অবরোধের কারণে বাস বন্ধ থাকায় গত বার বউ মেয়ে নিয়ে না খেয়ে ছিলো। সেই ভয়ে এবার অবরোধের শুরুর দিনেই অনভ্যস্থ বেনু রিকশা নিয়ে বের হয় রোজগারের আশায়। কিন্তু না খেয়ে রিকশা চালানোর ধকল সইতে না পেরে মারা যায়। সংবাদটি একটি মামুলি মৃতু্য সংবাদ হয়তোবা।

কিন্তু সেই মামুলি মৃতু্য সংবাদের মধ্যে কি কোনো বার্তা লুকিয়ে নেই? আমরা কি বার্তাটা ধরতে পারছি? না কি আমরা অন্ধ, বোবা আর কালা হয়ে গেছি? এখানে শাহেদের তৈরি প্রতিবেদনটি তুলে দিলাম। কিছুটা এডিট করে আজ সমকাল এটি ছেপেছে- গত দফার অবরোধে বাস না চলায় টানা কয়েকদিন অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটাতে হয়েছিলো। এবারের অবরোধের শুরুর দিনই তাই বিকল্প উপায়ে রোজগার করতে রিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন বাসের হেলপার বেনু। না খেয়ে রাস্তায় নামা বেনু দিনভর রিকশা চালানোর ধকল সইতে না পেরে সোমবার দুপুরে রাজশাহী মহানগরীর সাহেববাজার বড় রাস্তায় হঠাৎ করেই ঢলে পরে মারা যান। 'এখন কে দেখবে দেড় বছরের শিশুকন্যাকে?' বেনুর নিথর দেহের পাশে বসে বিলাপ করতে করতে এই একটি প্রশ্নই রাখছেন তার স্ত্রী নূর খাতুন।

সোমবার 14 দলের অবরোধ চলাকালে দুপুর দু'টার দিকে সাহেববাজার বড় রাস্তায় রিকশা নিয়ে বসে ছিলো বেনু। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হঠাৎ করেই সে রিকশা থেকে ঢলে পড়ে রাস্তায়। আশেপাশের মানুষ ছুটে আসেন। পানি ঢালেন কেউ কেউ শরীরে। কিন্তু বেনুর শরীর ততোণে নিথর, মৃতু্য তাকে ছুঁয়েছে।

মর্মান্তিক এই মৃতু্য শোকে বিহ্বল করে দেয় পথচারীদের। লাশ পাঠানো হয় নগরীর হাজরা কলোনি এলাকায় তার বাঁশ ও ছনঘেরা ভাড়া বাড়িতে। স্ত্রী নূর খাতুন প্রস্তত ছিলেন না স্বামীর এই আকস্মিক আগমনের জন্য। স্বামীর নিথর দেহ দেখেও প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি বেনু আর নেই। কেমন করে বিশ্বাস করবেন? কোনো অসুখ-বিসুখও তো ছিলো না।

সুস্থ মানুষ, অবরোধে বাস বন্ধ থাকায় খাবার না জোটার ভয়ে রেলওয়ে স্টেশনের রিকশা গ্যারেজ থেকে রিকশা ভাড়া নিয়ে বেরিয়েছিলেন রোজগারে। স্ত্রী আর দেড় বছরের শিশুকন্যা বাড়িতে অপোয় ছিলেন, বেনু সন্ধ্যায় ঘরে ফিরবে। তারপরে রান্না চড়বে। কিন্তু তা তো আর হলো না। প্রতিবেশী আয়েশা বেগম জানান, গত অবরোধে বাস বন্ধ থাকায় কয়েকদিন বেনুদের বাড়িতে রান্না চড়েনি।

এবারো সেই ভয় তাড়া করায় রিকশাকেই বেছে নিয়েছিলো সাময়িক রোজগারের হাতিয়ার হিসেবে। রাজশাহী মহানগরীর ফুদকীপাড়া এলাকায় বেনুর বাবার বাড়ি। নিহত বেনুর খালু রাম জানান, পরিবারের সবাই হিন্দুধর্মাম্বলী হলেও চারবছর আগে বড় ভাই মানু ও বাবা কুমারকে নিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সে। ফলে আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে বেনু ও তার ভাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ধর্মান্তরিত হবার পর বেনু বিয়ে করে চারঘাটের নতুনপাড়ায়।

স্ত্রী ও দেড় বছরের শিশুকন্যাকে নিয়ে বেনু বাড়িভাড়া নেয় হাজরা কলোনীতে। ছোটবেলা থেকেই সে সংসার চালানোর জন্য বাসের হেলপারের কাজ করতো। বিয়ের পর তার সংসারে খরচ আরো বেড়ে যায়। ফলে দিন এনে দিন খেয়েই বাঁচতে হতো তাদের। স্ত্রী নূর খাতুন জানান, ধর্মান্তরিত হবার কারণে পরিবারের কাছ থেকে সাহায্য ছিলো বন্ধ।

ফলে কোন কারণে বাস চলাচল বন্ধ থাকলে তার রোজগারের আর কোনো পথ থাকতো না। সোমবারও ঘটেছে তাই। নিজেরা না হয় না খেয়ে দিন কাটাতে পারবেন, কিন্তু শিশুসন্তানটি? কখনো রিকশা না চালালেও বেনু সোমবার সেই শিশুকন্যাটির মুখ চেয়েই রিকশা নিয়ে রোজগারে বেরিয়েছিলো। হাসি নামের সেই শিশুটির মুখের হাসি দেখতে বাবা বেনু রোজগারে নামলেও তার নিথর দেহ ঘিরে সেই শিশুও কাঁদছে। এখন তার চোখে কেবলই অনিশ্চয়তার ছায়া।

নূর খাতুনও তাকে আঁকড়ে ধরেই কেঁদে চলেছেন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.