আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জাহাজী জীবনের গল্প (3), লারনাকা থেকে পেরিয়াস

সময়, কবিতা, ছোটগল্প, দেশ, দেশাচার

লারনাকা থেকে রওয়ানা হলাম গ্রীসের এথেন্সের সমুদ্র বন্দর পেরিয়াসে। ফেরার পথে অনেকটা শান্ত সমুদ্র। তাছাড়া লারনাকার সিমেন্টে ভরাট পেট, দোলুনী কম, তাই ভুমধ্যসাগরের জল কেটে কেটে তাই ধীরে গতিতে এগিয়ে চলল আমাদের জাহাজ। আবহাওয়া ভাল, সুন্দর রোদ, চারিদিকে একটু চোখ মেলে তাকানোর সুযোগ পেলাম। আমাদের চলার সঙ্গী শ'খানেক ডলফিন।

ভালো লাগলো উড়ন্ত মাছ দেখে। তবে এদেরকে উড়ন্ত বলা যায় কি না, এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থাকতে পারে। দশ থেকে কুড়ি মিটারের মতো উড়ে আবার ঝাপিয়ে পড়ছে সমুদ্রে। খুব বড় নয়, ছয় থেকে দশ ইঞ্চির মতো লম্বা। মাঝে মাঝে মনে হতো হারিয়ে গেছি কোথাও।

চারিদিকে সমুদ্রের অফুরন্ত নীল জল, উপরের বিশাল আকাশ, আর এই দৃশ্যের সাক্ষী আমাদের মতো গুটিকয়েক সাধারণ মানুষ, একপ্রান্ত থেকে ছুটছি আরেক প্রান্তে। মনে হতো আমাদের সৌভাগ্যের আর কোন তুলনা নেই। তাপরও এই সৌভাগ্য পেরিয়েও ফুটে উঠতো আমাদের ক্ষুদ্রতা জল আর আকাশের অবিরাম খেলায়। তারপরেও অবসর সময়গুলো সমস্যা হয়ে দাড়াঁলো। চিত্তবিনোদনের কিছুই ছিলনা জাহাজে।

বেশীরভাগই ইংরেজী জানতো না ভাল। একটা ভাল আলাপও তাই গড়ে ওঠা সম্ভব ছিল না। জাহাজের লেদ মেশিনের ব্যাবহার শিখিয়ে দিল একজন অভিজ্ঞ নাবিক। একটি কাঠের ডান্ডা কেটে সেই মেশিনের ব্যাবহারে দাবার গুটি তৈরী করলাম নিজ হাতে। কাগজ কেটে ছক তৈরী করা হলো।

একজন ভাল দাবা খেলোয়াড়ও পাওয়া গেল, জাহাজের সোমালিয়ার রেডিও অফিসার। তার নাম জানা নেই। সবাই ডাকত মার্কনী বলে, পরে জানলাম গ্রীক জাহাজে রেডিও অপারেটরদের এই নামেই ডাকা হয়। অবসর সময়টুকু দাবা খেলেই কাটিয়ে দিতাম। আমার এই দাবার ছক অফিসার্স মেসেও পৌছেছিল এবং ওদের সাথে আমাকেও খেলতে হয়েছিল।

একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র ছিল জাহাজের কুক। সবাই তাকে মায়রা বলে ডাকত। অসম্ভব মোটা এই লোক। জাহাজের দোলুনির সাথে নিজেও দুলে রান্না করতো। কোনরকম ঢেউ বা ঝড়ের সময় সামান্য উৎকন্ঠার ছাপও দেখা যেতনা তার চোখে মুখে।

অথচ জাহাজ থেকে ওঠা নামার সময় দু'জনকে দু'পাশ থেকে ধরতে হতো তাকে। ভয়ে কাঁপতো তখন তার শরীর। তার সবচে' বিরক্তি ছিল হয়তো মানুষেরই উপর। সারান গজগজ আর গালাগালি চলতো তার। কেউ পছন্দ করতো না তাকে, তবে তাকে ঘাটানোর সাহস ছিলনা কারো।

গ্রীকরা ইংরেজী জানতো না ভাল। তাদের ইংরেজীর একটা নমুনা না দিয়ে পারছি না। আমকে উপর থেকে ক্যাপ্টেন ফোন করে জানতে চাইলেন, থার্ড ইনজিনিয়ার নীচে আছেন কি না। প্রশ্নটা ছিল 'হ্যাভ থ্রিত্ ইনজিনিয়ার ডাউন' ? আমকেও সেভাবেই উত্তর করতে হলো 'থ্রিত ইনজিনিয়ার নো হ্যাভ ডাউন'। তবে অল্প ক'দিনের মঝে আমরাও কিছুটা গ্রীক শিখে নিলাম।

পরে গ্রীক আর ইংরেজীর জগাখিচুড়ীতেই চলল আমাদের কথোপকথন। একসময় গ্রীক কফিও ভাল লাগতে শুরু করলো। তবে আমাদের খাবারের ীন পরিমান দেখে মায়রাও (পাচক) খুঁজে পেতে বার করলো একটা লঙ্কাগুড়োর শিশি। তাতে একটু রুচি বাড়লেও অলিভ অয়েলের গন্ধে প্রতি অরুচি রয়েই গেল আমার। পেরিয়াসে এসে পৌছলাম।

মাল খালাসের পরও দিন পাঁচেকের মতো থাকতে হবে আমাদের এই বন্দরেই, মেশিনের কিছু ছোটখাট মেরামতির জন্যে। তার অর্থ হচ্ছে মেশিনরুমে আরো বেড়ে গেল আমার কাজ, তেল কালির জঙ্গলে। বাইরের খালাসীদের কাজও নেহায়েৎ কম নয়। নোনা ধরা পুরোনে রং উঠিয়ে আবার নতুন রংএ সাজানো হলো বাক্কিসকে। দুদিন পরেই জানতে পেলাম আমাদের পরবর্তী যাত্রা এবারও খুব দুরে নয়।

সিসিলি দ্বীপে। তবে এই সিসিলির যাত্রাই আমাদের ভুগিয়েছে সবচে' বেশী। চলবে.......।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.