আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জাহাজী জীবনের গল্প: সুয়েজ খাল পেরিয়ে গীজান (সৌদী আরব)

সময়, কবিতা, ছোটগল্প, দেশ, দেশাচার

পেরিয়াসে দু'সপ্তাহ ধরে মেরামত করা হলো বাক্কিস। মেশিনরুমে অকান্ত পরিশ্রম হলো। এরই মঝে জানা গেল, আমাদের পরবর্তী যাত্রা হবে ভুমধ্যসাগর হয়ে সুয়েজ খাল ও লোহিত সাগর পেরিয়ে সৌদী আরবের সমুদ্রবন্দর গীজানে। বোঝাই করা হলো জাহাজ ও কোন এক ভোরে পেরিয়াস বন্দর ছেড়ে রওয়ানা হলাম। সুয়েজ খাল, লোহিত সাগরের কথা এত পড়েছি, শুনেছি, এবার নিজে দেখতে পাব।

এত কষ্টের মাঝেও ভাগ্যবান মনে হলো নিজেকে। বুকের ভেতরে উত্তেজনা বাইরে বাঁধভাঙ্গা উচ্ছাসের মতো ডানা মেললো। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে ফুঁসে উঠলো ভুমধ্যসাগরের নোনা জল। পাঁচদিন একটানা যাত্রার পর ভুমধ্যসাগরের বুকে মিশরের পোর্ট সাইদকে ডানদিকে রেখে সুয়েজ খালের প্রবেশমুখে এসে নোঙ্গর ফেললো আমাদের জাহাজ। আমার মতো এমনি এক সাধারন এই খাল অতিক্রম করবে, ভাবতেও কাটা দিল গায়ে।

তারপরও বেশ ক'দিন প্রবেশমুখেই অপেক্ষায় কাটাতে হলো। জাহাজের ভাঙ্গাচোড়া অবস্থার কারনে খাল পেরুনোর অনুমতি দিতে কতৃপক্ষ গররাজী। তাছাড়া পোর্ট সাইদেই বিদায় নিয়েছে জাহাজের রেডিও অফিসার। তবে দ্বিতীয় সমস্যার সমাধান সহজেই হলো। আমার বন্ধু, যার রেডিও অফিসারের সামান্যতম জ্ঞানও নেই, তাকেই রেডিও অফিসারের পরিচিতি দেয়া হলো কতৃপক্ষকে।

ফরাসীদের সুয়েজ খাল কোম্পানী এই খাল তৈরী করে। আলিয়স নেগ্রেলী নামক এক অষ্ট্রিয়ান এর নকশা তৈরী করেন 1857 সালে। 113 কিলোমিটার দৈর্ঘের এই খাল ভুমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত পোর্ট সৈয়দকে লোহিত সাগরের পারের সুয়েজকে সংযুক্ত করে। 16ই নবেম্বর 1869 সালে এখানে প্রথম জাহাজ চলাচল শুরু হয়। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট 1798 সালে বৃটিশ ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় মিশরকে তার ঘাটি করতে চেয়েছিলেন।

তিনি তার প্রকৌশলী গ্রাতা লেপরেকে এই খাল তৈরী করার উদ্দেশ্যে মাপজোক করার আদেশ দেন। মাপজোক শেষ হবার পর দেখা যায় যে, ভুমধ্যসাগর থেকে লোহিত সাগরের উচ্চতা 9.908 মিটার। এত বেশী উচ্চতা অতিক্রম অসম্ভব মনে হওয়ায় খালের পরিকল্পনা বাদ দেয়া হয়। তাছাড়া 1801 সালে নেপোলিয়ানকেও মিশর থেকে তার সৈন্যবাহিনী সরিয়ে সে দেশ ত্যাগ করতে হয়। 1841 সনে ফরাসী, বৃটিশ ও অষ্ট্রিয়ান প্রকৌশনীরা নতুন মাপজোক করেন।

1846 সালে তাদের পর্যবেক্ষন শেষ হবার পর জানা যায় যে, উচ্চতার এই তারতম্য খাল খননের জন্যে কোন প্রতিবন্ধক নয়। 25 শে এপ্রিল, 1859 সালে আলিয়স নেগ্রেলীর নকশা অনুযায়ী সুযেজ খাল তৈরীর প্রাথমিক কাজ শুরু হয়। প্রায় দেড় মিলিয়ন শ্রমিক, যাদের সিংহভাগই মিশরিয়, এই খাল তৈরীতে কঠোর পরিশ্রম করেন। তাদের মাঝে প্রায় এক লাখ পচিশ হাজার তৈরীকালীন সময়ে কলেরায় মারা যান। সে সময় এত মানুষের বিষুদ্ধ পানীয় জলের সরবরাহ সম্ভব ছিলনা বলেই কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।

এই খালকে ভিত্তি করে অনেক রক্তঝরা যুদ্ধ বাধে। বৃটিশরা দ্বিতীয় বিশ্বয়ুদ্ধের পর এর দখল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। 1956 সালে বৃটিশ, ফরাসী ও ইজরাইলীরা মিলে খালের দখল নেয়ার চেষ্টা করে। তবে জাতিসংঘের দ্রুত হস্তেেপ তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। 1967 সালে মিশর ইজরাইলের ছয় দিন যুদ্ধের এর পুর্ব তীরভাগ ইজরাইলের দখলে চলে যায়।

সেকারনে 1975 সাল অবধি জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। 1975 সালে মিশরের পরিচালনায় চলাচল শুরু হয় আবার। সেসব শ্রমিকের অকান্ত পরিশ্রমে ও মৃত্যুর বিনিময়ে এই খাল তৈরী হয়েছে, তাদের কথা মনে হলো। ইতিহাসে তাদেরকে শ্রমিক বলা হলেও সে সময়ের কথা বিচার করে এদেরকে ক্রীতদাসই বলা যায়। তাদের সাস্থ্যের, জীবনের প্রতি কোন তোয়াক্ক না করেই তাদের মৃত্যুর মুখে পাঠিয়েছে তাদের দেশী বিদেশী প্রভুরা।

হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর শরীর না চলতে চাইলে চাবুক চালিয়েছে। মনে তাদের রক্তেই লোহিত সাগরের নামকরণ হয়েছে। পরে মনে হলো এ সাগরের নাম অনেক আগে থেকেই লোহিত সাগর। যাই হোক না কেন, ওদের কথা ভেবে ভার হয়ে উঠলো মন। খালের পাড়ে দাঁড়ানো লাখ লাখ ক্রীতদাসের কথোপকথন, আহাজারি আর যন্ত্রনাক্ত চিৎকার যেন শুনতে পেলাম।

সকালের নাস্তা শেষে এসব নিয়ে ভাবছিলাম, ইনি্জনের ঘড় ঘড় আওয়াজ আর নাবিক সহকর্মীদের হৈ চৈ এ নিজের ভেতরে ফিরে এলাম। একজনকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, এখনই ছেড়ে যাচ্ছে জাহাজ। বন্দর কতৃপক্ষ অনুমতি দিয়েছেন খাল অতিক্রম করার। তবে বেশ টাকা নাকি ঢালতে হযেছে। সবখানেই একই অবস্থা, টাকাই মহৌষধ ! কিন্তু তারপরেও নোঙ্গর ছেড়ে নড়লো না জাহাজ।

মেশিনে গোলমাল। ঠিকঠাক করতে করতে ছাড়ার সময় পেরিয়ে গেল, সুতরাং অপেক্ষা করতে হরে আরো এক দিন। শাপে বর হল। নিজের ভাবনার ভেতরে তলিয়ে গেলাম আবার। পরদিন সুয়েজ খালের বুক চিরে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে আমাদের জাহাজ।

দু'পাশে মরুভুমি। মনে হলো লাখ লাখ কৃতদাস খুন্তি কোদাল নিয়ে দাড়িয়ে আছে দুই পাড়ে। আমাদেরকে যেন হাত তুলে থামাতে চাইছে, তাদের উপর অত্যাচারের কথা বলতে চাইছে। তাদের রক্তের উপর দিয়ে যে চালিয়ে যাচ্ছি আমাদের জাহাজ, তা মনে করিয়ে দিতে চাইছে বারবার। সামান্য পরেই আমার নিজের ডিউটির সময় হলো।

মেশিনরুমে ঢুকে ওদের দৃষ্টির তীব্রতা থেকে যেন পালিয়ে বাঁচলাম। 2240 কিলোমিটার লম্বা এই লোহিত সাগর। চওড়ায় সর্বোচ্চ্ 260 কিলোমিটার, গল্প অফ এডেন বা আরব সাগরে মেলার আগে মাত্র 29 কিলোমিটার। সেখানে গভীরতা কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র 130 মিটার। আরব সাগরের সাথে জলের আদানপ্রদান এই কম উচ্চতার কারনে এতই বাধাগ্রস্থ যে, এসাগরে লবনের ঘনত্বও (4.2%) অন্যান্য সাগরের(3.5%) চেয়ে বেশী।

দু'পাশের মরু পাহাড়ের ছায়ায় একটু লাল আভা সাগরের জলে, সেখানেই হয়তো লুকানো নামকরণের স্বার্থকতা। সুয়েজখাল পেরুনোর তিনদিন পর লোহিত সাগরের বুবে গীজান সমুদ্রবন্দর থেকে প্রায় এক মাইল দুরে সমুদ্রের বুকে এসে নোঙ্গর ফেললাম আমরা। একমাস থাকতে হয়েছে আমারে বহির্বন্দরে লোঙ্গর ফেলে। এখানকার বিচিত্র অভিজ্ঞতা, অনুভূতি সব লিখতে পোষ্টটি আরো বড় হয়ে যাবে বলে বাকীটুকু পরের অধ্যায়ের জন্যে রেখে দিলাম।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.