সময়, কবিতা, ছোটগল্প, দেশ, দেশাচার
দ'ুদিন পর কোন এক বিষন্ন ভোরে জাহাজ থামল লারনাকায়। আমার ডিউটি ছিলনা, কান্ত শরীরে কেবিনে ঘুমে মগ্ন। বাইরে অন্য খালাসীদের হাকডাকে ঘুম ভাংল। দ্রুত বাইরে এসে দাঁড়ালাম। সামান্য ঝিরঝিরে বৃষ্টি লারনাকার আকাশ থেকে ঝড়ে পড়ছে মাটিতে, সমুদ্রের নোনা জলে।
সমুদ্র পাড়ের এক অপুর্বসুন্দর শহর লারনাকা। সাইপ্রাস নিয়ে গ্রীস আর তুরস্কের টানাহেচড়া কাস্মীর সমস্যার কথা মনে পড়িয়ে দেয়। দু'দেশের নিয়ন্ত্রণে দুটো অংশ। লারনাকা গ্রীস-নিয়ন্ত্রিত অংশের রাজধানী। খ্রিীষ্টপুর্ব তেরোশ শতাব্দীতে এই শহর প্রতিষ্ঠা করা হয়।
খ্রীষ্টজস্মেরও আগের বিখ্যাত চিন্তাবিদ সেনন এই শহরেরই বাস করতেন। তখন এ শহরের নাম ছিল কিটিয়ন।
লারনাকা ভালো করে দেখা হয়নি। এর মাঝেই কিছুটা পরিবর্তন এসেছে আমার কাজের ধারায়। যান্ত্রিক বিষয়গুলো নিয়ে আমার জানাশোনা আছে বলে আমাকে মেশিরঘরে কাজ দেয়া হলো।
দুপুর বারোটা থেকে বিকেল চারটে ও রাত বারোটা থেকে সকাল চারটে অবধি আমার কাজের সময়। এ সময়টায় মেশিনরুমে থাকা ও মেশিনের তদারকি আমার দ্বায়িত্ব। একনর ইনজিনীয়ার একই সময়ে দ্বায়িত্বে থাকবেন। তবে তার সময় কাটে অফিসার্স রুমে ঘুমিয়ে বসেই। দরকারে একবার দুবার নীচে নেমে আসেন।
সকালে নাস্তা ছেড়ে বন্ধুকে সাথে নিয়ে শহরের কেন্দ্রে ছুটলাম। সামান্য ঘুরে এক কফিশপে বসলাম দুজনে। এই কফিশপেই প্রেমিক প্রেমিকার প্রকাশ্য চুম্বন চোখে পড়ল। লজ্জা পেলাম, অবাকও হলাম বেশ। পুরোরো ঐতিহ্যের ছড়ানো ছিটানো শহর এই লারনাকা।
অনেক কিছু দেখার ইচ্ছে হলেও জাহাজে ফিরে আসতে হলো। আমরা তো আর ট্যুরিস্ট নই, এখন খেটে খাওয়া মানুষ।
আমাদের সম্পর্কে কিছু বলা দরকার বলে মনে করছি। দুজনই সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরিয়েছি। আমার সঙ্গী আসলে আমার এক বন্ধুর বড় ভাই।
ওনি পড়াশোনার সাথে সাথে সাংবাদিকতাও করেছেন। দেশ থেকে বেরিয়েছিলাম চারজন। উদ্দেশ্য দেশ দেখা ও উচ্চশিক্ষা। তার প্রস্তুিত হিসেবেই জাহাজে এই কাজ। এ অবধি আসতে অনেক চড়াই উৎরাই পেরোতে হয়েছে।
ইস্তাম্বুলে এসে আলাদা হতে হয়েছে আমাদের আর্থিক কারনে। একজন জাহাজে যোগ দিয়েছে আগেই, আরেকজন ফিরে গেছে তখনকার শাহ্ এর দেশ ইরানে। আমরা দ'জন ইস্তাম্বুলে হাড়ভাঙ্গা খাটুনীতে রসদ জোগাড়ের পর জাহাজে। জাহাজে যা রসদ জোগাড় তা পরে লাগবে পড়াশোনার কাজে।
জাহাজ সম্পর্কেও আরো কিছু বলা দরকার।
আগেই বলেছি, ছাবি্বশ বছরের পুরানো। তিনটে জেনারেটারের দুটোই সবসময় বিকল। মেশিন ডিজেল চালিত। প্রায়ই নানা ধরণের গড়বড় দেখা যায়। মাল তোলা ও খালাসের জন্যে বাস্পচালিত ক্রেন রয়েছে।
তবে আধুনিক বন্দরগুলোতে বন্দরেরই ইলেকট্রিক ক্রেন ব্যাবহার করা হয়। বাস্পচালিত ক্রেন ব্যাবহার করা অনেক গরুরগাড়ী টানার সমতুল্য। কাহিনী বর্ননায় এর কথা পরে আসবে। জাহাজের ত্রু-সংখ্যা বাইশজন। এদের মাঝে সাতজন অফিসার।
এদের ছ'জনই গ্রীক, একজন ইথিওপিয়ান। সাধারন খেটে খাওয়াদের মাঝে আমরা দু'জন বাংলাদেশী বাদে অন্যরা সোমালিয়া, ইজিপ্ট, নাইজেরিয়া ও ঘানার লোক।
লারনাকায় পোর্টের ক্রেন দিয়েই সিমেন্ট তোলা হল। কাল সকালেই আমাদের রওয়ানা হতে হবে গ্রীসে পেরিয়াসে। জাহাজের দোলুনীর কথা ভাবলেই জ্বর আসে শরীরে।
অন্যরা দুধ চিনি ছাড়া কালো কফি খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। এমনিতেই গ্রীক কফি বেশ কড়া। এর মাঝে দুধ চিনি বাদ দিলে তো বিষময় এর স্বাদ! তারপরেও চালাতে হবে। সামনের ভাল দিনের আশায় রাত বারোটায় আবার গিয়ে ঢুকলাম মেশিনরুমে।
চলবে......
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।