কবিতা, কলাম, গল্প, ব্যক্তিগত কথামালা
[লেখাটি যায়যায়দিনের আর্টঅ্যান্ড কালচার ম্যাগাজিনে 31 আগস্ট 2006 তারিখে প্রকাশিত]
অমর্ত্য সেনের নতুন বই: আইডেন্টিটি অ্যান্ড ভায়োলেন্স: দ্য ইলিউশন অব ডেসটিনি
অ ব নি অ না র্য
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের সমপ্রতি প্রকাশিত বই আইডেন্টিটি অ্যান্ড ভায়োলেন্স: দ্য ইলিউশন অব ডেসটিনি। মানুষের মধ্যে একক আত্মপরিচয়ের সংকট থেকে সময়ের সাথে সাথে সহিংস আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। কিন্তু মানুষের পরিচয় কি কেবল একটি? কেনইবা মানুষের ধারণা হয় যে, সে কেবল একজন মুসলিম, বা কেবল একজন বাঙালি? এসব আত্মপরিচয়ের সংকটের ঐতিহাসিক সামাজিক রাজনৈতিক প্রোপটে আলোচনা করেছেন এই অর্থনীতিবিদ। আমরা জানি, অমর্ত্য সেন আগে দ্য আর্গুমেন্টেটিভ ইনডিয়ান নামে একটি বই লিখেছেন, যার অর্থ দাড়ায় যুক্তিপ্রিয় ইনডিয়ান। পশ্চিমা দুনিয়া সবসময়ই প্রচার করে যে, গণতন্ত্র ধর্মীয় স্বাধীনতার জন্মস্থান পূর্বে নয়, পশ্চিমে।
অমর্ত্য সেন লিখেছিলেন, প্রাচ্যের নিজস্ব পদ্ধতিই আছে সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়ার, নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের, এবং ধর্মীয় সহনশীলতারও। চোখে আঙুল দিয়ে তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন, সত্য প্রকাশের কারণে ধর্মের নামে পশ্চিমে কীভাবে জিওর্দানো ব্রুনোকে প্রাণ দিতে হয়েছিলো। অথচ এর বিপরীতে ষোড়শ শতাব্দীতে মোগল সম্রাট আকবরের ঘোষণা_ 'ধর্ম নিয়ে কোনো ব্যক্তিরই হস্তপে করা উচিত নয়, এবং যার যার পছন্দমতো ধর্ম গ্রহণ করার স্বাধীনতা সবার আছে। ' এরকম যুক্তিশীল একজন অর্থনীতিবিদ সদ্যপ্রকাশিত বইয়ে অনেকটাই আবেগ বা সংবেদনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। আইডেন্টিটি অ্যান্ড ভায়োলেন্স-এর রিভিউয়ে অনেকইে একই মন্তব্য করেছেন।
সবচেয়ে বেশি যে উদাহরণটি সবাই ব্যবহার করেছেন, সেটা ঘটেছে অমর্ত্য সেনের আদ বাসভূমি পুরান ঢাকার ওয়ারিতে।
ওয়ারির বাড়িতে চুয়ালি্লশ সালের এক বিকেলে তাঁর সামনেই ঘটে এক ভয়ংকর দৃশ্য। সময় বলে দিচ্ছে, অবিভক্ত বাংলায় তখন হিন্দু-মুসলিম রায়ট চলছে। বাড়ির দরজায় তীব্র আর্তনাদ। দেখলেন, আহত রক্তাক্ত এক লোক দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করছে।
পরে জানা যায়, লোকটার নাম কাদের মিয়া। মুসলিম দিনমজুর লোকটাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান অমর্ত্যর বাবা শ্রী আশুতোষ সেন। সেখানেই লোকটি মৃতু্যবরণ করেন। অমর্ত্য সেনের মাধ্যমেই আমরা জানতে পারি, রায়টের সেই ভয়ংকর দুঃসময়ে, বিশেষত হিন্দু-প্রধান এলাকা বলে দিনমজুর লোকটাকে বাড়ির বাইরে যেতে তাঁর স্ত্রী নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু, বাইরে যাওয়া ছাড়া তাঁর কিছু করার ছিলো না, খাবার জোগাড় তো করতে হবে! অমর্ত্য সেন বলেন, কেবলমাত্র অর্থনৈতিক পরাধীনতা তথা প্রচণ্ড সেই দারিদ্রের কারণেই ওই সময়েও লোকটাকে রিস্ক নিতে হয়েছিলো, যার প্রতিদান হিসাবে মৃতু্যকে তিনি বরণ করেছিলেন।
অমর্ত্য সেনের প্রবন্ধগ্রন্থ "আইডেন্টিটি অ্যান্ড ভায়োলেন্স"-এর রিভিউয়ে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার রিভিউয়ার জন গ্রে উপরোক্ত ঘটনার প্রসঙ্গক্রমে আরো একটি ঘটনার কথা আমাদের সামনে তুলে ধরেন। এবং বলেন, একইরকম ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ভিন্ন ভিন্ন দর্শনের জন্ম নেয়া সম্ভব। দ্বিতীয় ঘটনার প্রত্যদর্শী ইসাইয়াহ বার্লিন। রুশ বিপ্লবের সময় পেত্রোগ্রাদে তাঁর সামনে ত-বিত মৃতপ্রায় এক ব্যক্তিকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে অন্য একদল মানুষ। এ-ঘটনা বার্লিনের মনে হানাহানির প্রচণ্ডতার ভয়ংকর চিরস্থায়ী ছাপ ফেললেও তিনি কখনো শান্তিবাদী ছিলেন না, বা বিপ্লবের বিরুদ্ধাচারীও ছিলেন না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সরকারী অফিসিয়াল যোদ্ধা ছিলেন তিনি। অন্যান্য মুক্তমনা চিন্তাবিদদের সঙ্গে বার্লিনের পার্থক্য এই, তিনি মনে করেন, মানুষ স্বাধীনতা চায় বটে, আবার একে ভয়ও পায়, এবং অনিরাপত্তার দরুণ একসময় সে আগ্রাসী হয়ে ওঠে।
আইডেন্ডিটি অ্যান্ড বায়োলেন্স-এ অমর্ত্য সেন নিজের জবানীতে বলেন, "ঘটনাটা শুধু রাতের ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মতো নয়, রীতিমতো দুর্বোধ্য মনে হয়েছে আমার কাছে। শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানরত মানুষগুলো কী কারণে হঠাৎ একে অপরের উপর আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেলো, যার ফলে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটলো? গরীব সেই দিনমজুরকে কেন শুধুমাত্র মুসলিম গোত্রভূক্ত বলে শত্রু ভাবা হলো, সে তো আরো আরো গোত্রেরও একটা অংশ? কিংকর্তব্যবিমূঢ় একটি শিশুর প েআইডেন্টিটির লড়াই বোঝা নিঃসন্দেহে কঠিন। অবশ্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় পরিণত মানুষের পওে এটা বোঝা সহজ নয়।
"
অমর্ত্য সেন চুয়ালি্লশের ঘটনাটি প্রত্য করে যেভাবে সেটার ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেটার অনেকখানি জুড়ে আছে আবেগ। তাঁর মতো অ্যাকাডেমিক প্রফেসরের কাছে কাটখোট্টা দার্শনিক কথার বাইরে আবেগ প্রত্যাশিত নয়। এ-বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, আউটলুকের রিভিউয়ার শুদ্ধব্রত সেনগুপ্ত। রিভিউয়ের শুরুতেই তিনি বলেন, একজন যুক্তিবাদী ইনডিয়ানও মাঝেমধ্যে বিস্ময়করভাবে আবেগী হয়ে ওঠেন। এমনকি সেনের 'আইডেন্টিটি অ্যান্ড ভায়ালেন্স: দ্য ইলিউশন অব ডেসটিনি'-কে তিনি 'দ্য প্যাশন অব অমর্ত্য' বলাটাই যুক্তিযুক্ত মনে করেন।
নয়টি চমৎকার প্রবন্ধের মাধ্যমে বইটিতে কালচার এবং আইডেন্টিটি বিষয়ে নির্বিচার ধারণার ফলে উদ্ভূত সহিংসতা তথা বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার হুমকি নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন অমর্ত্য সেন। রিভিউয়ার সেনগুপ্ত বলছেন, অমর্ত্য তাঁর ােভ, বেদনা, উল্লাস, বিরক্তি, সুখানুভূতি, প্রত্যাশা কিংবা মিশ্রপ্রতিক্রিয়া প্রকাশে সৎ ছিলেন। বইয়ে সেনের হাসির শব্দ পাওয়া যায়, তাঁর অভিযোগ সুস্পষ্ট, এমনকি কখনো কখনো তাঁর দীর্ঘশ্বাসের শব্দও শোনা যায়। তাঁর আগের গ্রন্থ 'দ্য আর্গুমেন্টেটিভ ইনডিয়ান'-এর অনেক বিতর্ক নিয়েও তিনি আলোচনা করেছেন এই বইতে।
যুক্তির পথকে সম্রাট আকবরের ভাষায় অমর্ত্য সেন বলেছেন রাহ-ই-আক্ল।
সেনগুপ্ত প্রশ্ন করেছেন, সংবেদনশীলতার উষ্ণতা কি যুক্তির পথকে স্পর্শ করতে পারে? উত্তরও নিজেই দিয়েছেন, অমর্ত্য সেনের নৈতিক দার্শনিকতার পাঠ থেকেই বোঝা যায়, এটা সম্ভব।
রিভিউয়ার সেনগুপ্ত নৈতিক দার্শনিক অমর্ত্য সেনের সঙ্গে অর্থনীতিবিদ সেনকে তুলনা করেছেন বন্ধুত্বপূর্ণ সংলাপী হিসাবে, আবার নাস্তিবাদী আলোকিত বুদ্ধিজীবি সেনকে তুলনা করেছেন সংবেদনশীল বাঙালীর সংগত হিসাবে। তিনি বলেন, আইডেন্টিটি অ্যান্ড ভায়োলেন্স-এ সেনের যুক্তিকে সামাজিক শক্তি হিসাবে সহানুভূতি চর্চার অনুশীলন বিবেচনা করা যায়। অমর্ত্য সেনের মতে, এই সহানুভূতির কারণেই মানুষ নিজেকে নিজেদের একজন হিসাবে ভাববার প্রেরণা, আবার এই সহানুভূতিই অপর ভাবতে শেখায়। কিন্তু সেন বলেন, আমাদের পরিচয় একক কিছু নয়।
একজন মানুষ একইসঙ্গে এশিয়ান, ভারতীয় নাগরিক, বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত বাঙালি, আমেরিকা বা লন্ডন প্রবাসী, অর্থনীতিবিদ, অল্পঅল্প দর্শনচর্চাকারী, একজন লেখক, সংস্কৃত-বিশেষজ্ঞ, দৃঢ়ভাবে গণতন্ত্র এবং সেকু্যলারিজমে বিশ্বাসী, একজন পুরুষ, নারীবাদী, ধর্মকর্মে অবিশ্বাসী, জন্মসূত্রে হিন্দু, অ-ব্রাহ্মণ এবং পরকালে অবিশ্বাসী হতে পারেন। তাতে ওই ব্যক্তির কোনো একটি পরিচয়েরও অসত্যতা প্রমাণিত হয় না। বরং এতে করে মানুষের ধর্মীয় রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক বুদ্ধিবৃত্তিক ইত্যাদি ভিন্নভিন্ন পরিচয়ের প্রতি সমানভাবে সম্মান দেখানো সম্ভব হয়। কিন্তু এগুলোর মধ্য থেকে কেবলমাত্র একটি পরিচয়কে এক এবং অদ্বিতীয় পরিচয় ভাবা হলে বাকিগুলোকে অসম্মান করা হয়, ক্রমে বাকি পরিচয়গুলোকে অপর মনে হয়। আত্মপরিচয়ের প্রতি অতি-সম্মান অপরের পরিচয়ের প্রতি সহিংস করে তোলে।
মানুষের একক পরিচয়ের এই ভাবনা পুরোমাত্রায় ভুল, এবং সেটা বিপজ্জনকও হতে পারে। মুসলিমদেরকে কেবলমাত্র ধমর্ীয় পরিচয়ে বিবেচনা করে এবং তাদেরকে 'অ্যান্টি ওয়েস্টার্ন' অভিহিত করে "ওয়ার অন টেরর" নামক সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে কিভাবে স্যামুয়েল হান্টিংটনের "ক্যাশিং সিভিলাইজেশন" থিওরির ব্যবহার হয়েছে, সেটা সুুনিপুণভাবে তুলে এনেছেন অমর্ত্য সেন। বিভিন্নভাবে আইডেন্টিটি অ্যান্ড ভায়োলেন্স বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় আইডেন্টিটি নিয়ে সমসাময়িক রাজনীতির সময়োপযোগী সমালোচনা করলেও সেনের সমালোচনায় বাস্তববাদিতার ব্যাপ্তির ঘাটতি রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন দ্য গার্ডিয়ান বিভিউয়ার জন গ্রে। তিনি আরো বলেন, একটি জাতিকে কয়েকটি কমু্যনিটি এবং ধর্মের সঙ্ঘ হিসাবে দেখতে গান্ধির অনীহার সঙ্গে সমাজে বিদ্যমান সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের তুলনা করেছেন সেন। ফলে সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের বিকল্প হিসাবে সেন যা দেখিয়েছেন সেটা এক ধরণের উদার জাতীয়তাবাদ।
দুর্ভাগ্যক্রমে, জাতীয়তা কিভাবে এবং কত কিছুর বিনিময়ে অর্জিত হয় সেটা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন সেন। কমু্যনিটির উৎপীড়ন থেকে ব্যক্তির মুক্তির জন্য আধুনিক জাতিব্যবস্থা অনেক কিছুই করেছে, কিন্তু তার জন্য অনেক মূল্য গুনতে হয়েছে। প্রায় সর্বত্রই, দীর্ঘমেয়াদি সহিংসতা একটি জাতি-রাষ্ট্র গঠনের মূল প্রক্রিয়ার একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইনডিয়ার স্বাধীনতার সময় কমু্যনাল রায়ট তাই ব্যতিক্রম কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্রও আধুনিক জাতি হয়েছে ধ্বংসাত্মক সিভিল যুদ্ধের মধ্য দিয়ে, ফ্রান্স স্বাধীন হয়েছে নেপোলিয়নের যুদ্ধের পর।
আফ্রিকা এবং বলকান অঞ্চলেও বহু হাত ঘুরে, গোত্রগত অনেক সংঘাত পেরিয়ে, গোত্রগত পরিশৃদ্ধতার নামে অসংখ্য প্রাণহানির পরে স্বাধীন তথা আধুনিক রাষ্ট্রের মর্যাদা পেয়েছে; চীনের বর্তমান আধুনিকায়নও অসংখ্য তিব্বতী এবং মুসলিম সংখ্যালঘুদের উপর শোষণের মধ্য দিয়েই হচ্ছে। এমনকি উদার জাতীয়তাবাদও সহিংসতার জন্ম দিয়েছে ব্যাপকভাবে। বরং, তুলনামূলকভাবে সেনের সমালোচনার মূল ল্যবস্তু মাল্টিকালচারালিজম এসবের সাপে েগৌণ।
সেনের বিশ্লেষণের মধ্যে গভীর অবাস্তববাদিতার উপস্থিতি আছে বলে উল্লেখ করে জন গ্রে বলেন, এটার কারণ সলিটারিস্ট বা এককপরিচয়বাদিতার বিষয়টার শক্ত বিশ্লেষণে সেন অপারগতা দেখিয়েছেন। সেন বলছেন, "বহুত্ববাদের এই পৃথিবীতে একত্ববাদের এত জয়জয়কার অবস্থার কারণটা একটা বড় প্রশ্ন।
" এখানে সেনের কিংকর্তব্যবিমূঢ় হৃদয়ের স্পর্শ পাই আমরা। অন্যান্য উদার দার্শনিকদের মতোই অমর্ত্য সেনও মনে করেন, মানুষে মানুষে দ্বন্দ্বের কারণ হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক ভ্রান্তি। কিন্তু, সলিটারিজমের ভ্রান্তি যদি এতোটাই স্পষ্ট হয়, তাহলে এতো অসংখ্য মানুষের অবিচল আস্থা কেন আজো বিদ্যমান? সেন বারবার হিংসুটে প্রচারকদের হস্তেেপর কথা বলেছেন। সেন লেখেন, "সন্ত্রাসবাদের প্রভুদের সমর্থনে নিষ্পেশিত জনগণের মধ্যে যুদ্ধবিবাদপ্রিয়তা এবং একত্ববাদের আরোপের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপ েসহিংসতা উস্কে দেয়া হয়। " কিন্তু গ্রে প্রশ্ন করেন, লোকজন কি আসলে এতোটাই বোকা? নাকি উদার দার্শনিকের বোঝার ভুল এটা?
সাদ্দামের শাসন পরবর্তী ইরাকের সামপ্রদায়িক সংঘাত প্রসঙ্গে অমর্ত্য সেন লেখেন, "এটা বিস্ময়কর নয় যে, একটা মানুষের যতগুলো আইডেন্টিটি আছে সেগুলোর মধ্য থেকে ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আইডেন্টিটিগুলো ছাড়া অন্যগুলো উপো করার মাধ্যমে সামপ্রদায়িক সংঘাত এড়ানোটা বরং সমস্যাসংকুল।
" অনুমান করা যায়, ইরাকের সামপ্রদায়িকতা বুদ্ধিবৃত্তির বিশৃঙ্খল অবস্থার ফল_ সেটা আগের ইরাকের না বর্তমান পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কতর্ৃক পরিচালিত ইরাকের সেটা অস্পষ্ট। কিন্তু, মানুষের বিভাজন সাধারণ কোনো ভুলের ফলাফল নয়। অনেকগুলো কারণ আছে সেটার, যেমন স্বার্থের দ্দন্দ্ব, প্রতিদ্বন্দ্বীদের মতা কাঠামো, সম্পদ লুণ্ঠনের প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। ইরাকের উত্তর-উপনিবেশিক কাঠামোতে জনসাধারণ কেবলমাত্র গোত্রগত এবং ধর্মীয় দিক থেকেই বিভাজিত নয়, সেখানে মজুদ তেলের মালিকানার প্রসঙ্গও জড়িত। সাদ্দামের শাসন পতনের অর্থ ইরাকের রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙে পড়া এবং পুরো দেশ জুড়ে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হওয়া।
শিয়া, সুন্নী আর কুর্দিদের মধ্যে বিরোধ লেগেই আছে কেননা মানুষের আত্মপরিচয় তথা আইডেন্টিটি নিয়ে তাদের মধ্যে ভুল ধারণা আছে। অরাজকতার বর্বর যুক্তির ফাঁদে পড়ে নিজেদের টিকে থাকার তাগিদে প্রজন্ম প্রজন্মান্তরে পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। এখন এই যুক্তিই চলে আসছে যে, এর সমাধান বিভক্তির মধ্যে, কিন্তু ইরাক ভেঙে ছোট ছোট স্থায়ী রাজ্যে বিভাজনের আগে আবার অসংখ্য মানুষ হত্যার ইতিহাস হবে, ঠিক যেমন ঘটেছিলো ইনডিয়া বিভাজনের সময়।
সেনের মতো একজন উদার যুক্তিবাদীর জন্য প্রবন্ধটি একটি বিশ্বাস থেকে উৎসরিত যে, আইডেন্টিটির সংঘাত ভুল বিশ্বাসের ফল। তিনি মেনে নিতে পারেন না যে, এটা মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্য।
কিন্তু বার্লিনের মতে, যুক্তির ভুলের কারণে স্বাধীনতা এবং নিয়মকানুন ভেঙে পড়ে না। বাংলায় যারা দিনমজুর লোকটিকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেছে, কিংবা যে মানুষগুলো পেত্রোগ্রাদে মুমূর্ষু মানুষটিকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিলো তাদের কোনো ভুল নেই। তারা যা করেছে তা করেছে তাদের ভয় থেকে, তাদের হিংস্রতা থেকে। গ্রে বলেন, এসব নৃশংসতা মানুষের মধ্যকার অনেক গভীর বিষয়, সেনের কনসেপচুয়াল থেরাপি দিয়ে এসব দূর হবার নয়। এ সত্য যদি তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য মনে না হয়, তাহলে বোঝা যাচ্ছে, আইডেন্টিটি নিয়ে পৃথিবীব্যাপি সহিংসতা দূরীকরণের বিষয়টা সেন যতোটা ব্যাপক গভীর ভাবছেন তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যাপক, অনেক গভীর।
বইটিতে আরো একটি বিষয়ে অমর্ত্য সেন জোর দিয়েছেন। সেটা হচ্ছে ঋণ স্বীকার করা। বিভিন্ন কারণে পূর্ব পশ্চিমের কাছে ঋণী, পশ্চিমও অনেক বিষয়ে পুর্বের কাছে ঋণী। তাছাড়া, এমন অনেক কিছুই আছে যেগুলো সবাই জানে এক কালচার থেকে এসেছে বস্তুত এসেছে অন্য কালচার থেকে। একেবারেই ইনডিয়ান ডিশ মনে হলেও, ভিনডালু এসেছে মূলত পতর্ুগালের মরিচ থেকে; জ্যামিতিতে সাইন ফাংশনের উৎপত্তি ইওরোপে ভাবা হলেও, এটার উৎপত্তি আসলে ইনডিয়ায়।
আইডেন্টিটি প্রশ্নে অমর্ত্য সেন লেখেন, "যখন কিগালির একজন হুতু দিনমজুরকে জোর করে ভাবানো হচ্ছে যে সে কেবলমাত্র হুতু এবং তাতসিসদের হত্যা করা তার দায়িত্ব... তখনো সে কিন্তু কেবল হুতু নয়, সে একজন কিগালিয়ান, একজন রুয়ান্ডান, একজন আফ্রিকান, একজন দিনমজুর এবং একজন মানুষ। " তিনি আরো লেখেন, "আমাদের স্বাভাবিক জীবদ্দশাতেই আমাদেরকে অনেকগুরো গ্রুপের সদস্য হিসাবে পাই। " নিউইয়র্ক টাইমসের রিভিউয়ার কেনজি ইয়োশিনো প্রশ্ন তোলেন, বাক্যটির মধ্যে উপলব্ধির যে বিষয়টি সেখানেই এটার শক্তি, কিন্তু বাক্যটির দুর্বলতা এই যে, এর মধ্যে ব্যাখ্যা নেই কেন এরকম ঘটে। এবং আমরা সে সম্পর্কে অজ্ঞাতই থেকে যাচ্ছি। এমনকি তিনি এও প্রশ্ন করেন, এটা কি এ-কারণে যে, আইডেন্টিটির সমস্যা যে পরিমাণ সহিংসতা ঘটায়, সহিংসতাও কি সে পরিমাণ আইডেন্টিটি ক্রাইসিস ঘটায়?
আশিস কুমার সেনের নেয়া অমর্ত্য সেনের সাক্ষাৎকার
আশিস কুমার সেন: বিশ্বশক্তি হিসাবে ইনডিয়াকে যে পর্যায়ে বিবেচনা করা হচ্ছে, আপনার কি মনে হয় এটা একটু বাড়াবাড়ি?
অমর্ত্য সেন: না, এখনো পর্যন্ত এটাকে খুব বেশি অতিমূল্যায়ন বলা যাবে না, কেননা আগে বরং একটু কম মূল্যায়ন করা হয়েছে (উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, দশকের পর দশক ধরে গভীর পর্যবেণ শেষে চীন খুব সমপ্রতি ইনডিয়াকে সিরিয়াসলি বিবেচনায় আনতে শুরু করেছে)।
কিন্তু বৈশ্বিক প্রোপটে ইনডিয়ার উত্থান অনকে ইনডিয়ানদের জন্যই বেশ সুখকর, আর এর ফলে তাদের মধ্যে এক ধরনের আত্মপ্রসাদ বা পূর্ণতার অনুভূতি জন্ম নিলে সেটা বিপজ্জনক হবে। আমাদের উচিত সেটা সতর্কতার সাথে বর্জন করা।
আশিস কুমার সেন: ইনডিয়ার এই পরিবর্তনের কারণ কী ধারণা করা যেতে পারে? ইনডিয়া ব্যতিক্রমী পদ্ধতিতে কাজ করছে বলে হচ্ছে? নাকি আগের সমাজতান্ত্রিক ইতিহাস মুছে ফেলে আমেরিকার মতো বিশ্বশক্তি কতর্ৃক অনুমোদিত অর্থনৈতিক কাঠামো গ্রহণ করার জন্য?
অমর্ত্য সেন: ইনডিয়ার সমাজতান্ত্রিক অতীত বলতে আপনি ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন, আমি নিশ্চিত নই। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় সার্বজনীন প্রাথমিক শিা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, ভূমি অধ্যাদেশ পুনর্নিমাণের মতো মুখ্য অর্জনগুলো যে দেশটার হয়নি তাকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা যায় না। অন্য অনেক েেত্র ব্যর্থতা থাকলেও রাশিয়া, চীন, কিউবা, ভিয়েতনাম বা অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে এসব েেত্র প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে।
এখন ইনডিয়ার 'সমাজতন্ত্র' বলতে আপনি যদি অতিবিস্তৃত আত্মঘাতী রাজ্যভিত্তিক লাইসেন্স পদ্ধতি, বা শ্বাসরুদ্ধকারী স্থানীয় উদ্যোগ কিংবা মডার্ন ইন্ডাস্ট্রি বা মডার্ন সার্ভিস সেক্টরের উন্নতি বোঝান, তবে এই পরিবর্তনকে গুরুত্বপূর্ণ বলা যায়। অবশ্য সেেেত্র সাম্যবাদী মানবতাবাদ পরিহার করারও তেমন প্রয়োজন নেই, যা জওররলাল নেহরু বা ইনডিয়ার স্বাধীনতার পথপ্রদর্শনের েেত্র অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার কেন্দ্র ছিলো।
বাস্তবতা গভীরভাবে পর্যবেণ করে ভুল পলিসি শোধরানো দেশের নিজের জন্যই উপকারী। কিন্তু লাইসেন্স রাজ উঠিয়ে নেয়ার ফলে বাইরে থেকেও প্রশংসা পাওয়া গেছে ভালোই, এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। আমেরিকা ইনডিয়ার প্রতি তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে মূলত এই কারণে যে, কোল্ড ওয়ারে ইনডিয়া জোটে যোগ দেয়নি কেননা আমেরিকা সেটা চায়নি।
বিশ্ব-রাজনীতির নিজের বৈশিষ্ট্যই পাল্টে গেছে এখন_ এই পরিবর্তন কেবল ইনডিয়ার জন্য প্রযোজ্য এমন নয়।
আশিস কুমার সেন: ইনডিয়ার পরিবর্তনের পেছনে তার ডায়াসপোরার অর্জনকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়, বিশেষত আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডে। ইনডিয়ার জন্য এই ডায়াসপোরার অর্থ কী? নিজের গৌরবের জন্য ইনডিয়ার কি আনন্দ করা উচিত?
অমর্ত্য সেন: ইনডিয়ার বৃহত্তর স্বার্থে এবং নিজের ক্রিয়েটিভ ট্যালেন্টদের মর্যাদা উপলব্ধির েেত্র বিদেশের মাটিতে ডায়াসপোরার বিজয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। শুরু থেকেই এই অর্জন ইনডিয়া উপভোগ করেছে, কিন্তু একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর যেমন, দেশের ভেতরে দারিদ্র্য, নিররতা বা নিম্নমানের স্বাস্থ্যসেবা দূরীকরণের েেত্র ডায়াসপোরার ভূমিকা যতখানি হওয়া উচিত ততটা হয়নি। এটাও মনে রাখা উচিত, গণতান্ত্রিক পরিবেশ ধরে রাখা, তুলনামূলকভাবে মুক্ত প্রচারমাধ্যম, বহুদলীয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিয়মিত নির্বাচন হওয়া এবং সরব একটা সিভিল সোসাইটিও বহির্বিশ্বে ডায়াসপোরার সম্মান এবং গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে সহায়তা করেছে।
প্রাথমিক শিা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মতো বেসিক সেক্টরে ঘরোয়া অনেক ব্যর্থতার পরও, সমৃদ্ধ গণতন্ত্র, উচ্চশিা এবং টেকনিক্যাল শিায় ইনডিয়ার প্রভূত উন্নতি বৈশ্বিক সিভিল সোসাইটিতে ডায়াসপোরার প্রবেশ সহজ করেছে। এটাও খাটো করে দেখার মতো বিষয় নয়।
আশিস কুমার সেন: শহুরে মধ্যবিত্ত ইনডিয়ানদের জীবনপদ্ধতি অনেকটাই তাদের পশ্চিমা কাউন্টারপার্টদের মতো। ঘরোয়া জিনিসপত্র থেকে শুরু করে খাবার কিংবা কালচারাল দিক থেকেও পশ্চিমাদের সঙ্গে তাদের মিল খুব বেশি। ইনডিয়ানরা কি ক্রমেই তাদের পশ্চিমা সহোদরদের মতো হয়ে যাচ্ছে।
যদি তা-ই হয়, তবে এর তিকর দিকগুলো কী?
অমর্ত্য সেন: বিশ্বব্যাপি এখন সবার সঙ্গে সবার এতো বেশি ইন্টারঅ্যাকশন হচ্ছে যে, ভোগের দিক থেকে সারা পৃথিবীর ধনীরাই প্রায় একইরকম। এটা কেবল ইনডিয়ায় নয়, রিও, অ্যাকরা. জোহানেসবার্গ থেকে শুরু করে মুম্বাই বা সাংহাইতেও একইরকম।
সহজ কথায় একে যুগের রীতি বলা যায়। খ্রিস্টের জন্মেরও আগে, চীন থেকে লাক্সারি অনেক দ্রব্য যেমন চাইনিজ সিল্ক, চাইনিজ ফল, চাইনিজ কসমেটিকস ইত্যাদি আমদানির ফলে ইনডিয়ান উচ্চবিত্তের ভোগবিলাস কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, সেবিষয়ে আমি আমার 'দ্য আর্গুমেন্টেটিভ ইনডিয়ান' বইতে আলোচনা করেছিলাম। ইনডিয়ান প্রাচীন সাহিত্যকর্মেও এরকম বর্ণনা আছে।
হয়তো এই ভোগের বিষয়টা সমসাময়িককালে বড় ব্যাপ্তি নিয়ে হচ্ছে।
ভোগ্যপণ্যের পেছনে উচ্চবিত্তরা কী পরিমাণ খরচ করছে সেটা কিন্তু সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে ধনী-গরীবের অর্থনৈতিক অবস্থানের ব্যবধান খুব বেশি, এবং সে ব্যবধান ক্রমেই বেড়ে চলেছে। চীনের মতো দ্রুতগতিতে না হলেও, সমপ্রতি এ ব্যবধান বেশ ভালোই বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ব্যবধান এবং ব্যবধানের বৃদ্ধি আমাদের গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় আনা উচিত।
আশিস কুমার সেন: বিশ্বশক্তির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে চাইলেও ইনডিয়ার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সুচক এখনো অনেক নীচে।
বিশেষত মানবিক উন্নয়নের দিক থেকে ইনডিয়া অনেক পিছিয়ে আছে। ইনডিয়া কি এসবকে কম গুরুত্ব দিচ্ছে? আর ইনডিয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিম্নবিত্তের ভবিষ্যত কেমন হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
অমর্ত্য সেন: ইনডিয়ার মানবিক উন্নয়নের নিম্নমান নিয়ে আপনি ঠিকই ধরেছেন। এটা খুবই পুরনো সমস্যা, ফলে এখন ইনডিয়া কম গুরুত্ব দিচ্ছে বিষয়টা এমন নয়।
পঞ্চাশ ষাটের দশকে নিররতা বা বেসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে আমি যেসব লিখেছি, সেসব দেখলে হতাশ না হওয়ার উপায় নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ওসব সমস্যা আজো প্রাসঙ্গিক।
সেগুলো দূরীভূত হলে আমিই সবচেয়ে বেশি খুশী হতাম। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বা মানবিক শক্তি উন্নয়নের জন্য বর্তমান সরকার অনেক কাজ করছে। তবে আরো অনেক কিছু করার আছে। কিন্তু সেগুলো ইনডিয়ান ইন্ডাস্ট্রির প্রসার, বিশ্ব-অর্থনীতির যোগাযোগের বিস্তৃতি, টেকনিক্যাল সেক্টরের উন্নতি ইত্যাদি কমিয়ে বা সংকুচিত করে নয়। অর্থনৈতিক দুরবস্থা দূরীকরণে এসবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে এটা সত্য, কিন্তু কেবল এরাই ইনডিয়ার মানবসম্পদ উন্নয়নের বাধা কাটিয়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট নয়।
আশিস কুমার সেন: 9 সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর ইনডিয়ার গণতন্ত্র বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হলেও, গত 10-15 বছর শাসনব্যবস্থার অস্থায়িত্ব, ধমর্ীয় মৌলবাদের উত্থান, এবং কংগ্রেসের মতো মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো থেকে নিম্নবর্ণের মানুষদের চলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আইডেন্টিটির পলিটিক্সের মূল শক্তির ব্যাখ্যা কী? আপনার কি মনে হয়, এটা গ্লোবালাইজেশনের ফল?
অমর্ত্য সেন: গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বটে এটা, তবে গ্লোবালাইজেশনের ফল বলে আমার মনে হয় না। বরং সফল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কারণে, দারিদ্র্য বা সমাজের পশ্চাদপদতার বিষয়গুলোকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির অন্তভর্ূক্ত করার মাধ্যমে এ সমস্যাগুলোর সফল সমাধান করা সম্ভব। আমাদের মধ্যকার পাথ্যর্ক্য এবং দ্বন্দ্বগুলোকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে, মানুষে মানুষে সম্পর্কের উপাদানগুলোকে উপো করে, মানুষের আইডেন্টিটির বিভেদের কলুষিত চেষ্টা সবসময়ই এই পৃথিবীতে মহামারির মতো লেগে আছে। বিভাজনের পদ্ধতি হয়তো পাল্টেছে, কিন্তু এখনো আছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বৃটিশ জার্মান আর ফরাসীদের মধ্যে জাতিগত বিভাজন সৃষ্টির মাধ্যমে হয়েছে। আর এখন সে বিভাজনের পদ্ধতির প্রধান হাতিয়ার ধমর্ীয় বিভাজন।
আপনি ঠিকই ধরেছেন, সামাজিক সাম্যতার আন্দোলনে নিম্নবর্গের মানুষদের আন্দোলন একটা নির্দিষ্ট প্লাটফর্মের ভিত্তিতে না হয়ে ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হওয়াটা নেগেটিভ ভূমিকা রাখছে। শোষিত শ্রেণীর মধ্যে বিভাজনের মাধ্যমে সহিংস বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি হতে না দিয়ে বরং যৌথভাবে অর্থনৈতিক দারিদ্র্য, সামাজিক বৈষম্য, জেন্ডার বৈষম্য ইত্যাদি দূরীকরণ সমাজের কাছে দায়বদ্ধ রাজনৈতিক নেতাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ।
আশিস কুমার সেন: গ্লোবালাইজেশনের যুগে ইংরেজি শিাকে দতার মাপকাঠি বিবেচনা করা হয়।
এমনকি গ্রামের জনগণেরও একটা বড় অংশ ইংরেজি মাধমে শিা গ্রহণ করতে চায়। এ প্রবণতার বিপজ্জনক দিকটা কী বলে আপনার মনে হয়?
অমর্ত্য সেন: এটা ঠিক, গ্লোবালাইজেশন ইংরেজিকেই বিশ্ব যোগাযোগের একমাত্র বাহন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এটা আমাদের মেনে নিতে হবে। আমি অবশ্য ইংরেজি শিার প্রতি এ প্রবণতাকে মোটেও পশ্চাদপদতা মনে করি না। এটা যেমন পুরো বিশ্বের সঙ্গে ইনডিয়ানদের যোগাযোগ সহজ করবে, তেমনি ইনডিয়াতেই ভিন্ন ভিন্ন ভাষাভাষিতে টেকনিক্যাল বা পলিটিক্যাল ভাষার যোগাযোগে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
ইংরেজির প্রতি আগ্রহ যদি ইনডিয়ার নিজস্ব শক্তিশালী ভাষা, সাহিত্য বা ইতিহাসকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করার জন্য হয়, তবে সেটা নিঃসন্দেহে তির কারণ হবে। কিন্তু এখনকার ঘটনা সেরকম নয়, এবং ভবিষ্যতেও এরকম ঝুকি আসলে সচেতনভাবে সেটা আমরা এড়িয়ে যেতে পারবো। ইনডিয়ার নিজস্ব কালচার এবং ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহী হয়েও একইসঙ্গে বাকি পৃথিবীর কালচার বা ঐতিহ্যের প্রতিও আগ্রহী হওয়া সম্ভব, যেটা রবীন্দ্রনাথ ব্যাখ্যা করেছিলেন অসাধারণ দতার সঙ্গে। দাসত্ব আর হীন মনোবৃত্তি পরিহার করে নিজেদের পায়ে দাড়িয়ে পুরো পৃধিবীর স্বার্থ চিন্তা করলে এবং তার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করলে 'স্থানীয়' এবং 'আন্তর্জাতিক'-এর দ্বন্দ্ব ঘুচে যাবে।
তবে অন্য ভাষায় প্রকাশিত শোষিত শ্রেণীর কণ্ঠ যদি ইংরেজি ভাষা অবরোধের সৃষ্টি করে তবে সেটা খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার।
ভাষাগত বিভাজনও অর্থনৈতিক বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে। এ সমস্যাকে অপরিহার্য সমস্যা হিসাবে না দেখে দ মানবিক সরকারি পলিসি দিয়ে সফলভাবে সমাধান করা সম্ভব।
আশিস কুমার সেন: ইনডিয়া কী পরিমাণ মতা অর্জন করুক আপনি চান?
অমর্ত্য সেন: মতাকে আমি উদ্ধারকর্তা হিসাবে বিশ্বাস করি না। মতাহীন এবং মতাশীলদের মধ্যে বিভাজনের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে মতা। ইনডিয়া পৃথিবীর ইতিহাসে দীর্ঘদিন মতাহীনদের দলভূক্ত ছিলো, তাই আমি চাই না সে মতার চর্চা করে বিপরীতদের দলভূক্ত হোক।
নিউকিয়ার শক্তি অর্জন বা মিসাইল বানানোর মধ্য দিয়ে প্রয়োজনীয় মতা আসবে না, বরং পৃথিবীতে বিরাজমান অসংখ্য সমস্যা সমাধানে আমাদের দতার মধ্য দিয়েই সেটা অর্জিত হবে। আক্রমণকারী সহিংস সেনাবাহিনীর মধ্য দিয়ে গালভারী গণতন্ত্রের কথায় নয়, বরং সত্যিকার গণতন্ত্রের চর্চার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা দিয়ে, এবং সেকু্যলারিজমের চর্চা দিয়ে এই পৃথিবীকে আমাদের অনেক কিছু দেয়ার আছে। বর্তমান বিশৃঙ্খল পৃথিবীতে এ অবদান উপেনীয় নয়। আমরা যে সন্দিগ্ন পৃথিবীতে বাস করছি সেখানে ইনডিয়া যদি সত্যিই উৎকৃষ্ট বিশ্বশক্তির আসন চায়, তবে ইনডিয়ার প েবৃহত্তর কণ্ঠস্বর নিঃসন্দেহে একটা বিরাট কাজরে কাজ হবে।
মতার আরো একটা দিকও আছে।
ভূমিহীন দিনমজুর, নিষ্পেষিত গৃহকতর্ীদের মতো উপেতি জনগোষ্ঠির মতায়ন নিঃসন্দেহে পজিটিভ ভূমিকা রাখবে। আমরা যদি বৈষম্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হই, তবে মতার বৈষম্যও আমাদের চিন্তিত করবে। আর ইনডিয়ায় এসব মতার বৈষম্য কমিয়ে আনার প্রয়াসকে যদি ইনডিয়ার সামগ্রিক মতায়ন ভাবা হয়, তাহলে সত্যি সত্যিই আমরা চাই, ইনডিয়া আরো মতাশীল হোক। আরো বিশদভাবে এবং খুঁটিয়ে দেখার দরকার আছে, আমরা আসলে কী মতা চাই, কোনে দৃষ্টিকোণ থেকে সেই মতা, এবং সে মতা আমরা আসলে কী করতে চাই। বেশি মতাশীল হওয়ার মধ্যে বিশেষ কোনো গুণ নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।