যা বুঝি, যা দেখি, যা শুনি এবং যা বলতে চাই
শিক্ষা নিয়ে বিতর্ক শিক্ষিত লোকরাই করে। শিক্ষার আলো বঞ্চিত লোকজন সনত্দানদেরকে শিক্ষালয়ে পাঠায় আর্থিক অবস্থা ফেরানোর আশায়। বাংলাদেশে, বা যে দেশে শ্রমের মর্যাদা নেই, কাজের জাত-বিচার ব্যাধির মত সমাজে ছড়িয়ে আছে, সেখানে শিক্ষিত মানে হলো যে শারীরিক পরিশ্রম না করে টেবিল-চেয়ারে বসেই আয়-রোজগার করতে পারে। এস.এস.সি পাশকে তেমন কোনো শিক্ষাই বিবেচনা করা হয় না সেখানে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আছে তা বুঝাতে চাকুরি প্রার্থীর নূ্যনতম অষ্টম শ্রেণী পাশ সনদপত্র লাগে।
অথচ উন্নত দেশগুলোতে সাধারণ জনগণ সরকারের দেয়া বাধ্যতামূলক ফ্রি শিক্ষার পর্যায় শেষ করে ভালো যেকোনো পেশায় ঢুকতে পারে। শ্রমের মর্যাদা থাকায়, শ্রমিক অতিঅবশ্যই সমাজের ইতর শ্রেণী থেকে আসবে এমন সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থা অনেক আগে ভেঙে ফেলায়, উচ্চ ও নিম্ন মজুরির মধ্যে বিশাল বৈষম্য বজায়ে রাষ্ট্রের মদদ না থাকায় বিদ্যাশিক্ষায় অনিচ্ছুক মানুষেরা স্কুল থেকে বেরিয়ে রীতিমত পেশাজীবি হয়ে উঠছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আর পাহারাদারের জীবনের মৌলিক প্রয়োজন একই। এ সমসত্দ দেশের বেতন ও মজুরিকাঠামো তৈরি করার সময় তা মনে রাখা হয়েছে। বরং শিল্পখাতের চাহিদা ও বাজারের ওপর নির্ভর করে কার মজুরি কত হবে।
সে কারণেই একজন বুলডোজার বা ক্রেনচালক একজন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ গ্র্যাজুয়েটের চেয়ে বেশি আয় করে। এতে ঐ গ্র্যাজুয়েট হা-পিত্যেশ করেও মরে না। কারণ বেশি শিক্ষাকে বেশি আয়ের যোগ্যতা বলে কেউ দেখে না।
বাংলাদেশে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব আছেন যারা ব্যাংক-ঋণ এধার-ওধার করে শিল্পপতি হয়ে গেছেন এবং বেকারসমস্যা মোকাবেলা করতে তারা যে কতটা হিমশিম খাচ্ছেন তা বাংরেজি ভাষায় পাঁচতারা হোটেলে বর্ণনা দিতে দিতে আবেগাপস্নুত হয়ে পড়েন। তাদের প্রথম আক্রমণ আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর।
তারা চান ওখানে বিদ্যার চর্চা বন্ধ হোক এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের দর্জি-শিল্পের জন্য কারিগর আর সুপারভাইজার সরবরাহ করুক। কারিগররাই একদিন পৃথিবী চালাবে এইরকম আশ্বাসের স্বপ্ন দিয়ে একসময় ঢাকায় বিরাট বিরাট সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে কম্পিউটার বিষয়ক কোর্সের বিএসসি এমএসসি ডিগ্রি চালু করেছিল কিছু ইন্সটিটিউট। বেক্সিমকো থেকে গ্রামীণ কে না তা' দিয়েছিল বাংলাদেশে তথাকথিত 'সিলিকন সিটি' বানানোর স্বপ্নের ডিমে। মাঝখানে স্বপ্নকাতর মধ্যবিত্তের পকেট ফাঁকা হলো। সেইসব ইন্সটিটিউটের প্রোডাক্টরা এখন কোন সিটিতে চাকুরি করে কে জানে?
বৃত্তিমূলক শিক্ষা আয়-রোজগারের জন্য একটা শর্ট-কাট পথ হতেই পারে।
কিন্তু এ্যাকাডেমিক শিক্ষা না থাকলে একটি জাতির মসত্দিষ্ক অচল হয়ে যেতে বাধ্য। বিরোধীরা তাই সমাজপতিদের এসব বক্তব্যকে 'শিক্ষা-সংকোচনের' ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখে।
এত গম্ভীর কথা না বলে আমরা বরং শিক্ষার বিভিন্ন রূপের সুবিধা-অসুবিধাগুলো দেখতে পারি। সবরকমের শিক্ষার যদি সুযোগ থাকে, তবে ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের ইচ্ছামাফিক রম্নট বেছে নিতে পারে। নানা রাজনৈতিক কারণে প্রশিক্ষণটাকেও এখন শিক্ষার সাইনবোর্ডে চালিয়ে দেয়া হয়।
সেগুলোকে শিক্ষার মধ্যে ধরে আমরা শিক্ষাকে চার ভাগে ভাগ করতে পারি:
1. বৃত্তিমূলক বা ভোকেশনাল শিক্ষা
সুবিধা:
ক. নির্দিষ্ট একটা ক্যারিয়ার বা জীবিকার উদ্দেশ্যে শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে।
খ. চাকুরিতে ঢুকেও এটি নেয়া যায়। প্রাইভেটে বা কলেজে গিয়ে নেয়ার সুযোগ আছে।
গ. যারা হাতে-কলমে কাজ করতে পছন্দ করেন, বই ঘাঁটাঘাঁটি পছন্দ করেন না তাদের জন্য সুবিধাজনক।
অসুবিধা:
ক. যদি ক্যারিয়ারটা বদলে যায়, তবে এই শিক্ষা কোনো কাজে আসবে না।
নতুন জীবিকার জন্য নতুন করে ট্রেনিং নিতে হবে।
খ. কোনো একটা বিশেষ কাজের জন্য এসব ট্রেনিং হয়ে থাকে।
গ. সব চাকুরিদাতা এসব বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে আমল না দিতে পারেন।
2. পার্টটাইম (নৈশকালীন, দূরশিক্ষণ বা ই-লার্নিং)
সুবিধা:
ক. অন্য কাজ বা দায়িত্বের পাশাপাশি পড়ালেখাটাও চালানো যায়।
খ. ছোট ছোট কোর্স থাকায় পড়ার চাপ কম থাকে ও চালিয়ে যেতে সুবিধা হয়।
গ. কোর্স শেষে স্বীকৃত সার্টিফিকেট পাওয়া যায়।
অসুবিধা:
ক. কাজের পাশাপাশি কোর্স চালিয়ে যাওয়ার জন্য নিজে খুব সুশৃঙ্খল হওয়া লাগে বা মনের জোর থাকা লাগে।
খ. এ ধরনের ডিগ্রিতে বেশি টাকা লাগতে পারে এবং অনেক ক্ষেত্রে সমমানের প্রাতিষ্ঠানিক সনদপত্রের তুলনায় এধরনের সনদকে নিম্নমানের বিবেচনা করার আশংকা থাকে।
3. অন দ্য জব
সুবিধা:
ক. চাকুরির সময়ে ও কর্মস্থলেই পড়ালেখাটা হয়।
খ. একই পেশার অনেকের সাথে যোগাযোগ হয়।
গ. অফিস থেকেই খরচ বহন করে।
ঘ. সুনির্দিষ্ট কাজের জন্য যে জ্ঞানের দরকার শুধু সেটুকুই শেখানো হয়।
অসুবিধা:
ক. এই সুযোগ পাওয়ার জন্য আগে চাকুরিটা জোগাড় করতে হয়।
খ. অফিস থেকে খরচ বহন না করলে অনেক টাকা লাগে।
4. এ্যাকাডেমিক
সুবিধা:
ক. উচ্চ শিক্ষার সুযোগ খোলা থাকে।
খ. পেশাভিত্তিক নয় সুতরাং সার্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য।
গ. এরকম শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পেশায় যোগ দেয়া যায়।
ঘ. কোনো বিষয়ে গভীর জ্ঞানার্জনের সুযোগ থাকে। গবেষণার দক্ষতা জন্মায়।
অসুবিধা:
ক. শুধু শিক্ষার পেছনে অনেক সময় দিতে হয়।
খ. কোনো বিশেষ কাজের জন্য দক্ষতা/অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায় না।
গ. যারা হাতে-কলমে কাজ করতে চায় তাদের জন্য বড় বেশি যন্ত্রণার মনে হয়।
ঘ. পড়ার সময় সাধারণত: আয়ের কোনো সুযোগ থাকে না।
শিক্ষার বিভিন্ন ধরনের রয়েছে বিভিন্ন রকমের সুবিধা-অসুবিধা এবং স্থান-কাল-পাত্র ভেদে এই সবক'টিই ধরণই প্রয়োজনীয়। কিন্তু অন্ধের হাতিদর্শনের মতো সেইসব অর্থবান সমাজপতিরা বিদেশে দেখে আসা কোনো একটি পদ্ধতিকেই একমাত্র পদ্ধতি বলে চাপিয়ে দিতে চান জাতির ঘাড়ে।
আর সমাজপতিরা এরকম ভিনদেশি শব্দযোগে খিঁচুড়ি ভাষায় দামী সু্যট-টাই পরে এসব কথা বললে আমাদের অনেকেই ঘাবড়ে গিয়ে বিশ্বাস করে বসেন তাদের অমৃতবাণী। ক'জনইবা যাচাই করতে যাই?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।