'গুড মর্নিং ম্যাম। আমি গ্রামীণফোন থেকে বলছি। আপনার জন্য একটি গুড নিউজ আছে। গ্রামীণফোনের লটারিতে আপনি একটি ব্র্যান্ড নিউ প্রিমিও গাড়ি পুরস্কার পেয়েছেন। গ্রামীণফোন পরিবারের পক্ষ থেকে আপনাকে অভিনন্দন।
'
এক সকালে ঘুম থেকে উঠেই নিজের মুঠোফোনে গ্রামীণফোনের নাম্বার থেকে এমন একটি কল পান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বিলকিস আক্তার (ছদ্মনাম)। গাড়ি পাওয়ার সুসংবাদটি শুনে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তিনি। কিন্তু ওই ফোনকলটি যে তার কাল হয়ে দাঁড়াবে তা তিনি ভাবতেই পারেননি। গ্রামীণফোন কোম্পানি থেকে ফোন আসায় তিনি তাদের কথা বিশ্বাস করে ফেলেন। তাই গাড়ির মালিক হতে গিয়ে তিনি নিজের স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করেছেন।
লোন করতে হয়েছে আত্মীয়ের কাছ থেকেও। ফোনকলারের কথামতো বিলকিস আক্তার ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ৫টি মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা পাঠিয়ে দেন। টাকা পাঠানোর পর শিক্ষিকা বিলকিস একবার মাত্র যোগাযোগ করতে পেরেছিলেন গ্রামীণ ব্যাংকের ফোন কলারের সঙ্গে। এরপর বিলকিস বুঝতে পারেন, তিনি প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা বিলকিস আক্তারই শুধু নন, কলাবাগানের গৃহবধূ স্বর্ণালী বিশ্বাস, উত্তরার কলেজ ছাত্র ফাহিম আহমেদ এমনই প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন।
প্রায় প্রতিদিনই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন শত শত মানুষ। প্রযুক্তি ব্যবহারে ভয়ঙ্কর ফাঁদ পেতে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে মাঝে-মধ্যে ধরা পড়ে প্রতারক চক্রের সদস্যরা। কিন্তু তাদের দৌরাত্দ্য থেমে নেই। তাদের খপ্পরে পড়ে টাকা-স্বর্ণালঙ্কার হারিয়ে মানুষকে পথে বসতে হচ্ছে।
পুলিশ, গোয়েন্দা ও র্যাব জানিয়েছে, প্রতারক চক্র সারা দেশে ভয়ঙ্কর প্রতারণার জাল ছড়িয়ে দিয়েছে। প্রতারক চক্রের সদস্যরা অত্যন্ত স্মার্ট। তারা অনর্গল ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু ভাষায় কথা বলেন। তাদের রয়েছে মানুষকে সম্মোহন করার জাদুকরী কৌশল। রেজিস্ট্রেশনবিহীন সিমকার্ডের মাধ্যমে প্রতারক চক্রের সদস্যরা এ কাজগুলো করছে।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, প্রতারকচক্রের সদস্যদের অধিকাংশই আইটি এঙ্পার্ট হয়ে থাকে। এরা একসময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করত। কোনো কারণে চাকরি চলে যাওয়ায় প্রতারণা পেশায় নেমে যায়। মোবাইল ফোন অপারেটর কর্তৃপক্ষ বলছে, এ ধরনের ফোনকলের কোনো ভিত্তি নেই। ফোন কোম্পানি থেকে এ ধরনের লটারি কখনো করা হয় না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক (ডিপার্টমেন্ট অব কারেন্সি) দাসগুপ্ত অসীম কুমার জানান, এ ধরনের বেশ কয়েকটি অভিযোগ তারা পেয়েছেন। বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে, ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট ছাড়া যেন কোনো মোবাইল অ্যাকাউন্ট খোলা না হয়। এক্ষেত্রে এনওয়াইসি (নো ইওরস কাস্টমার) সার্টিফিকেট থাকতে হবে। কাস্টমারের পুরো বিবরণ ছাড়া কোনো অ্যাকাউন্ট খুললে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সবাইকে সচেতন হতে হবে। কেউ যেন এ ধরনের ফাঁদে পড়ে কোনো অ্যাকাউন্টে টাকা জমা না দেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (পূর্ব) জাহাঙ্গীর হোসেন মাতবর নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, প্রতারক চক্রের সদস্যরা তাকেও ফোন করে লটারির খবর দিয়েছিল।
লটারির টাকা পাওয়ার জন্য তার কাছে ট্যাঙ্রে টাকা দাবি করলে তিনি পাল্টা ধমক দেন। এরপরই প্রতারকরা ফোনের লাইন কেটে দেন। পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, তারা এ ধরনের বেশ কয়েকটি অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করছেন। সবকটিই ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল অ্যাকাউন্ট নাম্বারের। রেজিস্ট্রেশনবিহীন সিম দিয়ে প্রতারণা করে আসছে বলে তাদের পাকড়াও করাটা একটু কঠিন হয়ে পড়ে।
তবে মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার হাবিবুর রহমান জানান, এমন অসংখ্য অভিযোগ তারা পাচ্ছেন। কাউকে ধরতে পারছেন না। প্রযুক্তির অপব্যবহার করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে যাচ্ছে।
মতিঝিল এলাকার বাসিন্দা দেশের স্বনামধন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা বিলকিস আক্তারের স্বামী সাইফুল ইসলাম বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।
তিনি জানান, তাদের বিবাহিত জীবনে তার স্ত্রীকে কখনোই কোনো কিছুর প্রতি লোভ করতে দেখেননি। যে কোনো বিষয় তার সঙ্গে শেয়ার করেন। লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে রয়েছেন বলে গোটা পরিবারের মধ্যে বিলকিসের একটি ভিন্ন অবস্থান রয়েছে। এমনই একজন মানুষকে প্রতারক চক্রের সদস্যরা সম্মোহন করে ফেলে। যে কারণে পুরো বিষয়টি তিনি গোপন রেখেছেন।
ফোনকল আসা থেকে শুরু করে টাকা জমা দেওয়া পর্যন্ত কোনো কিছুই তার সঙ্গে শেয়ার করেননি। বিলকিস যখন বুঝতে পেরেছেন, তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন, তখনই তাকে পুরো ঘটনাটি জানান। সাইফুল ইসলাম জানান, ১৫ সেপ্টেম্বর সকালে গ্রামীণফোনের ০১৭৭৯-৮৯৯৩৬৫ থেকে বিলকিসের গ্রামীণ নাম্বারে ফোন আসে। ফোনকলার নিজেকে গ্রামীণফোনের একজন কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে বিলকিসকে জানান, গ্রামীণফোনের গ্রাহকদের মধ্যে যাদের প্রথম ছয় ডিজিটের শেষ তিন ডিজিট ১১১ রয়েছে (যেমন ০১৭১১১) তাদের পুরনো গ্রাহক হিসেবে গ্রামীণফোন কোম্পানি একটি সুযোগ দিয়েছে। এমন সংখ্যার গ্রাহকদের নাম্বার নিয়ে লটারি করা হয়েছে।
ওই লটারিতে বিলকিস একটি প্রিমিও গাড়ি জিতেছেন। ফোন কোম্পানির ম্যানেজার পরিচয়ে পরে আরেকজন কথা বলতে শুরু করেন। তিনি বিলকিসকে জানান, এই গাড়ি তিনি যে কোনো শোরুম থেকে পছন্দ করে নিয়ে যেতে পারবেন। বিলকিস প্রথমে বিশ্বাস করতে না চাইলেও তাদের জাদুকরী কথাবার্তায় বিশ্বাস না করার কোনো উপায় ছিল না। ফোনকলার বিলকিসকে গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের জন্য ১৮ হাজার ৪০০ টাকা ব্যাংকে জমা দিতে পরামর্শ দেন।
এ কথা বলার সময় গ্রামীণফোনের ম্যানেজার পরিচয়ের লোকটি বিলকিসকে জানান, বিষয়টি যেন তার স্বামী বা অন্য কারও সঙ্গেই শেয়ার না করেন। তারা বলেন, গাড়িটি তার স্বামীকে উপহার দিলে তিনি ভীষণ অবাক হয়ে যাবেন। তাদের এই পরামর্শ বিলকিসের ভালো লাগে। যে কারণে তিনি কাউকে কিছু না বলেই ১৬ সেপ্টেম্বর ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের ০১৭৭১-৯৫৯৩৪৫ নম্বর মোবাইল অ্যাকাউন্টে মো. ময়জুদ্দিনের নামে ১৮,৪০০ টাকা জমা দেন। এই টাকা জমা দেওয়ার পরই বিলকিসের কাছে আবারও ফোন আসে।
এবার তারা জানান, গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের কাজ চলছে। এখন নতুন গাড়ির ট্যাঙ্রে টাকা ব্যাংকে জমা দিতে হবে। আর এ জন্য একই কায়দায় বিলকিসকে দিতে হবে আরও সাড়ে চার লাখ টাকা। তারা ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের আরও ৫টি মোবাইল অ্যাকাউন্ট নাম্বার দেন। নাম্বারগুলো হলো মো. আবদুল কাদের ০১৭৬১৫২৪৯০৩২, নুর জামাল নং ০১৭৭৮১১৫২৩৪৩০, মো. ময়েজউদ্দিন নং ০১৭৭১-৯৫৯৩৪৫৯, মো. ইদ্রিস নং ০১৯৮১-৪২৬১০৩৪ এবং হারুনুর রশিদ নং ০১৯২৫৪৬৩৭৪৩৮।
নতুন করে সাড়ে চার লাখ টাকার কথা শুনে আকাশ ভেঙে পড়ে বিলকিসের। তিনি টাকা জোগাড়ের কথা ভাবতে শুরু করেন। বিলকিস তার স্বামীকে বিষয়টি জানাবেন এবং টাকার কথা বলবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। তার এই ভাবনার কথা জানান ফোন কলারের কাছে। এ সময় ফোন কলার তাকে নিরুৎসাহিত করে বলেন, বলে দিলে তো আপনার স্বামীকে সারপ্রাইজ দেওয়া হবে না! তারা পরামর্শ দেন, ঘরের স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করতে।
অল্প টাকায় ৩০ লাখ টাকা মূল্যের প্রিমিও গাড়ি পাবেন, আবারও মনে করিয়ে দেন বিলকিসকে। বিলকিস এবার কোনো কিছু চিন্তা না করেই আলমারি থেকে স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। মৌচাক মার্কেটের একটি সোনার দোকানে গিয়ে সেগুলো বন্ধক রাখেন। কিন্তু তাতেও আরও দুই লাখ টাকার প্রয়োজন থাকে। এ সময় বিলকিস তার এক ভাগ্নের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা লোন চান।
ভাগ্নে ভেবেছেন বিলকিস আক্তার উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাবেন। তাই মামী লোন চাওয়ায় কোনো কিছুই আর ভাবেননি ভাগ্নে। তিনি দুই লাখ টাকা রেডি করে বিলকিসকে জানান। বিলকিস তখন মোবাইল অ্যাকাউন্ট নাম্বার দিয়ে ভাগ্নেকে বলেন, টাকাগুলো যেন জমা দেন। ভাগ্নে এমডি জাকির হোসেন ০১৯২৪৭০৫২৭৫২, এমডি সাইফুর ০১৭২৩৩৩৩১৫৫৩, এমডি মেহেদী হাসান ১৯৮১৬২৩৪৯২৮, এমডি আবদুল্লাহ আল মামুন ০১৭৪৮৮৪৯২১৮৩ দুই লাখ টাকা জমা দেন।
বিলকিস জমা দেন আড়াই লাখ টাকা। টাকাগুলো জমা দেওয়ার পর ফোনে জানিয়ে দেন ম্যানেজার পরিচয়ের লোকটিকে। এ সময় ফোনে ওই লোকটি বিলকিসকে বলেন, আপনি আপনার নিজ ফ্ল্যাট থেকে কথা না বলে, অন্য ফ্লাটে গিয়ে কথা বলছেন কেন? আপনার নিজের নিরাপত্তার বিষয় রয়েছে না? প্রকৃত অর্থেই বিলকিস আক্তার সেই সময়ে প্রতিবেশীর ফ্ল্যাটে অবস্থান করছিলেন। গ্রামীণফোনের ম্যানেজার পরিচয়ধারী ব্যক্তিটির এমন কথা শুনে সর্বপ্রথম সন্দেহ হয় বিলকিসের। এরপর আবারও বিলকিস ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে ফোনটি বন্ধ পান।
এরপর আর কখনোই ফোনটি খোলা পাননি বিলকিস। তিনি বুঝতে পারেন, ভয়ঙ্কর প্রতারণার ফাঁদে পড়েছেন। ঘোর কাটে বিলকিসের। তিনি তার স্বামীকে বিষয়টি জানান। তারা গ্রামীণফোনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, ফোনটি ভুয়া নামে রেজিস্ট্রেশন করা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।