আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পলাশী থেকে ধানমন্ডি—মীরজাফর থেকে মোশতাক, জগতশেঠ থেকে জিয়া


একটি পারিবারিক ছবির কথা বলি, ছবিটি ফেসবুকের হোমপেজে পোস্টেড হয়েছে। ছবিটিতে বঙ্গবন্ধু তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নাম্বার বাড়ীর ডাইনিং টেবিলে, সকলকে নিয়ে খেতে বসেছেন, বামপাশে শেখ জামাল, ডান পাশে শেখ রাসেল, উনার চেয়ারের পেছনেই দাঁড়ানো শেখ রেহানা, বেগম মুজিব শেখ জামালের পাশের চেয়ারটিতে বসে সবাইকে খাবার পরিবেশন করছেন, টেবিলটিতে একসাথে কতজন বসতে পারে আমার আন্দাজ নেই, কিন্তু ছবিতে টেবিলের চারপাশ ঘিরে আরও অনেকের পার্শ্ব অবয়ব দেখা যায়। হয়তো সেখানে শেখ কামাল ছিলেন, শেখ হাসিনাও ছিলেন, শেখ মনি ছিলেন, এবং আরও কয়েকজন ছিলেন। চল্লিশ-বেয়াল্লিশ বছর আগে তোলা ছবি, রাসেলের ছবি দেখে মনে হয় যেন বঙ্গবন্ধুর শাহাদাৎ বরণের কিছুদিন আগে তোলা ছবি এটি। হোমপেজে ছবিটি কে বা কারা পোস্ট করেছে, সেটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছেনা, কিন্তু একই ছবি আবু মোহাম্মদ ইউসুফ নামের এক বন্ধু, যিনি সরকারী চাকুরীর অতি উঁচু পোস্টে আসীন আছেন, আমাকে মেসেজ ইনবক্সে পাঠিয়ে জানতে চেয়েছেন, ছবিটি দেখে আমার কি অনুভূতি হয়।

ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খোলার পর থেকে ইউসুফ সাহেবদের মত প্রচুর প্রগতীশীল মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে। যে দূর্মুখ এখনও বলে যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশের কেউ চোখের জল ফেলেনি, সেই দূর্মুখেরা শুধু নিজেদেরকেই বাংলাদেশের সমগ্র জনগণ ঠাউরে এই ধরণের অপপ্রচার চালিয়ে গিয়েছে এতটাকাল। সময় বদলে গেছে, প্রজন্ম বদলে গেছে, টেকনোলোজী বদলে গেছে, তাই মানুষের মনোভাবও বদলে গেছে। এখন একজন আরেকজনের কাছে জানতে চায়, ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে দেশের কতটুকু লাভ হয়েছে, জানতে চায়, ছোট্ট রাসেলকে হত্যা করার মধ্যে মানব সভ্যতার কতটুকু অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। জানতে চায়, পুরুষদের সাথে এতগুলো নারীকে হত্যা করে কার সিংহাসন কতটুকু পাকাপোক্ত হয়েছে।

টেকনোলোজীর অগ্রগতির সাথে সাথে বর্তমান প্রজন্মের তরুণদের মধ্যে এই প্রশ্নগুলোর উদয় হয়েছে বলেই তারা নিজেদের মেধা কাজে লাগিয়ে, আর্কাইভ থেকে সকল দুষ্প্রাপ্য ছবি সংগ্রহ করে সারা ফেসবুকে ছড়িয়ে দিয়ে জাতির বিবেকের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে যারা ‘কম্বলচোর’ বলতে জিভে আটকাতোনা, যাদের এই মিথ্যে অপপ্রচারে জাতি বিভ্রান্ত হয়েছিল কিছুকালের জন্য, বঙ্গবন্ধুর ছবিগুলোই আজ সকল দূর্মুখদেরকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছে। যে ছবিটির কথা উল্লেখ করেছি, ছবিটি দেখলেই বুকের ভেতর অবর্ণনীয় এক কষ্টকর অনুভূতি হয়। ইউসুফ সাহেবের প্রশ্নের জবাবে শুধু দীর্ঘশ্বাস পড়ে, আফসোস হয়, ছবিটির মতই সুন্দর, স্বাভাবিক, আনন্দোচ্ছল হতে পারতো আমাদের সকলের জীবন, তেমনটি হওয়ারই তো কথা ছিল, হতে পারেনি, ওরা তা হতে দেয়নি। ইদাণিং তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মনে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অসাধারণ ভাবাবেগ সৃষ্টি হয়েছে।

ফেসবুক এখন আর শুধুই নিছক বিনোদনমূলক ভাব আদান-প্রদানের মাধ্যম নয়। এখানে রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য, সঙ্গীত বিষয়ে অসাধারণ লেখা পোস্টেড হয়। তরুণ প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু মানেই বিশাল এক অনুভূতি, শ্রদ্ধা ও আবেগে নত হয়ে আসা ঋজুদেহ। বর্তমান প্রজন্মের তরুণেরা আধুনিক টেকনোলোজীর সাহায্যে কতশত হারিয়ে যাওয়া মুহূর্ত, কত দূর্লভ ঐতিহাসিক দলিল ফেসবুকে সকলের সাথে শেয়ার করে কত অজানাকে জানার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। আমি সেই ছোটবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধু ভক্ত, উনার অন্ধ সমর্থক।

আমি রাজনীতির কিছুই জানিনা, কিছুই বুঝিনা, তবে বঙ্গবন্ধুকে অন্ধভাবে সমর্থণ করতে রাজনীতি না বুঝলেও চলে, যাঁর সারাজীবনে্র আত্মত্যাগের কারণে একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি, স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি, শুধু এই একটিমাত্র কারণেই আজীবন তাঁকে গভীর শ্রদ্ধায় অন্তরে লালন করবো, এর মধ্যে দ্বিতীয় কোন কথা থাকবেনা। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সাধারণ জনগণের প্রাণপ্রিয় নেতা, উনি কখনওই প্রাচীর সুরক্ষিত বাড়িতে থাকেননি, সেনাবেষ্টিত হয়েও থাকেননি, উনি সারা দেশের গ্রাম বাংলায়, পথে-প্রান্তরে হেঁটেছেন আর দশজন সাধারণ মানুষ যেভাবে হেঁটে বেড়ায় ঠিক সেভাবে। উনাকে আমি নিজের চোখে দেখেছি আমার সামনে দিয়ে বুক চিতিয়ে হেঁটে যেতে, শিশু বয়সে দেখা দৃশ্য, এখনও চোখে ভাসে। যে বয়সে রাজনীতি, ক্ষমতার লোভ, ঈর্ষা, জিঘাংসা, বিশ্বাসঘাতকতার মত কুৎসিত অন্ধকার দিকগুলো সমন্ধে কোন ধারণাই ছিলনা, ঠিক সেই বয়সে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছিলাম কয়েক মুহূর্তের জন্য। মাথায় বঙ্গবন্ধুর হাতের স্পর্শও পেয়েছিলাম, মাস বা তারিখ মনে নেই, তবে বছরটি মনে আছে, ১৯৭৫ সাল।

আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ দাউদ খান এসেছিলেন বাংলাদেশ সফরে, তাঁকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু জাহাজে করে চাঁদপুরে গিয়েছিলেন। জাহাজে উঠেছিলেন নারায়ণগঞ্জের ‘পাগলা ঘাট’ থেকে, উনাদেরকে পাঘলাঘাটে সাদর অভ্যর্থণা জানানোর জন্যই আমরা সেদিন লাইন ধরে দাঁড়িয়েছিলাম। প্রচন্ড রোদ উপেক্ষা করে স্কুলের উৎসাহী শিশুরা দাঁড়িয়ে আছি, সকলের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাবেন বঙ্গবন্ধু, হাতে থাকা ফুলের পাপড়ি ছুঁড়ে দেবো তাঁর দিকে, এটুকু করতে পারার আনন্দেই আমরা আনন্দিত। সেই ক্ষণ এলো, দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম, বঙ্গবন্ধু নামের বিশালদেহী মানুষটি এগিয়ে আসছেন, পাশে আছেন ‘টাকমাথা’ সাহেব(আফগান প্রেসিডেন্ট দাউদ খান),দুজনেরই হাসি মুখ, বঙ্গবন্ধু বাচ্চা মেয়েদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, আমাদের কাছাকাছি এসে পাশের দুই শিশুকে বাদ দিয়ে উনার হাতটি আমার মাথায় বুলালেন, জিজ্ঞেস করলেন, “কিরে, কিছু খেয়েছিস”! আমার উত্তর শোনার প্রয়োজন উনার ছিলনা, উত্তর জেনেই উনি মায়াভরা কন্ঠে প্রশ্নটি করেছিলেন, অনেককেই করেছেন এই প্রশ্ন, কারণ উনি জানতেন, শিশুপুত্র রাসেলের বয়সী ছেলেমেয়েদেরকে এই একটিমাত্র প্রশ্নই করা যায়, যে প্রশ্ন শুনে শিশুদের মন আনন্দে নেচে উঠে। আমার মনও সেদিন আনন্দে নেচে উঠেছিল, কিছুক্ষন আগের ক্ষিদের তীব্র জ্বালার অনুভূতি মুহূর্তেই উধাও হয়ে গেছিল।

এক মুহূর্তের দেখা, এক মুহূর্তের স্নেহস্পর্শ মাথায় নিয়ে বাড়ী ফিরে এসেছিলাম। সেই ঘটনার কিছুদিন পরেই ১৫ই আগস্ট সকালে ঘুম ভেঙ্গেছিল মেজর ডালিমের কন্ঠস্বরে। বাংলাদেশ বেতার থেকে মেজর ডালিম অনর্গল সদর্পে ঘোষণা দিয়ে চলেছিল, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার কথা। তখনও রাজনীতির মারপ্যাঁচ, রাজনীতির আলোকিত দিক, অন্ধকার দিক, ভালোবাসার দিক, প্রতিহিংসার দিক, কোন দিক সম্পর্কেই কিছুই জানতামনা, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পেছনে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থাকতে পারে বুঝেছি, কিন্তু আমার বয়সী শেখ রাসেলকেও কেন হত্যা করা হয়েছে, সেই প্রশ্ন নিয়ে অনেক ভেবেছি, বেগম মুজিবকে নাহয় বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী হিসেবে হত্যা করেছে, শেখ কামাল এবং শেখ জামালকে নাহয় বঙ্গবন্ধুর সাবালক পুত্র হিসেবে হত্যা করেছে, কিন্তু শেখ বাড়ীর নব বিবাহিত পুত্রবধূ দুজন, ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া পাখীর ছানার মত ছোট্ট রাসেলকে কেন হত্যা করলো ওরা, এগুলো ভাবতে ভাবতেই বড় হয়ে গেছি, প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাইনি কারণ বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করিয়েছে এবং হত্যা করেছে, সকলে মিলেই সকল প্রশ্নের দরজা বন্ধ করে রেখেছিল। কিন্তু প্রশ্ন আমার মাথায় থেকেই গিয়েছিল, এবং প্রশ্নগুলো আমার তিন কন্যার মস্তিষ্কের কোষেও জন্ম নিয়েছিল।

সর্ব প্রথম প্রশ্নটি করেছিল আমার সাত বছর বয়সী প্রথম কন্যা ঋত্বিকা, তবে আমাকে নয়, প্রশ্নটি ও রেখে এসেছিল বঙ্গবন্ধুর ৩২ নাম্বার ধানমন্ডির বাড়ীর লগবুকে। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা যখন তাঁদের পৈতৃক বাড়ীটি জনগণের জন্য দান করে দিয়েছিলেন, তখন আমি ঐ বাড়ীটি দেখতে গিয়েছিলাম ছোট্ট ঋত্বিকার হাত ধরে। দরজার কাছে রাখা ছিল লগবুক, বাড়ীটি ঘুরে দেখে নিজের মতামত রেখে যাওয়ার জন্য। বাড়ী ঘুরে দেখে বিষন্ন মনে ফিরে আসছিলাম, লগবুক খোলা আছে, অনেকেই তাতে নিজেদের মতামত লিখছে, সাত বছরের ঋত্বিকা গোটা গোটা অক্ষরে স্পষ্টভাবে লিখেছিল, “শেখ রাসেলতো ছোট ছিল, ওকে মারলো কেন?” এই ছোট্ট কিন্তু অতি তীব্র প্রশ্নসূচক বাক্যটি পরের দিন দৈনিক ‘আজকের কাগজে’ শিরোণাম হয়েছিল, ছোট্ট ঋত্বিকার প্রশ্ন হিসেবে। এভাবেই দিনে দিনে ১৫ই আগস্টের বর্বর হত্যাকান্ড সম্পর্কে পরবর্তী প্রজন্মের মনে প্রশ্ন জেগেছে, সেই প্রশ্নবোধ আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে প্রশ্নের কারণ খুঁজে বের করতে অনুসন্ধিৎসু করে তুলেছে।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বর্তমান প্রজন্মের উৎসাহ, বঙ্গবন্ধুকে জানার যে তীব্র আকাংক্ষা এবং নিরলস অনুসন্ধান, তা দেখে আমাদের প্রজন্ম আশান্বিত হই, আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের পাপের বোঝা আমরা কাঁধে বয়ে বেড়িয়েছি এতকাল, আর আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আধুনিক টেকনোলোজী নিয়ে এগিয়ে এসেছে আমাদের কাঁধ থেকে পাপের বিশাল বোঝা নামিয়ে কাঁধটাকে হালকা করে দিতে। তাদের পূর্ণসহযোগীতা পেয়ে দেশবরেণ্য সাংবাদিক, কলামিস্ট, কালজয়ী একুশের সঙ্গীত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী”র রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরী নির্মান করেছেন চলচ্চিত্র “পলাশী থেকে ধানমন্ডি”। ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ ছবিটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। জিয়াউর রহমান সাহেবকে যারা মাথায় নিয়ে নাচে, জিয়াউর রহমানের ছেঁড়া গেঞ্জী, ভাঙ্গা স্যুটকেসকে ‘সততার প্রতীক’ আইকন হিসেবে ব্যবহার করে আত্মতুষ্টিতে ভোগে, তারা হয়তো ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ ছবিটি দেখে হজম করতে পারবেনা, কারণ এই ছবি ‘কালো চশমার আড়ালে’র মানুষটিকে উন্মোচিত করে দিয়েছে। ছবিটি ইউ টিউব, ফেসবুকের মাধ্যমে সকলের কাছে পৌঁছে দিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে বর্তমান প্রজন্মের তরুণেরা।

‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ ছবিটি কয়েকবার দেখেছি, ছবিটির আদ্যোপান্ত দেখে মনে মনে ছবির নাম দিয়েছি “পলাশী থেকে ধানমন্ডি, মীরজাফর থেকে মোশতাক, জগৎশেঠ থেকে জিয়া”। মোশতাক খন্দকার একটি নাম, নামটি বাঙ্গালীর বুকে গভীরতম ক্ষত, কাঁধে পাপের বিশাল বোঝাসম। পলাশীর যুদ্ধের মীরজাফরের সাথে কি ভীষণ মিল! এমনকি এই দুই পাপিষ্ঠের মৃত্যুতারিখ ‘৫’। বাংলার প্রথম মীরজাফর মরেছে ৫ই ফেব্রুয়ারী, কুষ্ঠরোগে পচে গলে একাকী প্রকোষ্ঠে, আর দ্বিতীয় মীরজাফর মরেছে ৫ই মার্চ, একাকী অন্ধকার ঘরে, আত্মীয়-বান্ধব বিবর্জিত অবস্থায়। খন্দকার মোশতাকের আপন বড় ভাইয়ের স্ত্রী বেগম আলতাফুন্নেসা খন্দকার নারায়ণগঞ্জ গার্লস স্কুলের অ্যাসিসিট্যান্ট হেডমিস্ট্রেস ছিলেন, উনার মুখ থেকেই আমার মা’সহ অন্যান্য সকল শিক্ষক শুনেছিলেন খন্দকার মোশতাকের কুটিল চরিত্রের কথা, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার কথা, বড় ভাইকে ঠকিয়ে সম্পত্তি গ্রাস করার কথা, শেষ জীবনে আত্মীয়-বান্ধব বর্জিত হয়ে পড়ার কথা।

খন্দকার মোশতাক নামের এই পাপের জন্ম হয়েছে ১৯১৮ সালে, কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দির দাসপাড়া গ্রামে। জন্মই যার আজন্ম পাপ, তার কাজকর্মও হবে পাপে পরিপূর্ণ। এই মহাপাতক জীবনের সবচেয়ে বড় পাপ কাজটি করেছিল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার মাধ্যমে। নিজ হাতে হত্যা করেনি, হত্যা সে করিয়েছিল। পাশে পেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে।

জিয়ার সমর্থকরা তাদের নেতার কৃতকর্মকে ‘ছেঁড়া গেঞ্জী আর ভাঙ্গা স্যুটকেস’ দিয়ে যতই আড়াল করার চেষ্টা করুক না কেন, ছেঁড়া গেঞ্জীর ফোঁকর গলে আসল সত্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। এখন বাংলাদেশের স্কুল পড়ুয়া কিশোরটিও জানে, জিয়াউর রহমান সাহেবের প্রায় প্রত্যক্ষ সমর্থন এবং সহযোগীতা পেয়েই মেজর ফারুক, মেজর রশিদ, মেজর ডালিমদের মত কিছু পাকিস্তানপ্রেমী কুলাঙ্গার বঙ্গবন্ধুকে তাঁর শিশুপুত্র শেখ রাসেলসহ হত্যা করেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার অন্তরালে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সাহেবের প্রত্যক্ষ ভূমিকা যে ছিল, এবং এই দ্বিতীয়বার পলাশী প্রান্তর সৃষ্টির মূল কারিগর যে মোশতাক খন্দকার নামের বিশ্বাসঘাতক তা খুব সহজ উপায়ে জানতে হলে, আবদুল গাফফার চৌধুরীর ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ ছবিটি দেখতে হবে। মাত্র দুই ঘন্টার ছবিতে উনি বঙ্গবন্ধু হত্যার সম্মুখ এবং অন্তরালের কুশীলবদের স্বরূপ উন্মোচন করে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার অব্যবহিত পরেই মোশতাক খন্দকার দেশের সিংহাসনে আরোহণ করেছিল, তবে পাপ থেকে কখনওই একটি পাপ জন্ম নেয়না, পাপের পর পাপ, তারও পরে আরও পাপের জন্ম হয়।

মোশতাক খন্দকার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তার নির্দেশ ও যোগসাজশে ’৭৫ এর ৩রা নভেম্বার জেলে অন্তরীণ অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে জাতীয় চার নেতা তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ মনসুর আলী এবং মোহাম্মদ কামরুজ্জামানকে। তার প্রেসিডেন্ট হবার বাসনা ছিল, বাসনা পূর্ণ হয়েছে, ১৫ই আগস্ট থেকে ৬ই নভেম্বার, মাত্র আড়াই মাসের প্রেসিডেন্ট বিশ্বাসঘাতক মোশতাক ৬ই নভেম্বার কারাবন্দী হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতার হত্যাকারীদেরকে বাঁচাতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে তাদেরকে বিচারের আওতামুক্ত করে দিয়ে গেছিল। এক বিশ্বাসঘাতক মোশতাক পাশে পেয়েছিল আরেক বিশ্বাসঘাতক জিয়াউর রহমানকে। জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধু পুত্রবৎ স্নেহ করতেন, উনার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে কন্যাবৎ স্নেহ করতেন, মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য ( মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা নিয়ে উনার অনেক সহযোদ্ধা ভিন্নমত পোষণ করে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু বই লিখেছেন) তাঁকে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান পদে প্রমোশানও দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য জেনারেল শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর একান্ত বিশ্বস্ত মোশতাকের সাথে হাত মিলিয়েছিল, তাদের যৌথ কুটিল প্রচেষ্টায়, পাকিস্তানী মতাদর্শের অনুসারী ঘাতকের হাতে দেশের স্থপতি,জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-বান্ধব, তরুণ-যুবা, নারী-শিশু, অন্তঃসত্বা ভাগ্নেবৌ(শেখ মনি’র স্ত্রী), সহকর্মী, কর্মচারীকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল।

জিয়াউর রহমানের ভাগ্য ভাল যে কালো চশমা দিয়ে উনি তার অপকর্মকে আড়াল করতে পেরেছিলেন, মোশতাক তার জিন্নাহ টুপী দিয়ে দশহাত লম্বা, হিংসার লকলকে জিভ আড়াল করতে পারেনি। ক্ষমতার লোভ অনেক বড় লোভ, এই লোভ কাউকেই আপন হতে দেয়না। মোশতাককেও দেয়নি, তাকে ৬ই নভেম্বার কারাবন্দী করা হয়, ৭ই নভেম্বার কর্ণেল তাহেরের সহযোগীতায় জিয়াউর রহমান সাহেব দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন, জিয়াউর রহমান সাহেব ছিলেন পুরো দস্তুর আর্মী অফিসার, মায়া দয়া বলে কিছুই তার অন্তরে ছিলনা, বঙ্গবন্ধু হত্যায় মদদ দিতেও বুক কাঁপেনি, উপকারী বন্ধু কর্ণেল তাহেরকে (পঙ্গু অবস্থায়) ফাঁসীর দড়িতে ঝুলাতেও কালক্ষেপন করেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর, যখন সাধারণ মানুষ হতবিহবল, ঘটনার আকস্মিকতায় সকলেই যখন বিমূঢ়, ঠিক তখনই সেনাবাহিনীর ক্ষমতালোভী জেনারেলগণ সামরিক আইন জারী করে দেশবাসীর মুখে গোদরেজ তালা আটকে দিয়েছিল। জনগণ নিজেদের মধ্যেও কথা বলতো ইশারার মাধ্যমে।

বঙ্গবন্ধু তো দূরে থাক, শেখ মুজিবের নামটিও উচ্চারণ করা নিষেধ ছিল। মনে পড়ে, আমার সেই শিশু বয়সে বড়দের মুখ থেকে প্রতি মুহূর্তে ফিসফিসিয়ে উচ্চারিত “এই চুপ চুপ, বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করিসনা” সাবধানবাণী। এখন ভাবলেই অবাক হয়ে যাই, জীবদ্দশাতেই দেখে গেলাম, জীবদ্দশাতেই উচ্চারণ করে গেলাম বঙ্গবন্ধুর নাম। কোনদিন কি ভেবেছিলাম আজকের দিন আসবে, খোলা মনে, খোলা হাতে কম্পিউটার কীবোর্ডে ফটাফট করে টাইপ করে প্রকাশ করতে পারবো, সেদিনের কথা, সেদিনের দুঃসহনীয় স্মৃতিগাঁথা! আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে বর্তমান প্রজন্ম জানতে পারছে, পাপ তার বাপকেও ক্ষমা করেনা। কুষ্ঠ রোগ এমনই এক ঘৃন্য রোগ যার আক্রমনে সারা শরীরের মাংস পচে যায়, কাউকে অভিসম্পাত করতে হলেই মানুষ বলতো, ‘কুষ্ঠ হবে তোর’, সেই কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়ে মীরজাফর মরেছিল, পাপ তাকে ক্ষমা করেনি।

একাকী নির্জন কক্ষে মরেছিল আজকের মীরজাফর খন্দকার মোশতাক আহমেদ, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কারণে যার মৃতদেহ জাতীয় পতাকায় আবৃত হওয়ার কথা ছিল, সেই ঘৃণ্য মানুষটির মৃত্যু সংবাদ দেশবাসী জেনেছিল অনেক পরে, পাপ তাকে ক্ষমা করেনি। আর ক্ষমতার লিপ্সা কাতর জেনারেল জিয়াউর রহমান সাহেবকেও প্রাণ দিতে হয়েছে উনার মতই আরেক দল ক্ষমতা লোভী জেনারেলদের হাতে, গুলীতে উনার শরীর ঝাঁঝরা হয়ে উনার মুখমন্ডলটাও ক্ষত বিক্ষত হয়ে গেছিল। উনার প্রিয়জনেরা উনার মুখটুকুও অক্ষত অবস্থায় দেখতে পায়নি, পাপ উনাকেও ক্ষমা করেনি। বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করার মাধ্যমে অখন্ড ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসণ কায়েম হয়েছিল, ২০০ বছরের জন্য ভারতবাসী ইংরেজদের গোলাম হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে মিলিটারী শাসণ কায়েম হয়েছিল, বন্দুকের নলের খোচায় বাহাত্তরের সংবিধান ছিঁড়ে গিয়েছিল, সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা মুছে গিয়েছিল, মিলিটারী শাসকের বন্দুকের ভয়ে সাধারণ বাঙ্গালীর মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিয়েছিল, বন্দুকের নলের ডগায় ভর করে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামী দেশে রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছিল, সংবিধানে অসাম্প্রদায়িকতার পরিবর্তে সাম্প্রদায়িকতা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুকে একপ্রকার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

এ সবই হয়েছিল মোশতাক খন্দকারের বেঈমানী এবং বিশ্বাসঘাতকতার কারণে। বাংলায় প্রবাদ আছে, “যারে দিয়ে চক্ষুদান, তারে করি অপমান”। মোশতাক খন্দকারের কারণেই দেশ আজ পাপের ভারে ডুবে যেতে চাইছে, ডুবতে পারছেনা শুধু বর্তমান প্রজন্মের এক ঝাঁক মেধাবী তরুণ-তরুণীর লড়াকু মনোভাবের কারণে। বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবরণের পর থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসণকাল পর্যন্ত যে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত হতোনা, সেই বঙ্গবন্ধুর সব বয়সের ছবি, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ, বাংলাদেশের পতাকা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কালজয়ী গানে অনলাইন পরিপূর্ণ হয়ে থাকে। ফেসবুক, ইউ টিউবসহ প্রতিটি জনপ্রিয় অনলাইন মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বিরাজিত।

অবশ্য এখনও কিছু বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী আমাদের চারপাশে রয়ে গেছে যারা বঙ্গবন্ধু বলতে শুধু ‘বাকশাল’ বুঝে, তারা বঙ্গবন্ধুর দুঃসাহসী রাজনৈতিক জীবন, বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ কারাজীবন সম্পর্কে হয় জানেনা, নয়তো পাছে হেরে যাবে ভয়ে মুখ খোলার সাহস পায়না। এরা আগেও ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। সুখের কথা, জনগণ এদেরকে চিনতে পারছে। সেদিন পড়ছিলাম বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী। বইটি হাতে নিয়ে উলটে পালটে দেখছিলাম, বইয়ের পেছনের মলাটে তাকালাম, বঙ্গবন্ধু বলছেন, " একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম।

হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, “ হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি”। আমি আর রেণু দু’জনই শুনলাম।

আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, “ আমি তো তোমারও আব্বা”। কামাল আমার কাছে আসতে চাইতোনা। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছেনা। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভুলে যায়! আমি যখন জেলে যাই তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস।

রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা আর তার আত্মীয়স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘুন্য কাজ তা কে বুঝবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়”। এটুকু পড়ে আমার খুব কান্না পেয়ে গেল। মানুষের জীবন কত অনিশ্চিতে ভরা। যে কুট্টি ছেলেটি জ্ঞান হয়ে তার আব্বুকে দেখেনি, যে ছোট্ট ছেলেটি অনেকদিন পর্যন্ত জানতো, এই মানুষটি শুধুই হাসু আপার আব্বু, যার আব্বু সারাজীবন জেলে কাটিয়েছে, যার আব্বু একটি দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, সেই আব্বুর সাথে স্বাধীন দেশে যখন ছেলেটি বসবাস শুরু করলো, ঠিক তখনই একদল বিশ্বাসঘাতকের বুলেটের আঘাতে সেই আব্বুর সাথেই তার এবং পরিবারের সকলের প্রাণ বেরিয়ে গেল! এমনকী আব্বুর আগেই ওরা তার প্রাণটি কেড়ে নিল।
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.