উত্তপ্ত হয়ে উঠছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের রাজনীতি। কারণটি স্পষ্ট। পরবর্তী নির্বাচনের আর মাত্র কয়েক মাস বাকি। এবারের নির্বাচন হবে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য অত্যন্ত কঠিন। শাসন বজায় রাখার অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন কংগ্রেস এবং মিত্ররা।
প্রচণ্ড চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে শাসক ইউপিএ মোর্চা এ কারণে যে, বিরোধী জোটের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেই সবার ধারণা। টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থেকে কংগ্রেসের নেতৃত্বে বহুদলীয় জোটের সামনে দুঃসময় বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। যদিও বিরোধী এনডিএ মোর্চা সাম্প্রদায়িক বলে পরিচিত ভারতীয় জনতা পার্টি অর্থাৎ বিজেপির নেতৃত্বে চালিত, তথাপি কংগ্রেস ভুল-ভ্রান্তির কারণেই বিরোধীদের সুসময়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। অবশ্য অনেকটা হঠাৎ করেই বিরোধী শিবিরে আবিভর্ূত হয়েছেন আগামী দিনে প্রধানমন্ত্রীর সম্ভাবনা নিয়ে বিতর্কিত কিন্তু দক্ষ শাসক হিসেবে পরিচিত নরেন্দ্র মোদি। তার এই উদ্ভব দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে যেমন বিতর্ক ও আলোচনার সঞ্চারণ ঘটিয়েছে, তেমনি চাঞ্চল্য ও কৌতূহলেরও সৃষ্টি করেছে।
রাজনীতিতে বেশ আগে থেকেই মোদি আলোচিত ব্যক্তি। কিন্তু সেটা ছিল সীমিত পরিসরে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে। এখন তিনি তার দল বিজেপি কর্তৃক মনোনীত হয়ে আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বাসনা নিয়ে সরব পদচারণা শুরু করেছেন। তার জন্য এটা কোনো অলীক কল্পনা নয়।
অনেক নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক মোদিকে পছন্দ না করলেও তার মাঝে দেখতে পাচ্ছেন ভারতের পরবর্তী সরকার প্রধানের ছায়া।
অন্যদিকে কংগ্রেস ও মিত্রদের পছন্দ তরুণ নেতা রাহুল গান্ধী। যদিও সরকারিভাবে তাকে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখনো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শাসক মোর্চা চিত্রায়িত করছে না। দেশটির খ্যাতনামা ও ঐতিহ্যবাহী নেহরু-গান্ধী রাজনৈতিক পরিবারের কোনো সদস্য অনেক বছর যাবৎই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নন। যদিও সংগঠন ক্ষমতায় আছে। এটা দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়, অনেকের কাছে পীড়াদায়কও বটে।
কেননা ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, তদীয় কন্যা ইন্দিরা গান্ধী ও তার পুত্র রাজীব গান্ধী প্রতাপ নিয়েই দীর্ঘদিন দেশটির প্রধানমন্ত্রী হয়ে বিচরণ করেছেন। এই পরিবারের আরও দুজন- জওহরলালের পিতা মতিলাল নেহরু এবং ইন্দিরার কনিষ্ঠ পুত্র সঞ্জয় গান্ধীও কংগ্রেস রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন।
১৯৮০ সালে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত না হলে হয়তো সঞ্জয় গান্ধী ভারতের সরকার প্রধান হতেন। বর্তমানে কংগ্রেসের নেতৃত্বে আছেন রাজীবের বিধবা পত্নী সোনিয়া গান্ধী এবং তার পুত্র রাহুল গান্ধী। মাতা সংগঠনের প্রধান, পুত্র উপ-প্রধান।
তবে কংগ্রেস ও শাসক ইউপিএ মোর্চায় প্রায় একচ্ছত্র প্রাধান্য থাকলেও মাতা-পুত্র কেউই এখনো কোনো সরকারি পদ গ্রহণ করেননি। তারা সংগঠন নিয়েই ব্যস্ত। তবে কংগ্রেসের অসংখ্য সদস্য ও অনুরাগীরা নেহরু-গান্ধী পরিবারের কাউকে আবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান। মাতা-পুত্র প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি বানাচ্ছেন, কিন্তু নিজেরা হচ্ছেন না। এর মধ্যে প্রজ্ঞা ও ত্যাগের একটা উপাদান থাকলেও বিষয়টি অনেক দলীয় নেতা-কর্মীর কাছে আবেগপ্রবণ থেকে উৎসারিত।
তারা এ ব্যাপারে আর দেরি করতে চান না।
ইতালীয় বংশোদ্ভূত সোনিয়া গান্ধী ২০০৪ সালের কঠিন নির্বাচনী জয়ের পর প্রায় সবার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে প্রধানমন্ত্রীর আসন অলঙ্কৃত করেননি। বরং তারই সুপারিশে সেই পদে আসীন হলেন বর্ষীয়ান মনমোহন সিং। যিনি দক্ষ ও অভিজ্ঞ অর্থনৈতিক প্রশাসক হিসেবে বিবেচিত হলেও রাজনীতিবিদ হিসেবে তেমন পরিচিত ছিলেন না। সোনিয়া প্রায় শেষ মুহূর্তে সরকার প্রধান হলেন না।
তিনি একজন 'বিদেশিনী' হয়ে ভারতের মতো ১২০ কোটি মানুষের দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে বিরোধীদের তার বিরুদ্ধে তাক করা অস্ত্র আরও শাণিত করার সুযোগ দিতে চাননি। ধীরে ধীরে হয়তো সেই দায়িত্বের জন্য গড়ে তুলেছেন তরুণ পুত্র রাহুল গান্ধীকে। মাতা-পুত্র দুজনই দুই মেয়াদ ধরে সংসদ সদস্য উত্তর প্রদেশের রায় বেরোলি এবং আমেথি নির্বাচনী এলাকা থেকে। রাজনীতিতে তাদের 'অ্যাপিল' অর্থাৎ প্রভাব নিয়ে নিম্ন প্রতিক্রিয়া থাকলেও কংগ্রেসকে বেশ কয়েক বছর পর ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার কৃতিত্ব অনেকটাই তাদের। কিন্তু কথা হলো, রাহুলের অপেক্ষা আর কতদিন?
বিশ্লেষকদের ধারণা, ৮০ বছর অতিক্রান্ত মনমোহন সিং আর আগামী নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী থাকবেন না, যদি শাসক মোর্চা ক্ষমতায় আসতে সক্ষম হয়।
তাহলে কে হবেন দলের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী? নির্বাচন ২০১৪ সালের এপ্রিল/মে মাসে হওয়ার কথা। মাত্র কয়েক মাস বাকি। নির্বাচনী প্রচারণা এক অর্থে শুরু হয়ে গেছে। অন্য কোনো সিনিয়র নেতার নামও কংগ্রেস থেকে শোনা যাচ্ছে না। বরং দ্বিগ্বিজয় সিং, সুশীল কুমার সিন্ধে, গোলাম নবী আজাদ, পি. চিদাম্বরম ও সালমান খুরশিদরা রাহুলের কথাও বলছেন।
কিন্তু তাকে কি শেষ পর্যন্ত সোনিয়া 'গ্রিন সিগনাল' দেবেন প্রধানমন্ত্রীর প্রার্থীর জন্য? সেই সবুজ সংকেত দিলেও রাহুল কি পারবেন ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে! এটা নিয়ে রয়েছে সীমাহীন কৌতূহল এবং আগ্রহ ও কিছুটা সংশয়।
নরেন্দ্র মোদি কিন্তু এরই মধ্যে দলীয় ও মোর্চার প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে কর্মকাণ্ড শুরু করে দিয়েছেন। দিল্লিতে এ ধরনের প্রথম জনসভায় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী মোদি বলেন, 'শাহজাদা'কে দিয়ে স্বপ্ন দেখে লাভ হবে না। স্পষ্টত তিনি রাহুলকেই 'শাহজাদা' হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, সরাসরি মাতা-পুত্র সরকারে না থাকলেও তারাই পরোক্ষভাবে দেশ শাসন করেছেন গত ১০ বছর- যখন 'অদক্ষতা, দুর্নীতি এবং ব্যর্থতা' জাতিকে গ্রাস করেছে। তিনি এর পরিবর্তনের জন্য দেশবাসীর সহযোগিতা চাচ্ছেন।
তবে দলের মধ্যেও মোদিকে নিয়ে বিতর্ক আছে। পক্ষান্তরে কংগ্রেস বলছে, কোনো সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি, যার হাত সংখ্যালঘুদের রক্তে কলঙ্কিত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন না।
উল্লেখ্য, ২০০২ সালে গুজরাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ২০০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়, যার অধিকাংশই মুসলিম। মোদির বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল ও সংখ্যালঘুদের অভিযোগ হলো, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মোদি সেই দাঙ্গা বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেননি। বরং সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে উসকানি দিয়েছেন রাজ্যের সরকার প্রধান হিসেবে।
দেশ-বিদেশে মোদি সে কারণে বেশ নিন্দিত। যুক্তরাষ্ট্র তাকে 'ভিসা' দেয় না। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ভারতের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী মোদিকে মানায় না। তবে মোদির সমর্থকও আছে। গুজরাটের খুবই সফল মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি রাজ্যটিকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন।
তাই ভারতের ব্যবসায়ীরা মোদিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান।
উল্লেখ্য, সাম্প্রতিককালে মনমোহনের সরকার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাফল্য দেখাতে পারছে না, যদিও আগে দেখিয়েছে। এ ছাড়া সরকার বেশ কয়েকটি বড় ধরনের দুর্নীতির ঘটনায় জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। তবে ভারতে শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা দুর্নীতির ঊধের্্ব থাকতেই সচেষ্ট থাকেন। সোনিয়া-রাহুল-মনমোহন-প্রণব-চিদাম্বরম-আহমেদ-প্যাটেলদের বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির তেমন অভিযোগ নেই।
বরং প্রধানমন্ত্রী নিজেই তার সম্পত্তির হিসাব দিয়েছেন- যা কিনা একজন দীর্ঘদিনের সরকার প্রধান, যিনি আগেও অনেক বছর বেশ প্রভাবশালী পদে ছিলেন- কিছুই নয়। আমাদের বাংলাদেশের চিত্রটা বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীনদের বেলায় কেমন? এটা বলার দরকার হয় না। ভারতের দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী বা অন্যদের বের করে দেওয়া হয়, কপালে দুঃখ থাকে। আমাদের এখানে এমনকি নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সম্পদের হিসাব দেওয়া হয়নি।
নরেন্দ্র মোদি হিন্দু জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী এবং সে কারণে তিনি বিতর্কিত।
তবে আর্থিকভাবে সৎ হিসেবে পরিচিত ৬৩ বছর বয়সী দক্ষ এই মুখ্যমন্ত্রী। অনেকে মনে করেন, তুলনামূলকভাবে কম বয়সী মোদি ৪২ বছরের রাহুলের মোকাবিলা করতে পারবেন। কে হবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী আগামী নির্বাচনের পর? নাকি নির্বাচনের ফলাফলের জটিল রসায়নের কারণে 'ডার্ক হর্স' অর্থাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে অন্য কেউ! যেমনটা হয়েছিলেন এইচডি দেব গৌড় কিংবা হওয়ার মতো অবস্থায় উপনীত হয়েছিলেন জ্যোতি বসু?
ভারতের নির্বাচন নিয়ে উত্তাপ বাড়ছে। সেখানে ভোটপর্ব নিয়ে বিভ্রান্তি এবং সংশয় নেই। প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা আছে।
সেখানে নেই 'কেয়ারটেকার' সরকারের দাবি কিংবা স্বীয় সংকীর্ণ স্বার্থের অভিপ্রায়ে 'ব্রুট' মেজরিটির সুবিধা নিয়ে সংবিধান সংশোধনের অভিযোগ। সেখানে দেশের নির্বাচন ও অনাগত দিনের চিত্র নিয়ে নেই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে স্বচ্ছ ভোট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। যেখানে ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলের 'হেভিওয়েট' রাজনীতিবিদরা সহজে ধরাশায়ী হন। ইন্দিরা গান্ধীর মতো বিশ্বনন্দিত নেত্রী সহজে হেরেছিলেন রাজ নারায়ণের কাছে ১৯৭৭ সালে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে।
আমাদের মতো রাস্তাঘাটে সর্বত্র গভীর উৎকণ্ঠা পরিলক্ষিত হয় না প্রায় দ্বারপ্রান্তে উপনীত হওয়া নির্বাচন নিয়ে।
সেদিন হাসপাতালে এক রোগীকে দেখতে গিয়েছিলাম। সংবাদপত্রে ফটোসংবলিত কলাম কিংবা টেলিভিশনে দেখতে পেয়ে পাশের বেডের রোগী আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'আমরা কোন দিকে যাচ্ছি? কি হতে যাচ্ছে কিছু দিন পর?' কাছেই ডাক্তার ছিলেন। তিনি সেই রোগীকে বললেন- 'আপনার শরীরের কথা ভাবুন- দেশের চিন্তা করে কি হবে!' কিন্তু সেই রোগী উত্তর দিলেন- 'দেশের অনিশ্চিত নিকট ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবতে হয়। ' এ মন্তব্যটি তাৎপর্যপূর্ণ।
যারা আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করেন, তারা কি ভাবছেন। জনগণের ধারণা সম্পর্কে তারা কি অবগত আছেন? তাদের 'অনড়' অবস্থান কি সংকটকে আরও জটিল করে তুলছে না! 'লস অব ফেইস' কি দেশ ও জনগণের থেকে ঊর্ধ্বে ? কই, ভারতের সুশীল সমাজ তো এতটা অন্ধভাবে দলীয় কথা বলে না।
দ্বিমতের কারণে সেখানে কথায় কথায় কাউকে 'মুরতাদ' কিংবা 'রাজাকার' বলা হয় না। ইস্যু ভিত্তিকভাবেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিচার করা হয়। ভারত আমাদের বাইরে নয়- দক্ষিণ এশিয়ারই অংশ।
অর্থাৎ 'শক-হুন দল-পাঠান, মোগল এক দেহে হলো লীন। তাদেরও সমস্যা আছে, আমাদেরই মতো। তবে গণতন্ত্র ও নৈতিকতার ভালো দিকগুলো তাদের কাছ থেকে আমরা শিখছি না কেন? আগামী নির্বাচনে 'শাহজাদা', মোদি, নাকি অন্য কেউ আসবে, সেটা জনগণই সত্যিকারভাবে ঠিক করবে- বিভ্রান্তির অবকাশ নেই।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।