হতাশা আর দু;খ ব্যাথা যাদের দেখে থমকে দাঁড়ায় আজকে তাদের খুব প্রয়োজন, বিশ্ব এসে দু হাত বাড়ায়। নতুন বছর-নতুন বইঃ স্মৃতি হাতড়ানো, প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা
সড়ক পথে ঢাকার বাইরে যাবার সময় যে জিনিষটা অসম্ভব ভাল লাগে তা হলো দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের ক্ষেত। আরেকটা জিনিষ নয়ন জুড়িয়ে দেয় তা হলো গ্রামের ছেলে-মেয়েদের সারি ধরে স্কুলে যাওয়া আসার দৃশ্য।
জানুয়ারীর ২ তারিখ ঢাকা থেকে সিলেট যাচ্ছিলাম। মাঝে মাঝেই হলদে ফুলে ছেয়ে যাওয়া সরিষার ক্ষেত দেখে মনটা ভরে যাচ্ছিল।
দুপুরের দিকে দেখা পেলাম স্কুল ফেরত শিশুদের। স্কুল ড্রেস পরা এক দল মেয়ে ফিরছে বাসার পথে। বেশ প্রাণোচ্ছল আর হাসি-খুশী। ওদের হাসি মুখ বাংলাদেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে সাহস যোগায়। উন্নয়নের বিভিন্ন সুচকে বাংলাদেশ যে ক্রমেই অগ্রসরমান, বেশ কিছু সুচকে যে আমরা ভারতের চেয়েও এগিয়ে ওরা যেন তার চাক্ষুষ প্রমাণ।
সবার হাতে নতুন বই। অনেক নাই এর দেশেও একটা সাফল্য দেখে খুব ভাল লাগলো।
স্কুলে যাওয়া বাচ্চাদের কাছে নতুন বছরে নতুন বই এর চেয়ে বড় উপহার আর কি হতে পারে? ছোট বেলার একটা ঘটনা স্মৃতিপটে জ্বল জ্বল করে এখনো। একবছর খুব অসুস্থ ছিলাম। নতুন ক্লাশে উঠেছি কিন্তু স্কুলে যেতে পারছি না কারন শরীরে জ্বর।
এমনি এক সন্ধ্যায় দেখি আব্বা নতুন বই নিয়ে এসেছেন। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়তে বসে গেছি। আমার এখনো মনে পড়ে আব্বার মন্তব্যঃ বই পেলে জ্বর ভালো হবে জানলে আগে ঔষধ না কিনে বইই কিনে আনতাম! সেটা সম্ভবত ক্লাশ ফোর অথবা ফাইভে ওঠবার বছরের ঘটনা।
আমরা যখন প্রাইমারী তে পড়তাম তখন সরকার বই ফ্রি দিত না। নতুন বছর শুরু হলে অপেক্ষায় থাকতাম কখন আব্বা বই কিনে দিবে।
বই বের হতে যেমন দেরী হতো তেমনি আব্বার শহরে যাওয়ার দেরী কিম্বা বিভিন্ন কারনে (হয়ত অর্থনৈতিক কোন ব্যাপার ছিল যা বুঝবার বয়স তখন হয়নি) বই পেতে বেশ দেরী হতো। হয়ত স্কুল শুরু করতাম খালি হাতেই, তারপর এক সময় বই পেতাম। আর হাইস্কুলে তো নতুন বই চোখে দেখবার মত সৌভাগ্যবান ছিলাম না। এক ক্লাস উপরে পড়া কোন বড় ভাইয়ের কাছ থেকে পুরাতন বই কিনতাম। এক বছরের পুরাতন হলে বইয়ের গায়ে লিখা দামের দুই-তৃতীয়াংশ দাম দিতে হতো।
আর দুই বছরের পুরাতন হলে অর্ধেক। আমি সাধারনত এক বছরের পুরাতন বই কিনতাম দুই-তৃতীয়াংশ দামে আর অর্ধেক দামে পরের বছর বেচে দিতাম। নিজের বই বিক্রির পর যে টাকা পেতাম তার সাথে আব্বার দেয়া ভুর্তকির টাকা যোগ করে নতুন বছরে পুরাতন বই কিনতাম। সেগুলিতে মলাট (সাধারনত সিমেন্টের ব্যাগ কিনে নিয়ে সেটা কেটে কেটে মলাট করা হতো) লাগিয়ে নতুন করতাম, দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানো আর কি।
এ বছর পহেলা জানুয়ারী কোমল মতি শিশুদের হাতে বই তুলে দিয়েছে সরকার।
আমি নিশ্চিত কোন কোন প্রাইভেট অফিস পাওয়া যাবে জানুয়ারীর এক তারিখে তাদের ডায়েরী-ক্যালেন্ডার বের করতে পারেনি। সেখানে সরকারের পক্ষে কোটি কোটি ছাত্র-ছাত্রীর জন্য সময় মত বই ছাপিয়ে তা সারাদেশে ছড়ানো-ছিটানো স্কুলে পৌছিয়ে দেয়া, সোজা কথা নয়।
সাধারন ভাবেই ধরা হয় সরকার যন্ত্র হয় আমলাতান্ত্রিক (ব্যুরোক্রাটিক), তাই তারা তুলামুলকভাবে অদক্ষ্য। আর গোদের ঊপর বিষ ফোড়ার মত আছে দুর্ণীতি। যার প্রমান পদে পদেই আমরা দেখি।
একটা ফুটওভার ব্রিজ করতে এখানে একবছরের বেশি সময় লাগে, ম্যানহোলের ঢাকনা গায়েব হয়ে গেলে তা রিপ্লেস করতে কতদিন লাগে তা বোধ হয় কেউ জানেনা। প্রথম ছয় মাসে এডিপির বাস্তবায়ন হয় দশ থেকে পনের শতাংশ। আর পাচ বছরের চেষ্টায়ও শুরু করা গেল না পদ্মা সেতু। এরকম অসংখ্য অদক্ষ্যতা ও ব্যার্থতার দেশে সরকারযন্ত্র ব্যাবহার করে জানুয়ারীর এক তারিখ ছোট সোনা-মনিদের হাতে নতুন বই তুলে দিতে পারাটা অবশ্যই প্রশংসা পাবার যোগ্য। আমরা আশা করি সরকারের অন্যান্য ডিপার্টমেন্ট গুলো এখানের সফলতার উপাদান গুলি (success factors) তাদের কাজের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ/গ্রহন করবেন।
আরো একটি ভাল খবর আসল এর মধ্যেই। সরকার ২৬ হাজার বেসরকারী পরাইমারী স্কুল কে জাতীয় করন করছে। সকল নাগরিকের শিক্ষার ব্যবস্থা করা সরকারের নৈতিক দ্বায়িত্ব আর আর স্কুল সমুহ জাতীয় করন করবার মাধ্যমে সরাকার সেই দ্বায়িত্বের প্রতি তাদের অংগীকার পুণর্ব্যাক্ত করলেন বলেই আমরা মনে করি। এর জন্য সরকার ধন্যবাদ পাবার যোগ্য।
বাংলাদেশের শিক্ষার উন্নতি শুধু সময়মত বই দেয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়।
আরো কিছু উদাহরন দেয়া যায়। প্রাইমারী স্কুলের ভর্তির হার প্রায় ৯৭ (মেয়ে) আর ৯৪ (ছেলে)। ১৫-২৪ বছরের বয়সী জনসংখ্যার মধ্যে শিক্ষিতের হার ৭৪ (ছেলে) আর ৭৭ (মেয়ে)। [তথ্য সুত্রঃ ইউনিসেফ ওয়েবসাইট)। যে কোন পাবলিক পরীক্ষায় পাশের হার এখন ৮০ এর উপর, হাজার হাজার জিপিএ-৫, পিএসসি থেকে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত।
দেশে সরকারী–বেসরকারি বিশবিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে।
যেতে হবে আরো বহুদুর! শিক্ষার হার এবং গুণগতমান বৃদ্ধি টেকসই উন্নতির একমাত্র পন্থা। প্রাইমারী তে ভর্তির হার সন্তোষজনক কিন্তু ঝরে পরার হারও আশংকাজনক, যারা প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয় এর প্রায় ৪০ শতাংশ পঞ্চম শ্রেনীর পুর্বেই ঝরে পড়ে (সুত্রঃ ইউএসএইড রিপোর্ট)। সম্প্রতি প্রথম আলোয় একটা রিপোর্ট এসেছে যে ২০১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়া ৪৪ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে, যারা মেট্রিক ইন্টারমিডিয়েটে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত, তাদের ৫৫ শতাংশ উত্তীর্ণ হতে পারে নি। বিগত দুই বছরে এই অনুত্তীর্ণের হার ছিল ৫৩ ও ৫২ শতাংশ।
উল্লেখ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ১২০ নম্বরের পরীক্ষায় ন্যুনতম ৪৮ পেতে হয় অথচ এরা মেট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট দুই পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন।
নিম্নমানের দ্রব্যকে চকচকে মোড়ক ও মনভোলানো বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাজারে চালিয়ে দেবার মত কর্পোরেট বেনিয়া মানসিকতা যেন আমাদের শিক্ষাব্যাবস্থা কে পেয়ে না বসে। শুধু ভালো রেজাল্ট দেখাতে হবে এজন্য জোর করে পাশের হার বাড়িয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে বাবল তৈরী হোক সেটা কাম্য নয়। শিক্ষায় উন্নতির যে ধারা তৈরী হয়েছে তাকে আরো বেগবান করতে হবে, সংখ্যার পাশাপাশি শিক্ষার সঠিক গুণগতমান নিশ্চিত করতে হবে। ভবিষ্যত প্রজন্মের উন্নত মানের শিক্ষার নিশ্চয়তা দেশকে স্বপ্ন দেখতে সাহসী করবে আমাদের।
যদি আমরা তাদের উন্নত শিক্ষা নিশ্চিত করি, তাহলে আমাদের সন্তানেরা এই দেশ কে বিশের দরবারে মাথা উচু করে দাড় করাবে। সেদিন দিনের স্বপ্ন নিয়েই আমাদের নিত্য পথ চলা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।