শটটা চার হবে বুঝতে পেরেই ড্রেসিং রুমের দিকে ফিরে ব্যাট ছুঁড়লেন বাতাসে। আলতো করে, যেন কত না অস্বস্তি! মুখে খানিকটা হাসিও খেলে গেল যেন। হঠাত্ বুঝি মনে হলো, হেলমেটটা খোলা উচিত। অপটু হাতে হেলমেট খুলে দু হাত ছুঁড়লেন আকাশে। তবে মাত্রই কয়েকটি মুহূর্তেও জন্য, যেন একটু লজ্জাও পাচ্ছেন—‘পাছে কেউ যদি দেখে ফেলে!’
স্বপ্ন পূরণের মুহূর্তটা নিয়ে প্রায় সবাই নানারকম ছবি এঁকে রাখেন মনে মনে।
মমিনুল হকও নিশ্চয়ই ভেবে রেখেছিলেন প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিটার উদযাপন করবেন কীভাবে। কিন্তু সত্যিই স্বপ্নের দেখা পাওয়ার পর যেমন তাত্ক্ষণিক উচ্ছ্বাসের তোড়ে ভেসে যায় সব পূর্ব-ভাবনা, মমিনুলও যেন ভুলে গেলেন সবকিছু। প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি পাওয়ার উদযাপনে ফুটে উঠল সত্যিকারের মমিনুল—কথায়-আচরণে মোটেও সপ্রভিত নন যিনি। সমুদ্র শহর কক্সবাজারের ছেলে তিনি, কিন্তু সাগরের মতো ঠিক উচ্ছ্বল-উত্তাল-পল্লবিত নন। খানিকটা মুখচোরা স্বভাবের, পাদপ্রদীপের আলোর চেয়ে নির্জন কোণে নিজের মতো থাকাই যাঁর পছন্দ।
মিছিলের ভিড়েও যিনি অন্যের আড়ালে নিজেকে লুকোতে চান।
তবে চাইলেই তো আর সবসময় লুকোনো যায় না। আলো এতটা উজ্জ্বল হলে রোশনাইয়ের উত্স সবাই খুঁজবেই! এই মুহূর্তেই যেমন পাদপ্রদীপের আলোয় মমিনুল। চট্টগ্রাম টেস্টে তাঁর ব্যাটিং ব্যক্তিগত চরিত্রের পুরোই উল্টো। দারুণ সপ্রভিত।
চোখ আর মনকে প্রশান্তি দেওয়া সব ড্রাইভ ছড়িয়েছে সৌন্দর্যের ছটা, পুল শটে ফুটে উঠেছে শৌর্য, একেকটি লফটেড শট প্রমাণ দিয়েছে সাহসিকতার। সিরিজের আগে বাংলাদেশের সব ক্রিকেটারের ভিডিও ফুটেজ দেখে গবেষণার কথা বারবার বলেছিলেন বন্ড-টেলর-ম্যাককালামরা। কিউইদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না ৫ ফুট ২ ইঞ্চির মমিনুলের ভেতর লুকিয়ে আছে এতকিছু!
কাল যখন উইকেটে গিয়েছিলেন, ৮ রানে ২ উইকেট হারিয়ে ফেরেছে বাংলাদেশ। অসংখ্য অতীত ইতিহাসের কারণে তখন আরেকটি ব্যাটিং বিপর্যয়ের শঙ্কা। দুর্দান্ত সব শটে সেই শঙ্কাগুলোকে ঝেটিয়ে মাঠের বাইরে পাঠাতে থাকলেন মমিনুল।
এই মন্থর উইকেটেও টাইমিংয়ের এমন প্রদর্শনী মেলে ধরলেন, এই ইনিসের পর তাঁর ড্রাইভ খেলার অসাধারণ দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থাকার কথা নয় কারও। মমিনুলের ডাক নাম সৌরভ। অফসাইডে তাঁর ড্রাইভগুলো মনে করিয়ে দিয়েছে এমন একজনকে, অফসাইডে যাঁকে মনে করা হয় ঈশ্বরের পরই। তিনিও সৌরভ, সৌরভ গাঙ্গুলি!
সবচেয়ে বড় বিস্ময়টা অবশ্য ব্যাটিংয়ের ধরনে। আর সবাইকে তো বটেই, আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে মমিনুল সম্ভবত চমকে দিয়েছেন নিজেকেও।
মমুিনুল এখন বাংলাদেশের দ্বিতীয় দ্রুততম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান! কাল বিকেলে ৩৬ বলে ছূঁয়েছেন ফিফটি, আজ সকালে ট্রেন্ট বোল্টের বলে দারুণ এক স্কয়ার ড্রাইভে সেঞ্চুরি ছুঁয়েছেন ৯৮ বলে। তাঁর চেয়ে কম বলে টেস্ট সেঞ্চুরি আছে আর কেবল তামিম ইকবালের, ২০১০ সালে লর্ডসে ৯৪ বলে। সেঞ্চুরি ছুঁতে মেরেছেন ১৮টি চার! মমিনুলের এই চেহারা অনেকের জন্যই অচেনা।
তবে বিস্ময়টা স্রেফ ওই ব্যাটিংয়ের ধরনেই। নইলে এমন বড় ইনিংস তাঁর কাছ থেকে প্রত্যাশিতই।
তাঁর প্রজন্মের সবচেয়ে প্রতিভাবান ব্যাটসম্যানদের একজন, বছর দুয়েক ধরেই বলা হচ্ছে বাংলাদেশের মিডল অর্ডারের ভবিষ্যত্ স্তম্ভ। কক্সবাজারের প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার তিনি, তবে ক্রিকেটের গাঁথুনিটা শক্ত হয়েছে বিকেএসপিতে। ২০১০ টি-টোয়োন্টি বিশ্বকাপে প্রতিনিধিত্ব করেছেন বাংলাদেশকে। বয়সভিত্তিক দল, একাডেমি দল হয়ে প্রথাগত পথ পেরিয়ে গত নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অভিষেক ওয়ানডে দিয়ে। টেস্ট অভিষেক গত মার্চে, শ্রীলঙ্কায।
মুশফিক-আশরাফুলের ব্যাটিং কীর্তির গল টেস্টে একমাত্র ইনিংসে মমিনুল করেছিলেন ৫৫। কলম্বোয় পরের টেস্টে ৬৪ ও ৩৭। এরপর হারারেতে ২৩ ও ২৯। দ্রুতই যে পরিণত হচ্ছেন, সেটারই প্রমাণ যেন চতুর্থ টেস্টে এসেই প্রথম সেঞ্চুরি।
সেঞ্চুরির পর অবশ্য উড়ন্ত রথকে পথে নামিয়েছেন।
বন্ধুর পথে চলছে এবার বুঝে শুনে পথচলা। পেরিয়ে গেছেন দেড়শ। দলকে ভালো একটা জায়গায় পৌছে দিতে হলে এখনও পাড়ি দিতে হবে অনেকটা পথ। তবে এই ইনিংসের পথচলা যেখানেই থামুক, একটা ব্যাপার নিশ্চিত—মমিনুলের ব্যাটে আরও অনেক বছর সওয়ার হবে বাংলাদেশ!
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।