সুশীল রাজনীতি গণতন্ত্রের দুষমন
নির্বাচন মানে গণতন্ত্র এমন একটা ধারণা বাংলাদেশের সুশীলগণ জোরেশোরে প্রচার করে থাকে। তারা ধরে নেয় বাংলাদেশে গণতন্ত্র অলরেডি কায়েম আছে, এখন কাজ শুধু নির্বাচন করা। অথচ নির্বাচনকে যদি গণতান্ত্রিক চর্চা হতে হয় তাহলে তার আগে তো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠিত থাকা দরকার। কিন্তু সুশীলদের কোলাহল নিরন্তর এই ধারণাই কায়েম করে যে রাষ্ট্রকে আগে থেকেই গণতান্ত্রিক চরিত্র নিয়ে গঠিত থাকার দরকার নাই; গণতান্ত্রিক বিধিবিধান বা আইনকানুন -- এমনকি নিদেনপক্ষে একটা লিবারেল কনষ্টিটিউশন --ইতাদি কোন কিছুরই দরকার নাই – নির্বাচন হলেই সেটা ‘গণতন্ত্র’। বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর রাষ্ট্রের যে করুণ দুর্দশা ঘটেছে তারপরও সুশীলদের কোন হুঁশ নাই।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে 'নির্বাচনই গণতন্ত্র' সুশীল রাজনীতির এই মতাদর্শিক প্রপাগাণ্ডার বিরুদ্ধে লড়াই করা আজ কঠিন হয়ে উঠেছে। সুশীলদের মধ্যে কেউ কেউ নির্বাচন মানেই যে গণতন্ত্র নয় তা মুখে বলেন, কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির যে-সমালোচনা তারা হাজির করেন ও দ্বন্দ্বসংঘাত সমাধানের যে-প্রেসক্রিপশান দেন, তাতে পরিষ্কার কার্যত এই চিন্তার বাইরে তারা ভাবতে সক্ষম নন। কিম্বা সক্ষমতার কোন প্রমাণ তারা এখনও দিতে পারেন নি।
সুশীলদের প্রেসক্রিপশান অনুযায়ী সুশাসন, জবাবদিহিতা বা দুর্নীতিমুক্ত হওয়া ইত্যাদি সব রোগের মহৌষধ নাকি নির্বাচন। আর তাতেই বুঝি জনগণের মোক্ষলাভ।
এই ধারণা নতুন না। রাজনৈতিক পরিভাষায় একে লিবারেলিজম বলা হয়। গ্রামদেশের ভাষায় আকামের ঢেঁকি; আর কে না জানে আমড়া কাঠ দিয়ে ঢেঁকি হয় না। ঠিক তেমনি সুশীলতা দিয়ে গণতন্ত্র হয় না। তবে এতে সুশীলদের সাফল্য হলো, রাজনীতি কেন সুশীল ও শান্তিপূর্ণ হয়ে যায় না মানুষের এমন আকাঙ্খা নিয়ে তারা ভালই কচলাকচলি করতে পারে।
জনগণের এসব আকাঙ্খা ন্যায্য। গণতন্ত্রের আকাঙ্খা করে জনগণ ভুল করে না। কিন্তু গণতান্ত্রিক আকাঙ্খা পূরণ করতে গেলে মুরোদ দরকার। মুরোদ মানে ক্ষমতা বা শক্তি। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের ভাল রাজনীতির আকাঙ্খা পূরণ হতে গেলে শুধু আকাঙ্খা করাটাই যথেষ্ট নয়।
গণমানুষকে ক্ষমতাবান বা শক্তিমান হওয়া লাগে; একেই অনেকে গণশক্তিও বলেন। গণশক্তির দিক মানে জনগণের মুরোদের দিক, রাজনৈতিক শক্তির দিক। রাজনীতি বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান কখনই রাজনীতিতে শক্তির ভূমিকাকে অস্বীকার করে না। গণ-আকাঙ্খার অবিচ্ছিন্ন অনুসঙ্গ অতএব গণশক্তি। গণশক্তির এই দিকটা ভুলিয়ে রেখে রাজনীতির নামে সুশীলপনা মূলত গণতন্ত্রের বিরোধিতা, এটাই লিবারেলিজম।
কিন্তু লিবারেলিজমের মজা হচ্ছে, উদার রাজনীতিক গণতন্ত্রের কথা বলে গণতন্ত্রের বিরোধিতা করা। এ কারণে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক লড়াই মানে একই সাথে লিবারেলিজমের বিরুদ্ধে লড়াই, সুশীল রাজনীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম।
খেয়াল করলেই আমরা দেখব বাংলাদেশের সুশীল রাজনীতির প্রবক্তারা জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্খা বাস্তবায়নের কোন মুরোদ রাখে না, অথচ সারাক্ষণ ‘গণতন্ত্র’ নিয়ে মুখে ফেনা ছাড়ে, কচলাকচলি করে। তেতো করে ফেলে সবকিছু। তারপর মহাপণ্ডিতের মতো এই সিদ্ধান্তে আসে যে সব দোষ রাজনৈতিক দলের, তাদের কারণেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র নাই, অতএব রাজনৈতিক দল গুলোর বিরুদ্ধে তারা ‘তৃতীয় শক্তি’র সঙ্গে হাত মেলায়।
সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা দখলে সহায়তা করে। নিজ্বেরাও যোগ দেয়। বাংলাদেশকে বিরাজনীতিকরণের দিকে নিয়ে যায়। সুশীলরা জনগণকে গণশক্তি বিকাশের কর্তব্য থেকে দুরে সরিয়ে রাখতে পারে। ভুলিয়ে রাখতে পারে।
এটাই তাদের সাফল্য। আর এখানেই জনগণের হার হয়। এমন আকামের ঢেঁকিদের প্রতিপত্তি আমাদের সমাজে প্রবল ভাবেই আছে। সে কারণে সুশীল মতাদর্শ, বিরাজনীতিকরণ ও বারবার দেশকে পিছিয়ে দেবার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে জনগণ সচেতন না হলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র কায়েম অসম্ভব।
ভারতের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা স্বার্থই কি বাংলাদেশের স্বার্থ!
গত সাত-দশ দিনের ঘটনা।
রাষ্ট্রদুত মজিনা ইন্ডিয়া সফরে গিয়েছিলেন ২৩ অক্টোবর। এরপর থেকেই আমাদের সমাজে এক নতুন ফেনোমেনা হাজির হয়েছে। সুশীল রাজনীতির গুমো্র বের হয়ে গেছে তাতে। অবস্থা এমন হয়েছে যে, গণতন্ত্র, নিজের রাষ্ট্র এসব কথা দূরে থাক, বাংলাদেশের মানুষ এখন সুশীলদের কথা মতো নির্বাচনে ভোট দিয়েও তাদের পছন্দের দলকে ক্ষমতায় আনতে পারবে না। আওয়ামি লীগ অথবা বিএনপি --পছন্দের এমন কোন সরকার আর তারা কায়েম করতে পারবে না।
সম্ভব না। এমনকি জনগণ হাসিনার সরকার কায়েম করতে চায় মনে করলেও তারা তা আর করতে পারবে না।
কেন? আমার কথা শুনতে আজিব লাগতে পারে কিন্তু ঘটনা আসলেই তাই, পরিস্থিতি এমন তলানিতে এসে ঠেকেছে। ঘটনা কি? ঘটনা হলো, সামনে কেমন সরকার বাংলাদেশে থাকতে পারবে এর একটা ফর্দ বা চাহিদাপত্র তৈরি করেছে ইন্ডিয়া। বাংলাদেশে একটা সরকার কিনবার টেন্ডার ফ্লোট করা আরকি।
আর মজিনার সফরের সময় সেটা তারা মজিনাকে জানিয়ে দিয়েছে। বলেছে একমাত্র তাদের চাহিদা মোতাবেকই বাংলাদেশে সরকার হতে পারবে। অন্য কোন ভাবে না। পাঁচদিন আগে গত ৩১ অক্টোবর প্রথম আলো একটা রিপোর্ট করেছে, প্রথম আলো তার হেডলাইন করেছেঃ “দুই দেশের উষ্ণ সম্পর্কে পরিবর্তন চায় না ভারত”। কাকে উষ্ণ সম্পর্কে বলে মনে করছে ইন্ডিয়া?
মার্কিন রাষ্ট্রদুত মজিনার ভারত সফরে ভারত “তিনটি বিষয় স্পষ্ট করেছে”।
এই বিষয়গুলো বোঝার মধ্য দিয়ে “উষ্ণ সম্পর্কের” হদিস জানা যাবে – যে উষ্ণতা এখন বলবৎ আছে বলে ভারত মনে করে। আর তাই তারা দাবী করেছে, আগামি পাঁচ বছর হাসিনা সরকার ক্ষমতায় থাকুক। বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতা কাঠামোয় কোন পরিবর্তন চায়না ইণ্ডিয়া। এখান থেকেই প্রথম আলোর হেড লাইন “দুই দেশের উষ্ণ সম্পর্কে পরিবর্তন চায় না ভারত” – তৈরি হয়েছে। তো ভারতের চাহিদাপত্রের তিনটা বিষয় কি কি?
“প্রথমত, বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায় ভারত।
এ নির্বাচন হতে হবে সংবিধান অনুযায়ী। এ ক্ষেত্রে ভারতের পছন্দ-অপছন্দের কোনো ব্যাপার নেই। একটি গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণই কাম্য।
দ্বিতীয়ত, ভারত সব সময়ই যেকোনো রাষ্ট্রের নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে কাজ করে। কোন দেশের জনগণ কাদের নির্বাচিত করবে, সেটা পুরোপুরি সে দেশের জনগণের ওপর নির্ভর করে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের যে উন্নতি গত কয়েক বছরে হয়েছে, ভারত চায় তা অব্যাহত থাকুক। ভারত মনে করে, এই উপমহাদেশের সার্বিক উন্নতি ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশের হৃদ্যতামূলক সম্পর্ক অব্যাহত থাকা জরুরি। “
প্রথম দুটো পড়লে মনে হতে পারে বাহ, ভারতের বাংলাদেশ নীতি কত স্বচ্ছ ও দায়িত্ববান। ভারত আন্তর্জাতিক নর্মস, আইনকানুন বা কনভেনশন মেনে চলে।
কোন উপদ্রব চায় না। কিন্তু উলটা ধারণা আমরা পাব তৃতীয়টা পড়লে। বলা যায় তৃতীয়টার আলোকেই প্রথম দুটো পড়তে হবে। তৃতীয়টায় বলা হয়েছে যে “দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের যে উন্নতি” হয়েছে, “উপমহাদেশের সার্বিক উন্নতি” বহাল ও ধারাবাহিক রাখতে চায় তারা। সে কারণেই বলা হচ্ছে, “হৃদ্যতামূলক সম্পর্ক অব্যাহত থাকা জরুরি”।
এগুলো ডিপলোমেটিক ভাষা। মনের কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলা।
মনের এই ভাব বুঝে নেওয়া কঠিন নয়। ফলে ভাবে কথা বুঝে নিতে হবে। লক্ষ্য করার ব্যাপার হলো, আসলে বাংলাদেশে কি ধরণের সরকার থাকতে পারবে তার ক্রাইটিরিয়া বা নির্ণায়ক হাজির করছে ভারত এই তৃতীয়তে; যেটা ভারতের মূল চাহিদাপত্র বা টেন্ডার বলা যায়।
বলা বাহুল্য এই ক্রাইটিরিয়া হাসিনার চলতি সরকারের রেকর্ড লক্ষ্য করেই তৈরি। বলা বাহুল্য আর কোন দল এটা পূরণ করতে পারবে না। এমন কি হাসিনার নতুন সরকারও যদি মনে করে ফাইন টিউন ধরণের কিছু এবার অদলবদল করবে সেটাও সম্ভব নয়।
আবার, “দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের যে উন্নতি” কথার মানে কি? মানে হলো, ভারত যেভাবে নিজ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা স্বার্থ দেখে আমাদেরকেও সেভাবেই তা দেখতে হবে। এমনকি তা দিয়ে ভারতের নিজ নিরাপত্তা (বাংলাদেশের না) হাসিল হবে ভেবে কোন ভুল বা বেকুবিও যদি ভারত করে ও আমাদের দিয়ে তা আদায় করে নেয়, আমাদেরকে তবু সেই চাহিদাপত্রই অনুসরণ করতে হবে।
আমাদের প্রাণ গেলেও তা করতে হবে। বর্ডারে বাংলাদেশী মারা যদি ভারতের নিরাপত্তাবোধ হয়, সম্পর্কের উন্নতি বোধ হয় সেটাই আমাদের পালন করতে হবে। মমতার রাজ্যের পানির চাহিদা মিটিয়ে এরপরে যদি অবশিষ্ট কিছু থাকে তবেই তা বাংলাদেশ পাবে। আন্তর্জাতিক নদী আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের হক পানি ভাগের নিক্তি হতে পারবে না। পানিভাগের ভিত্তি যেন বাংলাদেশের আইনানুগ পাওনা বিষয়ও নয়।
বরং ভারত দয়া করে আমাদের অনুগ্রহ করল এটাই আমাদের ভাবতে হবে। এর উপর আবার এটাকে গিভ এন্ড টেক মনে করে বিনিময়ে ট্রানজিট বা অন্য আরও কিছু দিতে হবে। তাতে যদি কিছু পানি পাওয়া যায়। এটাকে যদি ভারতের সম্পর্কের উন্নতি বোধ হয় তবে আমাদেরও তাকে আমাদের উন্নতি বোধ করতে হবে।
সাধারণভাবে বললে, ভারতের নিরাপত্তা নীতি আত্মঘাতী ও ঘোর ইসলাম বিদ্বেষী এবং সে কারণে ততটাই অকার্যকর।
প্রতিবছর যার দুএকটা আউটবাস্ট বা ব্যর্থতার ঘটনা আমরা দেখি। তবু এই নিরাপত্তা নীতিটা ভারতের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি; নিজের ভাল ভারত নিজে যেভাবে দেখে সেই দিক থেকে - সেটার সুফল ও বিপদ তা ভারতের নিজেরই সমস্যা। তা তার থাকতেই পারে। কিন্তু কেন আমাদেরকেও সেই নীতির দাস হতে হবে, অনুগত গোলাম হতে হবে? কেন ভারতের নিজস্ব নীতির অকার্যকরিতার সমস্যাকে বাংলাদেশের দায় মনে করতে হবে? প্রত্যেক রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নীতি বা প্রতিরক্ষা চিন্তার সমস্যা তো আসলে প্রত্যেকের নিজের। ফলে প্রত্যেক রাষ্ট্রের নিরাপত্তা মোকাবোলার উপায় ও পথ ভিন্ন হওয়া তো স্বাভাবিক।
ভারতের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার স্বার্থ ও তাদের আঞ্চলিক নীতির দাস হওয়া কি বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব? অপরের পরাধীনতা মেনে নেয়, এমন নিঃস্বার্থ রাষ্ট্র বলে কি কিছু হওয়া সম্ভব? রাষ্ট্র মানেই নিজ জনগোঠিগত স্বার্থ, অন্যের নয়। ভারতের বার্মা নীতি কি আজ ভারতের জন্যই নিরাপত্তা হুমকি হয়ে উঠে আসছে না? অথচ এগুলোকেই ভারত “দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতি” গণ্য করছে, “উপমহাদেশের সার্বিক উন্নতি” বলে চালাতে চাচ্ছে। আর এটাই ভারতের কাছে “হৃদ্যতামূলক সম্পর্ক”। অতএব তা “অব্যাহত থাকা জরুরি” বলে ভেবে চাহিদাপত্র হাঁকাচ্ছে।
আচ্ছা, এক রাষ্ট্রের সাথে পড়শি রাষ্ট্রের “হৃদ্যতামূলক সম্পর্ক” বলে কিছু কি থাকতে পারে? এতো সোনার পাথরবাটি।
আমরা চাইলেই কি তা পারব? মৌলিক সত্য হলো রাষ্ট্র মানেই শত্রু-মিত্রের ভেদ বিচার থেকে গড়ে ওঠা একটি সত্তা। প্রতিটি রাষ্ট্রের কাছে অন্য সকল রাষ্ট্রই তার সম্ভাব্য শত্রু। অর্থাৎ অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কিম্বা কূটনৈতিক সৌহার্দমূলক সম্পর্কের পরও এটা সত্য, যেকোন পরিস্থিতিতে দুটো তথাকথিত ‘মিত্র রাষ্ট্র’ পরস্পরের দুষমনে পরিণত হতে পারে। একথা সত্যি না হলে তো কারও নিজেকে আলাদা রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করার দরকার থাকে না। তবে অবশ্যই পরস্পর কথা বলে পরস্পরের কমন স্বার্থগুলো চিহ্নিত করে কিছু কিছু সময়, কিছু দূর কিছু ইস্যুতে আমরা একসাথে সাময়িক হাঁটি, এতটুকুই ।
ফলে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবারিত ও অব্যাহত ভাবে “হৃদ্যতার” আবদার একটা এবসার্ড, অসম্ভব বা অবাস্তব কল্পনা মাত্র।
তাহলে পড়শিকে অঙ্গরাজ্য বানিয়ে নেয়াটাও কি সমাধান? অবশ্যই না। তাহলে তো সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গিয়ে তা আবার ১৯১৭ সালের আগের কেবল ক্ষুদ্র রাশিয়া হবার কথা না। আবার পোল্যান্ড, পুর্ব জার্মানি ইত্যাদিকে স্যাটেলাইট রাষ্ট্র বানিয়ে সুখ অনুভবের পরিণতি কিন্তু উল্টা; খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙ্গে ক্ষুদ্র রাশিয়ায় গিয়ে ঠেকা। এমন অজস্র উদাহরণ আমাদের হাতের কাছেই।
তার সারকথা হলো, যত অবাস্তবই হোক, কেবল ভারতের চাহিদাপত্র অনুসারেই বাংলাদেশে কোন সরকার কায়েম হতে পারবে এই দাবী মেনে নেওয়া যায় না। বাংলাদেশের জনগণ শেখ হাসিনার আমলে ভারতের সঙ্গে যে একতরফা দিল্লীকে শুধু সুবিধা দেবার নীতি গ্রহণ করেছিলো, তাকে সমর্থন করে না। ভারতকে বাংলাদেশ ‘মিত্র’ ভাবে, সেভাবেই সবসময় ভেবে এসেছে। কিন্তু ভারত বাংলাদেশকে মিত্র ভাবে না। এই উপলব্ধি বাংলাদেশে তীব্র।
অতএব বাংলাদেশ সবসময় দিল্লীর চাহিদা মেটাবে এরপরেও নিজে স্বাধীন রাষ্ট্র থাকবে তা কখনই হতে পারে না।
কিন্তু ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে বর্তমান সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোন প্রকার বদল মেনে নেবে না। কূটনৈতিক ভাষায় ডেন মজিনাকে এই খবরটিই তারা জানিয়ে দিল। তাহলে নির্বাচন করেই বা কী ফায়দা। থাক না শেখ হাসিনা ক্ষমতায়, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের “মধূর” সম্পর্ক অব্যাহত থাকুক।
মজার দিক হোল, “নির্বাচন মানে গণতন্ত্র “ বাংলাদেশে এই লিবারেল ধারণাও এতে নাকচ হয়ে গেছে। ভারত যদি অন্য কোন সরকার না মেনে নেয়, কিম্বা শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে দেশপ্রেমিক আওয়ামী লীগারদের কোন সরকার জনগণ নির্বাচিত করে, ভারত সেই ক্ষেত্রেও বাগড়া দেবে। বাংলাদেশকে স্বাধীন ও স্বাভাবিক ভাবে নিজের ভাগ্য নিজে নির্ণয়ের সকল সূযোগ ও সম্ভাবনা দিল্লী নষ্ট করে রাখতে চাইছে। আমরা যাকেই ভোট দেই না কেন সে সরকারে আসতে পারবে না। এমনকি হাসিনাকেও ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে আনলেও সেটা ভারতের চাহিদাপত্রের বাইরে কোন সরকার হতে পারবে না।
এরই সারকথা হলো, কোন ভোটের সরকার এই লিবারেল রাষ্ট্র ও রাজনীতি কায়েমের আর কোন সুযোগ বাংলাদেশে আর থাকছে না।
আবার আর এক দিক থেকে দেখি। রাষ্ট্রের কথা বাদই দিলাম, সরকারের পাবলিক রেটিং, পারফরমেন্স রেটিং বা পাবলিক পারসেপশন বা সরকারের গণপ্রিয়তা বলে তো একটা ব্যাপার আছে। বাংলাদেশের জনগণ যদি প্রশাসন পরিচালনা অথবা দুর্নীতি এমন ইস্যুতে হাসিনা সরকারের আভ্যন্তরীণ নীতির কারণে বিরূপ হয় তবে সেক্ষেত্রেও ভারতের এই তিন চাহিদাপত্র দাবী করছে বাংলাদেশের জনগণ হাসিনার উপর বিরূপ হতে পারবে না, এটা নিষেধ। আবার হাসিনা যদি মনে করেন জনগণের মন পাবার জন্য কিছু নীতি বদলাবেন যা ভারতের চাহিদাপত্রের বিরোধী হয়ে যায় তবে সেটা করারও হাসিনার কোন সুযোগ নাই।
‘দুই নেত্রীর সংলাপ” তাহলে কী?
তাহলে এই অবস্থায় “দুই নেত্রীর সংলাপ” বলে আকাঙ্খা তাতিয়ে কথা বলে সুশীল চিৎকারের অর্থ কি? প্রথম আলোর মিজানুর রহমান খান টক শোতে বলছেন, হাসিনা একাধারে প্রধানমন্ত্রী ও দলের প্রধান; প্রধানমন্ত্রীর লিখিত পরামর্শ অনুযায়ী চলতে বাধ্য আমাদের রাষ্ট্রপতি, সুপ্রীম জুডিশয়াল কাউন্সিল বিষয়ে নির্ধারক হলেন প্রধানমন্ত্রী; ক্যবিনেট একটা থাকলেও নির্বাহি প্রধানের সমস্ত কর্তৃত্ব একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর। এভাবে সবকিছুই এক ব্যক্তির হাতে থাকা -- এটাই নাকি আমাদের গণতন্ত্রের সমস্যা। এটা কি নতুন কথা নাকি? পঞ্চদশ সংশোধনীতে প্রধান মন্ত্রীর হাতে ক্ষমতা আরও কুক্ষিগত হবার আগেও বাংলাদেশের সংবিধান সবসময়ই নির্বাচন হলেও সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্রই কায়েম করত। এই সকল আইনী কথার আসলেই কী এখন আর কোন রাজনৈতিক অর্থ আছে? যে-সমস্যার সমাধান একমাত্র রাজনৈতিক ভাবেই সম্ভব প্রথম আলো সবসময়ই তাকে আইনী সমস্যা হিসাবে হাজির করে। রাজনৈতিক সমাধানের মধ্যে লড়াই পালটা লড়াই, এমনকি বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে ফয়সালার দিকও অন্তর্ভুক্ত।
প্রথম আলোর সুশীল আইনী সমাধান সে কারণে লিবারেলিজমের সর্বোচ্চ ক্যারিকেচার হয়ে ওঠে।
বাস্তবতা এখন আরও জটিল হয়ে পড়েছে। ভারতের বর্তমান অবস্থান বিচার করলে রাজনৈতিক ভাবে গণতন্ত্রের সংকট নিরসনের সঙ্গে ভারতের প্রতি আমাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণের প্রশ্ন অঙ্গাঙ্গী জড়িত হয়ে পড়েছে। হাসিনার পরিবর্তে এক ব্যক্তির হাতে সব ক্ষমতা না রেখে পাঁচ জন আলাদা ব্যক্তিকে রেখে দিলে কি ভারতের চাহিদাপত্রের বাইরে একটা সরকার গঠন সম্ভব? মিজানুর রহমানসহ সকল সুশীলেরা এ ব্যাপারে নিরব থাকেন। তারা সংলাপ সংলাপ করে আমাদের মাথা ঝালাপালা করে ফেলছেন কেন? কেন আমরা মেনে নিচ্ছি না যে লিবারেল রাজনীতির কোন সম্ভাবনা বাংলাদেশে আর নাই।
বাংলাদেশের রাজনীতি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতার সঙ্গে যেভাবে জড়িত হয়ে গিয়েছে সেই খাদ থেকে বের হয়ে এসে স্বাধীন ভাবে নিজের সমস্যা সমাধানের সুযোগও আর নাই।
এখন হরতাল চলছে। দিনরাত আরমর্ড কারের সাইরেন শুনে আমাদের কান ঝালাপালা। এই কারে পুলিশসহ সব বাহিনীকে সজ্জিত করা হয়েছে গত ২০০১ সালের পর থেকেই – ওয়ার অন টেররের "সশস্ত্র ইসলামি সন্ত্রাসী" মোকাবোলা করার জন্য। এই কল্পিত শত্রু কল্পনায় থেকে গেছে, তবু বাহিনী ও তার সজ্জা আছে।
এই বাহিনী সাজানোর পরিকল্পনায় যে কল্পিত শত্রু সে সশস্ত্র ঘোরাফেরা করবে এই আগাম অনুমানের উপর দাঁড়ানো। কিন্তু সেই শত্রু কই? তাহলে কোথায় এটা এখন ব্যবহার হচ্ছে? ব্যবহার করা হচ্ছে নিরস্ত্র গণ আন্দোলনের উপর।
‘ নিরস্ত্র’ কথাটা ভেবে চিন্তেই লিখেছি। বাংলাদেশের আন্দোলনে ৪২ বছরের ও তার আগের ইতিহাস নিরস্ত্র গণ আন্দোলনের। সর্বশেষ এরশাদবিরোধী সহ যত আন্দোলন হয়েছে তাতে আমাদের প্রগতিশীল ভাইবোনেরা পটকা, ঢিল, লাঠি হাতে সজ্জিত হয়ে যে-আন্দোলন করেছে তাকে বাংলাদেশে নিরস্ত্র গণ আন্দোলন বলেই গণ্য করা হয়।
এই বিচারে গত পাচ বছরের আন্দোলন অবশ্যই নিরস্ত্র গণ আন্দোলন। লেনিন অবশ্য এই নিরস্ত্রতাকেও প্রতীকী সশস্ত্রতা বলে ব্যাখ্যা করতেন। কারন রাষ্ট্র সব সময়ই বল্প্রয়োগের হাতিয়ার। এর বিরুদ্ধে জনগণ যখন বিক্ষুব্ধ হয় তখন কোন না কোন প্রতীকী কায়দায় সশস্ত্র প্রতিরোধের জানান দিয়ে যায়।
জনগণের এই নিরস্ত্র প্রতিবাদ বিক্ষোভকে মোকাবিলা করা হচ্ছে পুলিশ র্যা্বকে দিয়ে “সশস্ত্র জঙ্গী” মারার সাঁজোয়া যান দিয়ে, কিম্বা সশস্ত্র যানবাহনের সজ্জা দিয়ে।
মিছিলকারী দেখা মাত্রই পুলিশ দোতলা লোহার ঘরে বসে গুলি করে। এই প্রয়োজনের মাত্রারিক্ত বলপ্রয়োগ -- আইনের ভাষায় যাকে “একসেসিভ ফোর্স” বলা হয় -- তাই করা হচ্ছে। এই বলপ্রয়োগও আবার হচ্ছে কোন আইনি ম্যাজিষ্টেটের তত্ত্বাবধান বা নজরদারি ছাড়াই। অর্থাৎ রাষ্ট্র ও সরকার নিজেই জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে গিয়েছে। এর অর্থ হল, গণ আন্দোলন মোকাবিলার পথ আর লিবারেল পথ ধরে অগ্রসর হতে পারবে না।
তার সুযোগ আর আছে প্রমাণ করা খুবই কঠিন। সেই পথ হচ্ছে আইন শৃংখলা বাহিনী কোথাও গুলি ছুঁড়লে বা মানুষ হত্যা করলে আদৌ নাগরিকদের জানমাল রক্ষার জন্য তা প্রয়োজনীয় ছিল কিনা সে তদন্ত করতে বাধ্য হোত। সরকার বা রাষ্ট্র এই লিবারেল বাধ্যবাধকতা মানে না। মানুষ মরছে, আহত হচ্ছে, কিন্তু রাষ্ট্র একতরফা দোষ দিচ্ছে বিক্ষোভকারীদের।
আমরা বিক্ষোভ বা হরতালকারীরা নির্দোষ সেই দাবী করছি না।
উদার রাজনীতির পরিমণ্ডলে সরকার ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে সংযম ও আইনী বাধ্যবাধকতা মেনে চলার কথা ছিল তা যে মানা হচ্ছে না, সেই সত্যটুকুই তুলে ধরছি। লিবার রাজনীতি বাংলাদেশে খুন হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। সুশীলদের কোলাহল সে কারণে নিরর্থক চিৎকার ছাড়া আর কোন অর্থ বহন করে না।
সারমর্ম হচ্ছে, শান্তিপূর্ণ নাগরিক প্রতিবাদের যে লিবারেল রাজনীতি সেটা ক্ষমতাসীনরা নষ্ট হয়ে দিয়েছে। যারা এখন ক্ষমতায় নাই তারা নির্দোষ নয়।
অবশ্যই। কিন্তু শান্তিপূর্ণ ভাবে সভাসমাবেশ করার অধিকার, বাক, ব্যক্তি মত প্রকাশের অধিকার ক্ষমতাসীনরাই হরণ করেছে। অবৈধ ভাবে বিরোধী দলীয় পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন স্টেশন বন্ধ করে দেওয়া, এমনকি নিজের দলের অফিসে বসে সভা করার অধিকারের ওপরও হস্তক্ষেপ করছে সরকার। এই বাস্তবতার পরেও যারা এখনও আইনী কথাবার্তা বলেন তাদের কথার পচন এখন পরিস্কার ধরা পড়ে যায়। সরকার ও রাষ্ট্র জানান দিচ্ছে, আহবান করছে যেন তাদের সাজানো গাড়ি যেমন সশস্ত্র প্রতিপক্ষের মোকাবিলার কথা ভেবে সাজানো – আন্দোলনকারিরাও যেন লিবারেল রাজনীতি ছেড়ে ওর উপযুক্ত হয়ে “সশস্ত্র জঙ্গী” হয়েই আসে; নিরস্ত্র গণ আন্দোলন আর বাংলাদেশে সম্ভব না।
সরকার ভারতের চাহিদাপত্র মেটাতে নিরস্ত্র আন্দোলন বিক্ষোভ আর চলতে দিতেও পারে না। ক্ষমতাসীনরা গণসমর্থন হারিয়েছে। এখন দিল্লির কথা মতো ক্ষমতায় থাকতে চাইলে সশস্ত্র ভাবে প্রতিপক্ষকে দমন করা ছাড়া আর কোন পথ নাই। রাষ্ট্রের এই সহিংস ও সন্ত্রাসী অবস্থান রাজনীতির চরিত্রে গুণগত পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এর পরিণতি শেষে কী দাঁড়াবে আমরা জানি না।
এতটুকু জানি লিবারেল রাজনীতির শেষ অনেক আগেই ঘটে গিয়েছে। ডেন মজিনার ভারত সফরে বোঝা গেল রাজনীতি এখন আর জাতীয় পর্যায়েও নাই। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলে গিয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ যদি স্বাধীন ও সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ দূরের কথা স্বাধীন ভাবে তাদের সরকার নির্বাচিত করতে চান, দিল্লি তা কখনই হতে দেবে না। জনগণকে অতএব হয় দিল্লির চাহিদাপত্রের রাজনীতি হিসাবে নিয়ে চলতে হবে।
নয়ত বিদ্রোহ করতে হবে। এর কোন বিকল্প আছে কেউ দেখিয়ে দিলে আনন্দিত হবো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।