আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নন্দিত নগরে (আমস্টার্ডাম)


এক ধাক্কায় আকাশ থেকে পাতালে চলে আসলাম। কিছুক্ষণ আগেও আমাস্টার্ডাম শহরের উপর দিয়ে বিমানে বসে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম, আর কিছুক্ষণ পরেই Schiphol এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশান লাইনে। এই এয়ারপোর্ট অদ্ভুত। এর অবস্থান সমুদ্র সমতল থেকে চার মিটার নীচে। তাই, সরাসরি “পাতাল” বলে দিলাম।

ইমিগ্রেশান অফিসার আরো অদ্ভুত। তার অবস্থান ফ্লোর থেকে মিটার খানেক উপরে। মনে হয় সমুদ্র সমতলে থাকতেই পছন্দ করে, এর নীচে আসতে চায় না। তার থেকেও বড় কথা, আমার সবুজ রঙের বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেখে, জনাব আমাকে সমুদ্র মানব ঠাওরেছে। বলে, “আর ইউ এ সী-ম্যান?” ওরে খোদা রে, আমি সী-ম্যান না, তবে সী-ম্যান হতে না পারটা জীবনের অপূর্ণ থেকে যাওয়া ইচ্ছাগুলোর মধ্যে একটি।

তার বিশেষজ্ঞ সুলভ মতামত নাকচ করে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ভাইজানের এইডা মনে হবার কি কারণ? আমার চোখের মধ্যে কি সামুদ্রিক লবণ সোডিয়াম ক্লোরাইড দেখা যায়? তিনি জবাব দিলেন, “আজ সকাল থেকে তোমার দেশের বেশ কিছু সী-ম্যান এসেছে, আরো আসছে। ভাবলাম তোমারও হয়তো সে কারণে আসা। ” তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পাসপোর্ট দেখে ধন্যবাদ জানালো। আমিও ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম।

বিমানবন্দর থেকে শহরগামী ট্রেইনে চেপে বসলাম।

সাথে নেয়া শহরের ম্যাপে চোখ বুলাতে বুলাতে কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। খুব সকাল হবার কারণে, তখনো পুরোপুরি ব্যস্ত হয়ে উঠেনি দশ দিক। পৃথিবীর কত শহরে কত ভাবেই না মানুষ অভিবাদন জানালো। গায়ের রঙয়ের কারণে হোক অথবা গ্রাম থেকে প্রথম শহরে আসা নতুন বালকের মতন করে অবাক চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে শহরের রূপ দেখার কারণেই হোক, অধিবাসীদের বুঝতে বাকী থাকতো না, শহরে নতুন এসেছি আমি। আগন্তুক।

কেউ মাথার হ্যাট খুলে, কেউ মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে, কেউ-বা আবার হাতখানি উপরে তুলে কত ভঙ্গিতেই না অভিবাদন জানাতো। কিন্তু, এক্জন আগন্তুক হিসেবে আমস্টার্ডাম শহরে যে অভিবাদন পেয়েছি, সে কোনো দিন ভুলবার নয়। রাস্তার পার হতে যাওয়া স্কুলগামী একদল নিষ্পাপ শিশু, মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে সেই সাত সকালে যেভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলো, তার শুধু একটা অর্থই হওয়া সম্ভব- “ আমাদের শহরে স্বাগতম তোমায়, হে অচেনা অতিথি। ”


ছোটবেলায় “নিউ” দিয়ে শুরু হওয়া কোনো জায়গার ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহ ছিলো। “নিউ মেক্সিকো” হলে বুঝতাম মেক্সিকো এর সাথে সম্পর্ক আছে, সে-রকমভাবে নিউ ইয়র্ক, নিউ ফাউন্ডল্যান্ড, এমনকি নিউ মার্কেটও।

কিন্তু, কোনোভাবে বুঝতে পারতাম না, নিউ জিল্যান্ড এর “জিল্যান্ড” শব্দটা কোথ্বেকে এসেছে। অনেক পরে জেনেছি আমস্টার্ডাম যে দেশের রাজধানী সেই নেদারল্যান্ডস (ডাচ) এর একটা প্রদেশ “জিল্যান্ড”। আর সেখান থেকেই নামকরণ হয়েছে নিউ জিল্যান্ডের। নেদারল্যান্ডস এর আরেক নাম হল্যান্ড থেকেই এক সময় অস্ট্রেলিয়ার নামকরণ করা হয়েছিলো “নিউ হল্যান্ড”। আর ডাচ্ অভিযাত্রী তাসমানের নামে হওয়া তাসমানিয়ার নামতো বিদ্যমান আছে এখনো।


নেদারল্যান্ডস্ অর্থ নীচুভূমি। একটা দেশের অর্ধেকই যদি সমুদ্র সমতলের নীচে অবস্থিত হয়, তো সেই শহরের নাম নীচুভূমি না হয়ে আর কি-ই বা হবে। কিন্তু, নীচু এই দেশটির মানুষরাই নাকি আবার পৃথিবীতে সবচেয়ে উঁচু। গড় উচ্চতা পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি। এমন একটা বিচিত্র দেশের রাজধানী আমস্টার্ডামও কিছুটা বিচিত্র হবে সেটাই স্বাভাবিক।


শহরে পা রাখতে না রাখতেই সবার আগে চোখে পড়লো “বাই সাইকেল”। পুরো শহরজুড়ে বাইকারদের আধিপত্য। শহরের লোক সংখ্যা সাত লক্ষ, আর বাই সাইকেলের সংখ্যা না-কি দশ লক্ষ। শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, মানুষের থেকে সাইকেল বেশি।




গোটা শহরকে রিং এর মত করে ঘিরে আছে বেশ কিছু ক্যানাল।

সবগুলোই কৃত্রিম ভাবে তৈরী করা। একটা রিং শেষ হয়, তো খানিক দূর থেকে শুরু হয় আরেকটা রিং। ক্যানালগুলো যেন পুরো শহরের শরীরে আংটি হয়ে বসে আছে। আর হয়তো তাই, আমস্টার্ডাম শহরে শুধু ব্রিজই আছে প্রায় তেরশো এর কাছাকাছি। একদিকে, ক্যানাল ধরে চলছে নৌ-যানগুলো; অন্যদিকে, কিছুক্ষণ পর পর ঘন্টা বাজিয়ে পাশ ঘেঁষে চলে যাচ্ছে বিভিন্ন রুটের ট্রাম।

“জলে নৌকা, ডাঙ্গায় ট্রাম; শহরের নাম আমস্টার্ডাম। ”





শহরের আইকন “I amsterdam” এর সামনে যখন গেলাম, তখনো দিনের সূর্য উঠেনি; প্রচন্ড ঠান্ডা। লোকজন খুব বেশি নেই। কিন্তু, আমার ছবি তুলবে কে! খানিক অপেক্ষার পর কফির মগে চুমুক দিতে দিতে এগিয়ে আসলো সর্বোচ্চ গড় উচ্চতার শহরের, বোধ করি সবচেয়ে সুদীর্ঘ স্বর্ণকেশী। ছবি তোলার জন্য অনুরোধ করতেই জিজ্ঞেস করলো, কোন দেশ থেকে এসেছি, কোথায় যাচ্ছি।

জবা দিতেই বললো, এত ঠান্ডার মধ্যে তুমি একটা টি-শার্ট পরে আছ! সে বেচারী আর কি করে বুঝবে, এমন রোমাঞ্চকর একটা শহরের বৈচিত্রের চাদরেই উষ্ণ হয়ে উঠে আগুন্তুকের মন। মাইলের পরে মাইল হেঁটে আমি আমস্টার্ডাম শহর দেখছি। এ-শহর যে ট্রামে-ট্রেইনে চড়ে দেখার শহর নয়। যে শহরের প্রতিটা কোণে কোণে সৌন্দর্য, প্রতিটা কদমে কদমে পায়ে মেখে যায় লাবণ্য, চোখে লেগে যায় রূপ; মটরগাড়ীতে চড়ে সে শহর দেখা মানেতো নিজের সাথেই নিজেই প্রতারণা করা।








শহরের মিউজিয়ামের সংখ্যা নিয়ে কিছু না বললেই নয়।

একটা শহরে কি করে যে ৫১টা নামকরা মিউজিয়াম থাকা সম্ভব, এই শহর সেটা দেখিয়েছে গোটা বিশ্বকে। মিউজিয়ামগুলোর ধরণও বেশ বৈচিত্রময়। গাঁজার মিউজিয়াম পর্যন্ত আছে। সেখানে গিয়ে মিউজিয়ামে উৎপাদিত বিশেষ ধরণের গাঁজা খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে।






ঘন্টার পর ঘণ্টা শহর দেখছি, তবু , “ক্লান্তি” উঁকি মারার কোনো সুযোগই হচ্ছে না।

ইচ্ছে হচ্ছিলো শহরের প্রতিটা গলিতে গলিতে হেঁটে দেখি। কোথাও কোনো ভবনের গায়ে নির্মাণ সাল দেয়া থাকলে মিলানোর চেষ্টা করছি, ইতিহাসের পাতায় ঠিক কোন ঘ্টনার সময়ের ভবন সেটি। একেকটা শহরতো মানব সভ্যতার একেকটা দলিল। আর, সেই শহরের ভবনগুলিইতো ইতিহাসের রাজসাক্ষী।




আমস্টার্ডাম শহরের দৃষ্টিনন্দন, ইতিহাসধারণকারী অসংখ্য সেই ভবনগুলোর একটি আবার হয়ে উঠেছে ইতিহাসের ক্ষতচিহ্ন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানদের হাত থেকে বাঁচার জন্য সেই ভবনেই পরিবারসহ দুই বছর লুকিয়ে ছিলো অ্যানা ফ্রাঙ্ক। “দ্যা ডায়রি অফ অ্যা ইয়াং গার্ল” নামের যার লেখা ডায়রি (অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়রি) অনুদিত হয়েছে বিশ্বের ষাটটিরও বেশি ভাষায়।




অনেকক্ষণ ধরে শহরের কথা বলছি, এখনো রেড লাইট ডিস্ট্রিক্টের কথাই বলা হলো না। নেদারল্যান্ডস-এ পতিতাবৃত্তি বৈধ এবং অন্য আর সব পেশার মত এই পেশায় নিয়োজিতরাও সরকারকে আয়কর দিয়ে থাকেন। বলতে গেলে আমস্টার্ডাম শহরের মাঝেই রেড লাইট ডিস্ট্রিক্ট, যেখানে এক কাচ-দেয়াল দূরত্বে চলে লেনা-দেনা।

ক্যামেরার বাটনে ক্লিক করলেই ধরা যাবে, জোর করে হাসা হাসির সাথে সাথে হাত বাড়িয়ে করা আহবান। না, ক্লিক নয়, বন্ধই করলাম ক্যামেরা। লেন্স হয়তো বন্ধ করা যায়, কিন্তু, সকাল বেলার সূর্যও সেখানে বন্ধ করতে পারে না পুরুষশাসিত বিশ্বের নিদারুণ প্রহসন।


ফুলেদের কথা বলে শেষ করি। বলা হয়ে থাকে যে, যে কোনো ডাচ্ পরিবারের বসার ঘরে গেলে যে জিনিসটি সবার আগে চোখে পড়ে, সেটি হলে ফুলদানীতে সাজানো সতেজ ফুল দিয়ে।

এরা ফুল ভালোবাসে। আর হয়তো তাই, বিশ্বের একমাত্র ভাসমান ফুলের বাজারটি আছে আমস্টার্ডাম শহরেই। ভাসমান বলতে, ক্যানালের এক পাশে পানির উপর বানানো ছোট ছোট দোকান।


পতঙ্গকে আকৃষ্ট করার জন্য, শত সহস্র বছরের প্রচেষ্টায় উদ্ভিদ তৈরি করেছে ফুল। সে ফুলের রঙ-রূপ, মধু-সৌরভে মাতাল হয়ে ছুটে ছুটে আসে পতঙ্গ।

আমস্টার্ডাম শহরের ফুলের দোকানগুলোয় গিয়ে মনে হয়েছিলো, এই আমি বুঝি সবেমাত্র জন্ম নেয়া এক পতঙ্গ, না হলে আমস্টার্ডাম শহরের ফুলের দোকানে সাজানো ফুলেদের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে এমন মাতাল মনে হবে কেন!
মইনুল রাজু ফেইসবুক
অন্যান্য শহর নিয়ে লেখা পর্বগুলোঃ নিউ ইয়র্ক, প্যারিস, শিকাগো, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডেট্রয়েট, লাক্সেমবার্গ সিটি, কলাম্বাস, পোর্টল্যান্ড, ওয়াশিংটন ডিসি, রিচ্মন্ড, স্যান ডিয়েগো।

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.