এখানে যারা বাস করে তারা সবাই
খুব ব্যস্ত। কোন না কোন কাজে ব্যস্ত।
কেউ কাজ করতে ব্যস্ত। কেউ কাজ
খুঁজতে ব্যস্ত। এরা থাকে প্রকৃতির
মাঝে তার আদর আর
নিষ্ঠুরতাকে সঙ্গী করে।
সৃষ্টিকর্তার
অনুগ্রহ এদের মাঝে কমই বর্ষিত হয়।
একেবারে কদাচিৎ। তবে একেবারেই
যে মুখ ফিরিয়ে থাকেন তা কিন্তু নয়।
তাদের মাথার ওপরে একটা ছাদ আছে,
শোয়ার জন্য ভূমি থেকে ৩ ফুট উঁচু
একটা মেঝে আছে। এত বড় পৃথিবীর
মাঝে তাদের থাকার জায়গা ওইটুকুই।
দূর থেকে ভাগ্যকে শ্রেষ্ঠ প্রবঞ্চক
মনে হলেও কাছে আসলে বোঝা যায়
এরা বাস করে প্রবঞ্চনার চরম সীমায়।
ওপরের ছাদ আর নিচের
পাকা মেঝেটা তাদের নয়, অন্যের।
স্রষ্টা ভদ্র সমাজের দামী প্রার্থনায়
হরহামেশা ধরা দিলেও এখানে আসেন
পূর্ণিমার চাঁদ হয়ে।
এদের প্রতিদিনের কাজ
হলো মালামাল
টানা মানে কুলিগিরি। কেউ কেউ
ভাঙা জিনিসপত্র আর বোতল টোকায়।
এরা টোকাই। শব্দটা ভদ্রসমাজের বড়
মানুষদের খুবই পছন্দের। ভুল ভাববেন না।
এরা টোকাই বলে পরিচিতি এ
কারনে টোকাই শব্দটা ভদ্রের পছন্দের
নয়। টোকাই গালি হিসেবে বেশ ভাল
ও যুতসই।
ভদ্রশ্রেণীর জন্য ভদ্র ভাষার
একটা গালি।
যা বলছিলাম, এদের কেউ
ভিক্ষা করে জীবন চালায়। যে যত
ভালো করে আল্লাহর নাম
নিতে পারে, যার গলা যত ভালো,
যে সবচেয়ে ভালো সুরে গান
বেঁধে তার অবস্থার কথা জমজমাট
করে বলতে পারে তার ভিক্ষা পাবার
সম্ভাবনা ততই বেড়ে যায়। জীবনযুদ্ধের
কলা-কৌশল যার যত
ভালো জানা আছে তার
টিকে যাবার সম্ভাবনা তত বেশি।
অভাগাদের কপাল কেমন তা শেষ পর্যন্ত
দেখা হয়ে ওঠে না কারোরই।
এটা এখানকার এক অলিখিত নিয়ম।
এরা রেলওয়ে স্টেশনের বাসিন্দা।
মিজানুর…………………………
উচ্চকণ্ঠে ডাকল কাশেম। সে এখানকার
কুলি ডিপাটমেন্টের হেড। মর্যাদাবান
একটা পদে সে আসীন।
আয়রোজগার অন্য
কুলিদের চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি।
লোকটা একটু গম্ভীর কিন্তু মনটা বেশ
নরম। এখানকার কুলিরা তার
কথা মেনে চলে। তার অবাধ্য কেউ
হলে সে তাদেরকে শাস্তি দেয়।
কাশেম এখানকার
সবচেয়ে পুরনো এবং বয়োজেষ্ঠ্য।
প্রায়ই তাকে অন্যদের ঝগড়ার বিচার
করে দিতে হয়। বয়সে, বুদ্ধিতে,
জ্ঞানে সে একটু প্রবীন।
লোকটা দেখতে মোটা কিন্তু
মাথামোটা নয়। জমিদারি গোঁফ
আছে তার। বংশের ধারা বজায়
রাখার জন্যই সে গোঁফ রাখে।
মুখে খোচা খোচা দাঁড়ি আর বসন্তের
দাগ নিয়ে এক বিরাট চেহারা।
কয়েকটা হাঁকডাকের পর মিজানুর
সামনে এসে দাঁড়ায়।
- কামডা করছিলি?
ভারী গলায় কাশেম জিজ্ঞাসা করল।
- করছি।
- কেউ টের পায় নাই তো?
- না, পায় নাই।
- যা, কামে যা।
মিজানুর মাত্র তিন মাস
হলো এখানে এসেছে।
উঠেছে স্টেশনের পাশের বস্তিতে।
বাপ মরেছে জন্মের আগে। পেটের
ক্ষুধায় মিজানুর আর তার
মা হালিমা বেগম তিন মাস
আগে গ্রাম ছেড়ে এখানে এসেছে।
হালিমা বেগম মানুষের বাসায়
কাজের চেষ্টা করছে। একটা অবশ্য
পেয়েছে তবে আরও দুইটা খোঁজ করছে।
অসুখ আছে বলে কেউ
কাজে রাখতে চায় না। তারপরও
সে কাজ খুঁজে চলেছে।
মিজানুর দশ বছরের শীর্ণদেহী বালক।
তার চোখ দুটি উজ্জ্বল নীল রঙের।
গায়ের বর্ণ কালো কি শ্যামলা বুঝবার
জো নেই। সারাদিন
রোদে ঘুরলে মানুষ কালো হয়ে যায়
কারণ সূর্যালোকে ত্বকের
মেলানিনের পরিমান বেড়ে যায়।
তাই আর বর্ণনায় গেলাম না, পাঠক
বুঝে নেবেন। তবে মুখটা বেশ
মায়া মায়া, মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ।
ছোট
হলেও মিজানুর বেশ বুদ্ধিধর। উপস্থিত
বুদ্ধিতে সে বড়দেরকেও হার
মানাতে পারে।
মিজানুরকে কাশেমের খুব পছন্দ কারণ
তার বুদ্ধি চমত্কার। তবে আর
একটা কারণেও মিজানুর কাশেমের
পছন্দের পাত্র
সেটা হলো সে কাশেমের
গোপনে বিক্রি করা হিরোইন
ক্লায়েন্টদের কাছে পৌঁছে দেয়।
মিজানুর বাচ্চা ছেলে তাই পুলিশ
কিংবা অন্যদের সন্দেহের আওতামুক্ত।
তাই এ কাজের জন্য মিজানুরই উপযুক্ত
ব্যক্তি।
মিজানুর সারাদিন রেললাইনে কাগজ
টোকায়, ভাঙা বোতল,
খালি প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের
মোড়ক, জুসের মোটা কাগজের
প্যাকেটও সে টোকায়
এবং ভাঙ্গারির
দোকানে বিক্রি করে দিনে ২০
টাকা, ৫০ টাকা বা কোনদিন একটু
বেশি পায়। কখনও সে রেলে চড়ে এক
স্টেশন থেকে চলে যায় আরেক
স্টেশনে। সেদিন রোজগারটা একটু
বেশি হয়। রাশেদ, আমিনুল, রমজান ওরাও
স্টেশনেই থাকে।
মিজানুরের সাথেই
কাগজ টোকায়।
মিজানুর একবার ওদের হাতে মার
খেয়েছিল। কাশেম
দূরে দাঁড়িয়ে দেখেছিল সব তারপর
কাছে এসে মিজানুরকে বলে গিয়েছিল
বেঁচে থাকতে হলে মার খেয়ে নয় মার
দিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। কাশেমের
শিক্ষা মিজানুর বেশ ভালোভাবেই
রপ্ত করতে পেরেছে। এখন সে মার খায়
না বরং মার দেয়।
সে আস্তে আস্তে রেলওয়ে শিশুদের
মধ্যে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিতে পরিণত
হচ্ছে। কাশেম স্পষ্ট
দৃষ্টিতে তা অবলোকন করছে।
রোহান প্রতিদিন এ স্টেশন
দিয়ে যাতায়াত করে। সে প্রতিদিন
একটু আগে এসে বসে থাকে ট্রেনের
জন্য আর
কে কি করে তা বসে বসে দেখে।
রোহান অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্র।
সুদর্শন
দেখতে। তার কাজ হলো প্রতিদিন
অন্তত একজন নতুন মানুষের
সাথে পরিচিত হওয়া। এটা তার ওপর
অর্পিত কোন দায়িত্ব নয়। মনের
ভালো লাগা থেকেই
সে কাজটি করে।
- কি নাম তোমার?
- মিজানুর।
- থাকা কোথায়?
- পাশের বস্তিতে।
- বাবা মা আছে?
- বাপ নাই। মা আছে।
- মা কি করে?
- বাসায় কাম করে।
- পড়ালেখা কর?
মিজানুর এবার একটু বিরক্ত হচ্ছে।
ভাবছে, কোথাকার কে এত
কথা জিজ্ঞেস করছে।
সে বিরক্তিভরে জবাব দিল
- না করি না।
- বড় হয়ে কি হবে?
- ডাহাইত হমু।
এরকম উত্তর শুনে যে কারোই চোখ
ছানাবড়া হয়ে যাবার কথা।
রোহানের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটল না।
রোহান আর কিছু বলল না। মিজানুর
চলে গেল। রোহান ওর যাবার পথের
দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। ট্রেনের
শব্দ শোনা যাচ্ছে। ট্রেন আসছে।
"মিজানুর, এদিকে আয়। " কাশেমের
গলা শুনে মিজানুর পেছন
ফিরে তাকায়।
- একটা অর্ডার আছে। কাইল
বিকালে পৌঁছায় দিবি। পারবি না?
- পারুম।
টেকা একটু বেশি দিয়েন। মার
কাশটা বাইরা গেছে।
কাশেম কোন
আপত্তি না করে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
"আইজ এক বেডায় ডাক দিছিল
আমারে। " মিজানুর বলল।
কয়েকটা চিন্তার রেখা স্পষ্ট
কাশেমের কপালে। কাশেম কপাল
কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, "কেডা ডাক
দিছিল?"
- প্যাসেঞ্জার। কয় বড় হইয়া কি হমু।
- কি কইলি তুই?
- কইছি, ডাহাইত হমু।
বলেই শুরু করল মিজানুর।
হাসিমুখে কাশেম বলল,
"ভালা কইছস। ডাহাইত
না হইলে কি হবি, ডাহাইতরে সবাই
ডরায়। "
দূরে ট্রেনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ট্রেন
আসছে। স্টেশনের ব্যস্ততা বাড়ছে।
কুলিদের ছোটাছুটি বাড়ছে।
যাত্রীরা গায়ে গায়ে লেগে আছে।
সূর্য অস্ত যাবার প্রস্তুতি নিতে শুরু
করেছে।
দুটো পাখি নীড়ে উড়ে যাচ্ছে।
সন্ধ্যা নামছে মানুষের
ব্যস্ততা কমছে কিন্তু স্টেশন
আছে স্টেশনের মতোই।
প্ল্যাটফর্মের এক কোণে পিলারের
গা ঘেঁষে শুয়ে আছে ফকিরের মা।
সে বগিতে বগিতে ভিক্ষা করে।
ভিক্ষা করার সময় আল্লাহর নাম নেয়।
একটি চিৎকারে তার ঘুম ভেঙে যায়।
একটি কিশোর দৌড়াচ্ছে আর চিৎকার
করে বলে যাচ্ছে, - "একজন পড়ছে।
"
"একজন পড়ছে সামনের ইস্টিশনে। " চোখ
মেলে তাকায় ফকিরের মা। একটু দূরেই
বসে বসে পা খুঁটছিল মিজানুর। ভুরু
কুঁচকে মিজানুরকে জিজ্ঞেস করল,
"কেডা পড়ছে?"
মিজানুর শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকায়
ফকিরের মার দিকে তারপর বলে, -
"ছোড একটা পোলা এহেনে কাগজ
টোকায়, চিনো?" উত্তরের
অপেক্ষা না করেই মিজানুর বলে যায়,
"আমির নাম। ওর মায় কাটা পড়ছে একটু
আগে।
"
"ওওওও। " একটু আফসোস করে আবার
ঘুমিয়ে পড়ে ফকিরের মা।
ট্রেনে কাটা পড়া এখানে ভীতিকর
কিছুনা সামান্য আফসোসের।
এটা বিধি না ভাগ্যের পরিহাস
বোঝা মুশকিল। রেললাইনের
পাশে থাকবে, মাঝেমধ্যে কেউ
রেলে কাটা পড়ে মরবে এটা সহজে লিখে ফেলা যায়
তবে মৃত্যু এখানে কেন এত নির্মম
রূপে আসে তার উত্তর কখনোই
খুঁজে পাওয়া যায় না।
সভ্য সমাজের মানুষ যারা সভ্যতার
কারিগরদের
তৈরী সিঁড়িতে পা রেখে উপরের
আসনে এসে বসেন তাদের দেহাবয়বের
সাথে সভ্যতার কারিগরদের
দেহাবয়বের কতটুকু পার্থক্য
সেটা স্রষ্টা নির্ণয় করতে পারবেন
কারণ মানুষ তারই সৃষ্টি।
তবে শ্রেণী পার্থক্য
তৈরী করতে আমাদের
জুড়ি মেলা ভার ইহা নিশ্চিত
জানি কারণ, আমরা যে মনুষ্য প্রজাতি।
মাঝে মাঝে নিউজ চ্যানেলে দুই
একটা বেওয়ারিশ মৃতের খবর
পাওয়া গেলেও সৎকারের খবর
পাওয়া যায় না অথচ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির
মৃত্যুতে কালো পতাকা উড়তে দেখা যায়।
গোরস্থানের ভেতরও চলে লাইভ
টেলিকাস্ট।
ভাস্করকে দেখেছি দু হাতে দেশ
গড়তে আর এদের দেখেছি দু হাতে দেশ
গড়তে তাই বোধহয় এদের গুরুত্ব কম।
এটা বৈষম্য
না বিধি তা বোঝা আমার কর্ম নয়।
বিকেলে কাশেম
মিজানুরকে দেখা করতে বলেছে।
একটা বড় চালান এসেছে। মিজানুর
ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস
করতে পারেনা কাশেম।
কাশেমকে পাওয়া গেল
একটা পরিত্যক্ত বগিতে।
এখানে সাধারণত কেউ আসে না।
রাতের আঁধারে এখানেই
আসে হেরোইনের প্যাকেট। এই
জায়গার সন্ধান কেবলমাত্র মিজানুরই
জানে। এটা একটা পরিত্যক্ত
মালটানা গাড়ির বগি।
জানালা না থাকায়
ভেতরে কি হচ্ছে সেটা বাইরে থেকে বোঝা যায়
না।
মিজানুর এসে হালকা কাশি দিল।
এটাই এখানে আসার নিয়ম।
"ভেতরে আয়। " কাশেমের
গলাটা নামানো অনেকটা ফিসফিস
করেই কথা বলছে।
- এইডা মোহনপুর পৌঁছায় দিবি।
- আইচ্ছা। ট্যাকা একটু বেশি দিবেন।
- বেশি ট্যাকা নিয়া করস কী?
- মার লিগা ওষুধ কিনি ক
কাশেম আর কিছু বলে না।
মাতৃভক্তি তারও কম নয়।
মিজানুর চালান পৌঁছে দেয় মোহনপুর
একজন ভদ্রলোকের কাছে।
রাতে বাসায় ফিরে মায়ের
পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে মিজানুর। আজ
তার মাকে একটু বেশি রুগ্ন লাগছে।
ঘুমোচ্ছে দেখে মাকে ডাক
না দিয়ে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ে।
হালিমা বেগম ভোরে ঘুম
থেকে উঠে পড়ে কাজে যাবার জন্য।
বাঁশ আর ভাঙা কাঠ
দিয়ে বানানো টেবিলটার ওপর তার
জন্য কেনা ওষুধ
দেখে বুঝতে বাকি থাকে না কে এনেছে।
তবে কৃতজ্ঞতায় বা স্নেহে তার চোখ
দিয়ে পানি আসেনি কিংবা সে স্নেহ
বোঝার ক্ষমতা স্রষ্টা আমাদের
দেননি। হালিমা বেগম একবার ছেলের
দিয়ে তাকালেন তারপর ব্যস্ত হলেন
রান্না বসাতে। সারাদিনের
রান্না তিনি সকালবেলাই
সেরে ফেলেন। আজ
তিনি সাগরপোনার চচ্চড়ি আর ডাল
রান্না করবেন। ঘুম থেকে উঠে পিছন
দিয়ে এসে মিজানুর মায়ের
গলা জড়িয়ে ধরে।
দুটো হাসিমুখ আর
অপার স্নেহের এই দৃশ্যটি এই
দুটো প্রাণী ছাড়াও
অন্তরীক্ষে বসে আরও একজন প্রত্যক্ষ
করলেন।
সেদিন সকাল
থেকে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল।
স্টেশনের বাসিন্দাদের
চোখে মুখে একটা আতঙ্কের ছাপ।
ফকিরের মা একটা পিলারের
ধারে কুঁকড়ে শুয়ে আছে।
কুলিগুলো কাজ করছে তাদের মতোই
তবে সবার মধ্যে একটা স্থবিরতা।
রেলওয়ের কচিকাঁচাগুলো চুপচাপ
এককোণে পড়ে আছে।
সবখানে একটা নতুনের আবির্ভাব।
লম্বা প্লাটফর্মের শেষ মাথায়
একটা জটলা। তারা কি যেন
আলোচনা করছে। মিজানুর সব
দেখছে এক দৃষ্টিতে।
আচানক বৃষ্টির এক
ঝামটা এসে লাগে তার মুখে।
পিছনে আমীর দাঁড়িয়ে। মিজানুর
আমীরকে জিজ্ঞেস করল, "কি হইছে?"
"মেলা কিছু হইছে গত রাইতে। কই
আছিলি?"
আমীর বলল।
- কী হইছে জলদি ক।
- গত রাইতে কাশেম সাব
ট্রেনে কাটা পড়ছে।
কাশেমকে স্টেশনের সবাই কাশেম
সাব বলে ডাকত।
মিজানুর চমকে প্রশ্ন করল,
"কেমনে কাটা পড়ল?"
আমীর বলল, "জানিনা তয়
বেবাকতে আবুলরে সন্দেহ করতাছে।
কেউ কেউ কয় এইডা খুন কিন্তু কেউ মুখ
খুলেনা। "
মিজানুর জিজ্ঞেস করল, "আবুল
বায়েরে সন্দেহ করে কেন?"
আমীর বলল, "জানিনা তয় রাশেদ
পাগলায় কয় ও বলে কাশেম সাবের
পিছনে আবুল বায়ের
মতো কারে খাড়ায় থাকতে দেখছে।
সবাইর কাছে চুপে চুপে কইতাছে।
পাগলার কথা কেউ বিশ্বাস
করে না তয় না কইরাও পারেনা,
কাশেম সাবের পর আবুল বায়েরই
কুলি সর্দার হওনের কথা। "
মিজানুর অবাক বিস্ময়ে সব
শুনে যেতে থাকে। এক রাতের
ব্যবধানে এতকিছু ঘটে যেতে পারে এ
তার কল্পনারও অতীত।
আমীর বলে যেতে থাকে, "শোন খবর
আরও আছে।
কাশেম সাব
যে গোপনে হেরোইনের ব্যবসা করত
এইডাও পুলিশ জাইনা গেছে। "
অকস্মাৎ পাংশু হয়ে যায় মিজানুরের
মুখ। সে আর অপেক্ষা না করে এক
দৌঁড়ে বাসায় ফিরে এলো।
তিন দিন হয়ে গেছে কাশেম সর্দার
মরেছে। নতুন কুলি সর্দার আবুল সবার
থেকে চাঁদা তুলে তার কুলখানির
ব্যবস্থা করেছে আর লোকের
কাছে বলে বলে ফিরছে কাশেম সাব
খুব ভালো ছিল, তাকে অনেক স্নেহ
করত, গরীবের সঙ্গী ছিল, দানশীল ছিল
ইত্যাদি ইত্যাদি।
মিজানুর এখন অনেকটা এতিমের
মতো প্ল্যাটফর্মে ঘুরে বেড়ায়।
সারাদিন ভাঙা জিনিসপত্র
কুঁড়িয়ে সন্ধ্যায় বিক্রি করে বিশ
তিরিশ টাকার মতো পায় তাই
নিয়ে ঘরে ফেরে। অতিরিক্ত আয়ের
পথটা কবরে চলে গেছে কাশেমের
সঙ্গে।
সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে মিজানুর
মাকে বিছানায় কাতরাতে দেখল।
শ্বাসকষ্টটা আজ
অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে হালিমা বেগমের।
মিজানুরের অতিরিক্ত আয়
দিয়ে হালিমা বেগমের জন্য যে ওষুধ
কেনা হতো তা বন্ধ হয়েছে অনেক
আগেই।
মিজানুর মার পাশে গিয়ে বসল।
মাথায় হাত রেখে বলল, "মা, শ্বাস
কি বেশি উঠছে?"
ঠিকমতো জবাব এল না কেবল অস্ফুট
ধ্বনি শোনা গেল দুবার।
ছেলেকে আঁকড়ে ধরে ছিলেন, কিছু
বলতে চাচ্ছিলেন কিন্তু সামর্থ্য
কুলায়নি। মিজানুর শুধু ফ্যালফ্যাল
করে দেখছিল আর মায়ের জন্য স্রষ্টার
কাছে প্রার্থনা করছিল।
এই অবোধ
বালকের জন্য স্রষ্টা আর কিছু
বাকি রাখেননি, শুধু
প্রার্থনা ছাড়া আর কিছু করার সামর্থ্য
কিংবা জ্ঞান এই বালকের
কোত্থেকে হবে!
রাত বাড়ার
সঙ্গে সঙ্গে হালিমা অবস্থাও খারাপ
হচ্ছে। দু গন্ড
বেয়ে চুইয়ে পড়া পানি মিজানুরের
হাত ভিজিয়ে দিচ্ছে বারবার।
আস্তে আস্তে নিস্তেজ
হয়ে পড়া যন্ত্রনায় কাতর
দেহটি মাঝরাতে সম্পূর্ণ নিথর
হয়ে পড়ে। মিজানুর
মাকে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে ডাকে,
"মা"। সাড়া না পেয়ে আবার
ডেকে যায়, "মা, ওমা, মা, মা, ও
মা................."।
সমাপ্ত।
অনিক মাহফুজ
১৫/১০/১৩ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।