আমেরিকার একটা শহরও যদি নিজেকে প্রকৃতির রাঙা রাজকন্যা বলে দাবী করতে পারে, তবে সে-শহরের নাম হবে ‘সিয়াটল’। বাস্তবের রাজাধিরাজরা নিজ রাজত্বের চারদিকে সীমানা প্রাচীর গড়ে বহিরাগতদের জানিয়ে দেয়, “হে পথিক! ক্ষান্ত হও! এতটুকুই তোমার সীমানা!” আর, সিয়াটল শহরের চারপাশের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যপ্রাচীর আগন্তুক দেখে ঘোষণা করে, “হে পথিক! সৌন্দর্য রাজ্যে স্বাগতম তোমায়! বিচরণ কর যেথায় খুশি!”
কি নেই, এই শহর আর তার চারপাশে! সমুদ্র, পর্বত, ঝর্ণা; অরণ্য, হ্রদ, রহস্যভরা জনপদ। প্রকৃতির এত এত সব মহৎ আয়োজনের মাঝে গড়ে উঠা এই শহরও প্রকৃতির মতই নান্দনিক, প্রশান্তির মত সাবলীল। একদা, সাতটা পাহাড়কে কেন্দ্র করে যেমন করে গড়ে উঠেছিলো প্রাচীন নগরী রোম, ঠিক তেমন করে আজ গড়ে উঠেছে আধুনিক সাত পাহাড়ের শহর সিয়াটল। পাহাড়গুলোর মধ্যে ‘ক্যাপিটল হিল’ শহরের সবচেয়ে জমজমাট এবং প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর এলাকা।
অবশ্য, দুষ্টু লোকেরা বলে থাকেন, এত প্রাণপ্রাচুর্যের কারণ ভিন্নধারার, প্রথাবিরুদ্ধ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং বিশেষ করে সমকামি (গ্যে) সম্প্রদায়ের সরব উপস্থিতি। আর, কে না জানে, দুষ্টু লোকেরাই যুগ যুগ ধরে সঠিক কথাগুলো বলে এসেছে।
প্রথম যখন এই শহরে আসি, যেদিকে যাই শুধু ‘সাউন্ড’ শব্দটাই শুনতে পাই। বাস সার্ভিসে নাম সাউন্ড, গ্যাস-বিদ্যুৎ সার্ভিসের নাম সাউন্ড। নাটোরে যেমনটা পোলট্রি ফার্ম থেকে শুরু করে ব্রিকফিল্ড সব কিছুর নাম ‘বনলতা’, তেমনটা সিয়াটলে সব কিছুর নাম ‘সাউন্ড’ দিয়ে।
আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে 'পিউজিট সাউন্ড'। এমনকি স্থানীয় ফুটবল দলের নামই হলো 'সাউন্ডারস'। ভেবেই পাচ্ছিলাম না ঘটনাটা কি। কে আর জানতো এই ‘সাউন্ড’ শব্দটারই একটা অর্থ ‘সমুদ্রপথ’, দুই স্থলভূমির মাঝে সৃষ্ট হওয়া জলের রাস্তা।
ওদিকে, ‘পিউজিট’ শব্দটা নেয়া হয়েছে ক্যাপ্টেন জর্জ ভ্যাঙ্কুভারের সহঅভিযাত্রী নেভি অফিসার পিটার পিউজিটের নাম থেকে।
ব্রিটিশ অভিযাত্রী ভ্যাঙ্কুভার তার ১৭৯১ সালে শুরু করা সমুদ্র অভিযানের সময় আমেরিকার উত্তর পশ্চিম উপকূলের বেশ কিছু অংশ পরিভ্রমণ করেন। তাই, এই অঞ্চলের বেশ কিছু জায়গা এবং নামকরা প্রায় সব পর্বতচূড়ার নামই ভ্যাঙ্কুভার সাহেবের বন্ধু-বান্ধব কিংবা সহযাত্রীদের নামে নামকরণকৃত। ক্যাপ্টেন ভ্যাঙ্কুভারের নামেই নামকরণ করা হয় সিয়াটল শহরের অদূরে অবস্থিত, কানাডার দুর্দান্ত সৌন্দর্যের শহর ভ্যাঙ্কুভারের।
আমেরিকার ওয়াশিংটন স্টেইটের বেশ কয়েকটি শহর গড়ে উঠেছে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে বিক্ষিপ্ত হয়ে তৈরি হওয়া এই ‘পিউজিট সাউন্ড’-এর তীর ঘেঁষে। সিয়াটল সেই শহর গুলির মধ্যে একটি।
এক পিউজিট সাউন্ডই এই শহরগুলোর সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। পিউজিট সাউন্ডে নৌকা ভাসালে, চোখের সামনে ভেসে উঠে ঝকঝকে শহর সিয়াটল; দেখা যায়, আকাশের বুকে খোঁচা মারার অভিপ্রায়ে, অনবরত আকাশমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ‘স্পেইস নিডল্’। ঢাকার যেমন শাপলা চত্ত্বর, সিয়াটলের তেমন স্পেইস নিডল্, শহরের আইকন।
তবে, রৌদ্রজ্জ্বল দিনে, চারপাশের সবকিছুকে ম্লান করে দিয়ে, সদর্পে আপন মহিমার জানান দিয়ে, ‘চির উন্নত মম শির’ বলে, সিয়াটলের আকাশে ভেসে থাকে দৈত্যাকৃতির পর্বত ‘মাউন্ট রেইনিয়ার’। আকৃতিতে ‘ডেইমন’ হলে কি হবে, প্রকৃতিতে কিন্তু ‘এঞ্জেল’ সেই পর্বত।
অসংখ্য উদ্ভিদ আর প্রাণিবৈচিত্রের উৎসস্থল এই রূপবতী পর্বত মাউন্ট রেইনিয়ার বদলে দিয়েছে চারপাশের জনপদ আর সেই জনপদের অধিবাসী সহস্র মানুষের জীবনধারা।
সিয়াটল শহরের কথা বলতে গিয়ে ‘স্টারবাকস্’ কফির কথা না বলা, মিশরের গল্প করতে গিয়ে পিরামিডের কথা না বলার মতনই। আমেরিকার বিখ্যাত কফি চেইনশপ স্টারবাকস্, ১৯৭১ সালে এই সিয়াটল শহরেই সর্বপ্রথম তাদের কার্যক্রম শুরু করে। সারা বিশ্বে এদের যত এমপ্লয়ি আছে, গোটা গৃনল্যান্ডে তার অর্ধেক মানুষও নেই। সারা বিশ্বে এত বেশি সুপরিচিত যে, এক পর্যায়ে তারা কাপের গায়ে আর কোম্পানির নাম না লেখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
লোগো দেখেই মানুষ স্টারবাকস্ বুঝতে পারবে। তবে, শুরুর দিকে তারা যে লোগো ব্যবহার করেছিলো, বিভিন্ন সময়ে সেটাতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। আবারো, দুষ্টু লোকদের কথায় ফিরে যেতে হয়। তারা বলে, স্টারবাকস্ এর প্রথম দিককার লোগো ছিলো কিছুটা অশ্লীল, পরবর্তীতে জনপ্রিয় হবার পর কোম্পানি সেই লোগো নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে, যার কারণে লোগো পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় স্টারবাকস্। কিন্তু, যে স্টোর দিয়ে স্টারবাকস্ ব্যবসা শুরু করে, সেটি এখনো আছে সিয়াটল শহরে এবং গিয়ে দেখি, ঐতিহ্যগত কারণে এখনো সেখানে ব্যবহার করা হয় সেই প্রথমদিককার স্টারবাকস্ লোগো।
ঐতিহ্যবাহী ‘স্টারবাকস্’ স্টোরটা যেখানটাতে অবস্থিত, সেখানটার (ওয়াটার ফ্রন্ট) 'পাইক প্লেইস মার্কেট' আবার আমেরিকার অন্যতম প্রাচীন এক 'ফার্মারস্ মার্কেট'। ফার্মারস্ মার্কেটগুলো কিছুটা আমাদের দেশের হাটের মত, তবে, শহুরে হাট। ছোট ছোট ফার্মারস্ কিংবা গৃহস্থরা তাদের খামারজাত পণ্য এনে বিক্রি করে এই ফার্মারস্ মার্কেটে। ক্রেতারাও আসেন একেবারে তরতাজা ফলমূল, মাছ-তরি-তরকারি কিনবার জন্য। মার্কেটের বিশেষত্ব হলো, বিক্রেতারা সেখানে দৈনিক ভিত্তিতে স্টল ভাড়া নিতে পারেন, অন্যদিকে পুরো মার্কেটের মোটোই হচ্ছে ক্রেতাদের উদ্দেশ্যে- ‘মিট দ্যা প্রোডিউসার’ অর্থ্যাৎ পণ্য কিনুন এবং সাথে সাথে সে ব্যাক্তিটিকেও দেখুন, যার বাড়ীতে অথবা যার খামারে উৎপাদিত হয়েছে সে পণ্য।
এবার একজন কবি এবং দার্শনিকের কথা বলি। নাম 'ব্রুস লি'। হ্যাঁ, একটু অবাক হবার মতনই ব্যাপার। সারা পৃথিবীতে যিনি পরিচিত মার্শাল আর্ট এর জন্য, সেই ব্রুস লি দর্শনের ছাত্র ছিলেন ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনে। নিজ দর্শনের উপর ভিত্তি করে রচনা করেছেন কাব্য।
ওদিকে, তার অভিনেতা পরিচয়ের কথাতো বাদই রাখলাম। হংকংয়ীয় বংশোদ্ভুত এই বিশ্বখ্যাত মার্শাল আর্টিস্ট আমেরিকার স্যান ফ্র্যান্সিসকো শহরে জন্মগ্রহণের কিছুদিন পর, পরিবারের সাথে ফিরে যান হংকংয়ে। পরবর্তীতে ব্যাপক পরিমাণে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়ার কারণে, আঠারো বছর বয়সে, তার পিতা তাকে মাত্র ১০০ ডলার পকেটে দিয়ে পাঠিয়ে দেন আমেরিকায়। একসময় পড়াশোনার উদ্দেশ্য সিয়াটলে বসবাস করতে শুরু করা ব্রুস লিকে তার মৃত্যুর পর সমাহিত করা হয় সিয়াটল শহরেই। যে সমাধিস্থলে তাকে সমাহিত করা হয় সেখানে গিয়ে দেখি, সত্তর ভাগ মানুষের নেইম প্লেইটে লেখা নামই হলো ‘লি’।
সেখানে এমন কেউ উপস্থিতও নেই, যাকে জিজ্ঞেস করতে পারি সমাধিস্থলটি কোথায়। একটা কাপল অবশ্য কবরস্থানে বসে এমন সৃষ্টিছাড়া প্রেম করা শুরু করলো যে, বেরসিকের মত আর জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো না। অন্যদিকে, জায়গাটা এত বড় যে একটা একটা করে নেইম প্লেইট পড়ে খুঁজতে গেলে 'বিশ লক্ষ লোকের বাইশ বছর' লাগার মত অবস্থা হয়ে যাবে। অবশেষে, উদ্দেশ্যহীণভাবে ঘুরতে ঘুরতে একটা জায়গা খানিকটা আলাদা করে চোখে পড়লো। সৌভাগ্যক্রমে সেটিই ছিলো ব্রুস লি’র সমাধিস্থল।
সেখানে নিজ ছেলের পাশে শায়িত আছেন কিংবদন্তির এই শিল্পী।
সিয়াটল শহরকে নিয়ে মজা করে বলা হয়ে থাকে যে, এই শহরে প্রতি চারজন মানুষের একজন মাইক্রোসফট্, অ্যামাজন কিংবা বোয়িং কোম্পানিতে কাজ করে থাকে। এই জায়ান্ট কোম্পানিগুলোর প্রধান শাখা সিয়াটল শহরের আশেপাশেই অবস্থিত, যেখানে কর্মরত আছেন অজস্র মানুষ। বস্তুত, সত্যিকারের জায়ান্ট কোম্পানি আসলে কি, সেটা বুঝতে পারা যায় মাইক্রোসফট ক্যাম্পাসে গেলে। সারা বিশ্বজুড়ে কর্মরত এই কোম্পানির এক লক্ষ এমপ্লয়ির মাঝে, তেতাল্লিশ হাজারই কাজ করেন এই পিউজিট সাউন্ডের আশেপাশে অবস্থিত শতাধিক ভবন নিয়ে গড়ে উঠা ক্যাম্পাসগুলোতে।
দুই শিফটে তাদের সাতশো জন ড্রাইভার কর্মরত থাকেন শুধু এমপ্লয়িদেরকে ক্যাম্পাসের এক ভবন থেকে অন্য ভবনে নিয়ে যাওয়ার জন্য। অনেকে মজা করে বলে থাকেন, মাইক্রোসফট্ যদি আইটি বিজনেস ছেড়েও দেয়, তাহলেও, শুধু রিয়েল স্টেইট আর অ্যাপার্টমেন্ট বিজনেস করেই মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আয় করতে পারবে।
মাইক্রোসফট্-এ কাজ করা বাংলাদেশি ইঞ্জিনিয়ারের সংখ্যা শতাধিক। অ্যামাজন কিংবা বোয়িংয়েও কাজ করেন অনেকেই। তাছাড়া, সিয়াটল শহরের পাশেই থাকা ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনে আছেন বেশ কিছু বাংলাদেশী স্টুডেন্ট।
অন্যান্য, প্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত বাংলাদেশীর সংখ্যাও কম নয়। সব মিলিয়ে গড়ে উঠেছে ছোট্ট কিন্তু চমৎকার একটা বাংলাদেশি কমিউনিটি। হৃদয়ে দেশকে ধারণ করে বিভিন্ন সময় তারা আয়োজন করেন বিভিন্ন ধরণের অনুষ্ঠানের, একসাথে মেতে উঠেন প্রাণের স্পন্দনে।
আমেরিকা বেশ বৈচিত্রময় একটা দেশ। একেকটা জায়গা একেক রকম, জায়গাগুলোর সৌন্দর্যও বিভিন্ন মাত্রার।
কিন্তু, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকে ওয়াশিংটন স্টেইটের কোনো তুলনা হয় না। আর, সেই স্টেইটের সবচাইতে সুপরিচিত শহর সিয়াটল। তবে, সত্যি বলতে কি, একটা শহর প্রকৃতির মাঝে গড়ে উঠতে পারে; কিন্তু, সেটি কখনোই প্রকৃতির চেয়ে বেশি সুন্দর হয়ে উঠতে পারে না। তাই, সিয়াটল শহর সম্পূর্ণ হয়ে উঠে তার চারপাশে ঘিরে থাকা অপূর্ব, অনিন্দ্য, অসামান্য, অবর্ণনীয় সৌন্দর্যের প্রকৃতিকে নিয়ে। সবুজ বনানীর আধিপত্যের কারণে ‘এমারেল্ড সিটি’ তথা ‘পান্না শহর’ নামে খ্যাতি পাওয়া এই সিয়াটল শহর, যুগ যুগ ধরে তার বুকে ধরে রাখুক সবুজ-সতেজ প্রকৃতিকে, হয়ে থাকুক অরণ্যের অভয়ারণ্য।
মইনুল রাজু
ফেইসবুক
অন্যান্য শহর নিয়ে লেখা পর্বগুলোঃ
আমস্টার্ডাম, নিউ ইয়র্ক, প্যারিস, শিকাগো, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডেট্রয়েট, লাক্সেমবার্গ সিটি, কলাম্বাস, পোর্টল্যান্ড, ওয়াশিংটন ডিসি, রিচ্মন্ড, স্যান ডিয়েগো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।