‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক,
আমি তোমাদেরই লোক,
আর কিছু নয়—
এই হোক শেষ পরিচয়। ’
পঙক্তিগুলো রবীন্দ্রনাথের ‘পরিচয়’ কবিতার। এই কবিতার মতোই ছিলেন বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি লেখক হুমায়ূন আহমেদ। যত দিন বেঁচে ছিলেন, আর কিছু নয়, কেবল আমাদের কথাই বলেছেন।
খুব সাধারণ মধ্যবিত্ত জীবনের ছোট ছোট ভাবনা, দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা—সবই তিনি আমাদের সঙ্গে থেকে দেখেছেন।
আমরা যা ভাবি অথচ বলতে পারি না, তিনি আমাদের হয়ে সেটা বলেছেন। কেউ যখন আমাদের কথা, আমাদের প্রতিনিধি হয়ে, আমাদেরই বলেন, তখন তিনি হয়ে ওঠেন অসাধারণ। হুমায়ূন আহমেদ আমাদের মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি।
আমাদের বেড়ে ওঠা, রহস্যময় ভাবনা, একুশের বইমেলা, সবকিছুতে হুমায়ূন আহমেদ। তিনি আর কখনোই ফিরে আসবেন না।
কিন্তু মানুষের মননে থাকবে তাঁর চিরন্তন গভীরতর বসবাস। সাধারণ মধ্যবিত্তের জীবনকে তিনি যেভাবে দেখেছেন, সেভাবেই গল্প-উপন্যাসে তুলে এনেছেন। তাঁর দেখার ভঙ্গি ও উপস্থাপনের ঢঙের মধ্যে ছিল এক নান্দনিক সৌন্দর্য।
রসায়নের মতো জটিল একটি বিষয় পড়াতেন। সেই তিনিই সৃষ্টি করেছেন মিসির আলি ও হিমুর মতো ভিন্নধর্মী গতিময় চরিত্র।
হিমু তাঁর এক অমর সৃষ্টি। অনবদ্য চরিত্র। আবেগ-অনুভূতির বাইরের একটি চরিত্র। পৃথিবীর সব যুক্তির ঊর্ধ্বে থাকে সে। অনেকটা দায়িত্বহীন স্বাধীনচেতা।
নিজের যা ভালো লাগে, তা-ই করে। মিসির আলি চরিত্র আমাদের যুক্তির মধ্যে নিয়ে যায়। বাংলা সাহিত্যে মিসির আলির ও হিমুর আগমন এক নতুন সংযোজন। মিসির আলি জটিল সমস্যার মনস্তাত্ত্বিক সমাধান দেন। আমরা বিভিন্ন সমস্যায় তাঁর কাছে যাই।
তিনি আমাদের মিস্টার সমাধান। আমাদের দৈনন্দিন চলার পথের এক অদৃশ্য নির্ভরতার প্রতীক।
এ দুটি চরিত্র পাঠকদের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছে। উপন্যাসে এসেছে ভিন্নমাত্রা। এটি পাঠককে আন্দোলিত করেছে।
আর অগণিত পাঠককে বইমুখী করেছে। হুমায়ূন আহমেদ আমাদের আবেগ-অনুভূতি, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভালো লাগা-মন্দ লাগা বুঝতে পারতেন। তাই বাংলা একাডেমীর বইমেলা অনেকটা তাঁর বইনির্ভর হয়ে উঠেছিল। বিভিন্নভাবে এই কিংবদন্তি লেখক বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। নানা বিষয় নিয়ে বহুমাত্রিক লেখা তিনি লিখেছেন।
ছিলেন উপন্যাসের জাদুকর। নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার থেকে শুরু করে আগুনের পরশমনি, মধ্যাহ্ন, জোছনা ও জননীর গল্প, মাতাল হাওয়া এবং একেবারে শেষের দিকের দেয়াল কী আশ্চর্য সব সৃষ্টি তাঁর! কেবল উপন্যাসেই নয়, ছোটগল্পেরও তিনি অসাধারণ এক নির্মাতা। অনেক ছোটগল্প লিখেছেন। খুব সাধারণ বিষয় নিয়ে লিখেছেন অসাধারণ গল্প। তাঁর গল্প বাংলা সাহিত্যে নতুন মাত্রা এনেছে।
তাঁর ছোটগল্পে উঠে এসেছে মানবজীবনের বিচিত্র রহস্য। অতিপ্রাকৃত, ভৌতিক, রহস্য—বিভিন্ন ধরনের গল্প লিখেছেন। তিনি আবিষ্কার করেছেন গল্প বলার সম্পূর্ণ নিজস্ব এক ঢং। গল্পকে মুক্তি দিয়েছেন গতানুগতিক ধারা থেকে। গল্প বলার এই অভিনব কৌশলই তাঁকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
এ জন্য অল্প সময়ের মধ্যে পাঠকের অনেক প্রিয় হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ও শরত্চন্দ্র সমকালীন লেখক। কিন্তু পাঠক রবীন্দ্রনাথ থেকে শরত্চন্দ্রকে বেশি পড়েছেন। শরত্চন্দ্রের ক্ষেত্রে বলা হতো, নারীর চোখের জলের হিসাব রাখার দায় যেন তাঁর একার। হুমায়ূন আহমেদের বেলাও বলা যায়, তিনি যেন মধ্যবিত্ত সাধারণ পরিবারগুলোর সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার সহযাত্রী।
তাদের খুব কাছের মানুষ। আপনজন, যাঁকে প্রাণ খুলে সব কথা বলা য়ায়। ঘেটুপুত্র কমলা, শ্রাবণ মেঘের দিন ও আগুনের পারশমনি এই সিনেমাগুলো বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। এর সঙ্গে তিনি যুক্ত করেছেন বিভিন্ন দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত পোড় খাওয়া মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ কিছু গান। যেমন ‘পূবালী বাতাসে...’।
‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়...’। ‘সোয়া চান পাখি...’। ‘মরিলে কান্দিসনে আমার দায়...’ ইত্যাদি। প্রায় সব শ্রেণীর মানুষের কাছে এগুলো অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছে।
এখন অনেক চ্যানেলের ভিড়ে ভালো-মন্দ খুঁজে পাওয়া যায় না।
কিন্তু এক সময় হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটকে রাজত্ব করেছেন। তিনি নাটকে এনেছেন এক অভিনব বৈচিত্র্য। তাঁর নাটক দেখার জন্য দর্শকের একধরনের মানসিক প্রস্তুতি থাকত। সব কাজ ফেলে টেলিভিশনের সামনে ভিড় করতেন। নাটকের চরিত্রগুলো হতো অনেক বেশি সংবেদনশীল।
যেমন ‘বাকের ভাই’। তাঁর অসম্ভব একটি জনপ্রিয় নাটকের জনপ্রিয় চরিত্রের নাম। একটি খুনের অপরাধে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হবে। দর্শকেরা কোনোভাবেই এই মৃত্যুকে মেনে নিতে পারছেন না। তাঁর মৃত্যুর বিরুদ্ধে ঢাকায় অনেক জায়গায় মিছিল হয়েছিল।
কোনো নাটকের চরিত্রকে রক্ষার জন্য বিশ্বে কোথাও মিছিল হয়েছে কি না, জানা নেই। কিন্তু এই উপমহাদেশে হুমায়ূন আহমেদ নামক একজন নাট্যকারের নাটকের চরিত্রকে রক্ষার জন্য মিছিল হয়। বাকের ভাই নামের এ চরিত্রটি কিংবদন্তির মতো আজও মানুষের স্মৃতিতে রয়ে গেছে।
এইসব দিনরাত্রি নাটকের টুনির মৃত্যুকে দর্শক কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। টুনির জন্য দর্শকদের খুব কষ্ট হয়েছিল।
চোখের পানি ঝরেছিল। উপন্যাস-নাটকের চরিত্র অবিকল জীবন নয়। কিন্তু তাঁরা যেন জীবন যে রকম, সে রকম হয়ে ওঠে। হ্যাঁ, হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস-নাটকের চরিত্রগুলোর বাস্তবতা, বিশ্বস্ততা ও প্রাণ এতটাই জীবনবান্ধব যে কাল্পনিক চরিত্ররা হয়ে ওঠে বাস্তব জীবনের প্রতিনিধি। তাই তো বাকের ভাইয়ের মৃত্যুতে মানুষ মিছিল করে।
টুনির মৃত্যুতে চোখের পানি ঝরে। এইসব দিনরাত্রি, কোথাও কেউ নেই, বহুব্রীহি ও অয়োময়-এর মতো নাটক তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন। হাজারো বিনোদনের ভিড়েও মানুষ এসব নাটকের গল্প এখনো মনে রেখেছে এবং রাখবে।
হুমায়ূন আহমেদের গল্প-উপন্যাসের পরতে পরতে আনন্দ, রসিকতা। আবার একই সঙ্গে দার্শনিক তত্ত্ব ও দেশ-বিদেশের অনেক তথ্য—সবই পাওয়া যায়।
মানুষকে তিনি আনন্দ দিতে পারতেন। কিন্তু এ মানুষটির নিজের জীবনটা ছিল ধু-ধু মরুভূমির মতো। অন্তরে গভীর ক্ষত নিয়ে নিরন্তর কাজ করেছেন।
কবি, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক আনিসুল হক এক জায়গায় লিখেছেন, ফরিদুর রেজা সাগরের বাসায় হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা। হুমায়ূন আহমেদ একটার পর একটা সিগারেট টানছেন।
বললাম, আপনার না হার্টে অপারেশন? এত সিগারেট খান কেন? তিনি বললেন, ‘আমার জীবনে কত দুঃখ তুমি জানো? আমার জীবনের দাম কী? এই শহরে আমার মেয়েরা থাকে। আজ কতগুলো বছর আমি তাদের দেখি না। ’ তিনি-ই তো বড় মানুষ, যিনি নিজের জীবনের এত দুঃখ গোপন করে অন্যকে আনন্দ দেন।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।
অমর একুশের দিন ছাড়া এমন দৃশ্য আর কখনো দেখা যায় না। সহস্র মানুষ ফুল নিয়ে আসছেন শহীদ মিনারে। মধ্যাহ্ন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল মানুষের বাঁধভাঙা উপস্থিতি। কখন মাথার ওপর দিয়ে রোদ-বৃষ্টি চলে যাচ্ছে, কেউ খেয়াল করছে না। কে নেই সেই শোকার্ত জনস্রোতে! মন্ত্রী, সংস্কৃতিকর্মী, টিভি সিনেমার তারকা, থেকে শুরু করে...
স্কুলের ছাত্রছাত্রী, শিশু-কিশোর, নারী, শ্রমজীবী, বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মী, এমনকি বাউল, দোকানদার, গাড়ির চালক সবাই আছেন।
বিভিন্ন চ্যানেল শহীদ মিনার থেকে সরাসরি শ্রদ্ধা নিবেদনের পর্বটি প্রচার করছিল।
পথের বিভিন্ন স্থানে মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল প্রিয় লেখকের অন্তিমযাত্রা দেখার জন্য। বিশেষ করে নুহাশপল্লির প্রায় আট কিলোমিটার পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সী মানুষ রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। অগণিত মানুষের পদচিহ্নে ভারী হয়ে উঠেছিল নুহাশপল্লি। মান্না দের একটি বিখ্যাত গান আছে, ‘কে বলে তুমি নাই।
তুমি আছো মন বলে তাই...’। আমরাও বলতে চাই না তুমি নেই। তুমি আছো আমাদের চাঁদ-জোছনা আর বৃষ্টিতে। জীবনানন্দ দাশের একটি বিখ্যাত কবিতার শেষ দুটি লাইন এমন:
‘রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে অসিতেছে নীড়ে
দেখিবে ধবল বক: আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে—’
আমরাও আমাদের প্রিয় লেখককে খুঁজে নেব মেঘ, রোদ, বৃষ্টি, জোছনা, সমুদ্র, নীলাকাশ, শরত্, হেমন্ত ও দুরন্ত প্রকৃতির মাঝে।
।অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।