স্বপ্ন ছুঁয়ে
এই মুহুর্তে আমার প্রফেসর বাবা অত্যন্ত গম্ভীর ভঙ্গিতে সোফার উপর পা তুলে বসে আছেন। তার গায়ে অফ হোয়াইট কালারের পাঞ্জাবি। মাথার চুল আঁচড়ানো সুন্দর করে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি এক্ষুনি বাইরে কোথাও যাবেন। হয়ত কোন বিয়ের দাওয়াতে, যেখানে অনেক গন্য-মান্য ব্যক্তিদের সাথে বোরহানির গ্লাস হাতে দেশ ও জাতির ভবিষ্যত নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা করবেন।
একে অন্যের বক্তব্যকে তীর্যক ভাষায় বিদ্রুপ করবেন কিন্তু মুখে থাকবে শুকনো হাসি। না, বাবা কোন দিয়ের দাওয়াতে যাচ্ছেন না। বাবা সব সময়ই এভাবে ফিটফাট হয়ে থাকেন। বাবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আমার ছোট বোন তূর্ণা। সে অনেকক্ষণ ধরেই উশখুশ করছে আর বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে।
আর কিছুক্ষনের মধ্যেই একটা হিন্দি সিরিয়াল শুরু হয়ে যাবে। ' বাবা, যা বলার তাড়াতাড়ি বলো। টিভি দেখতে যাবো', তূর্ণা বলল। বাবা হতভম্ব হয়ে তাকালেন ওর দিকে। যেন তিনি তূর্ণার কথা বিশ্বাসই করতে পারছেন না।
'টিভি দেখতে যাবে? আর কয়েকদিন পরে যার এসএসসি পরীক্ষা সে এখন টিভি দেখবে? তূর্ণা তোমকে কিছু কথা বলা অতীব প্রয়োজন', আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন বাবা। এখন তিনি কথার মাঝে কয়েকটা সাধু ভাষা ব্যবহার করবেন। ' তুমি টেস্ট পরীক্ষায় তিন বিষয়ে ফেল করেছো। এর মধ্যে অঙ্কে অর্জন করেছো সাত। অতীব হতাশাজনক।
একজন প্রফেসরের মেয়ে হয়ে তোমার এহেন ফলাফল অনাকাঙ্খিত', বাবার কথার মাঝেই ড্রয়িং রুমে ঢুকে পড়লাম আমি। যদিও কাজটা বিপজ্জজনক কিন্তু উপায় নেই। বাবার এই লেকচার আধ ঘন্টার আগে থামবে না। 'কোথায় যাচ্ছো?', চশমার ফাঁক দিয়ে আমার দিকে তাকালেন বাবা। 'তেমন কোথাও না, একটু হাঁটাহাঁটি করে আসি বাইরে থেকে।
আজকে দারুণ জোছনা', অত্যন্ত বিনীত ভাবে বললাম আমি। 'জোছনা দেখতে যাবে এই রাতের বেলা?', বাবা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ' হ্যা বাবা। আজকে উথাল-পাথাল জোছনা। বিশাল পূর্নিমার চাঁদ।
প্রাচীন মায়ান জনগোষ্ঠীর মানুষেরা এরকম রাতে বনের মধ্যে চিৎ হয়ে শুয়ে জোছনা দেখতো। তাছাড়া এখন রাত না বাবা। সন্ধ্যা মাত্র। ' 'তুমি কি মায়ান জনগোষ্ঠীর মানুষ? ঢাকা শহরে তো বন নেই। রাস্তায় চিৎ হয়ে শুয়ে জোছনা দেখবে?', চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বললেন বাবা।
আমি উত্তরে কিছুই বললাম না। মিষ্টি একটা হাসি দিলাম। বাবা আমার মিষ্টি হাসিতে আরো শক্ত হয়ে গেলেন। তূর্ণা এর মধ্যে সরে পড়েছে।
গলি থেকে পা বাড়িয়েই মনে পড়লো মানিব্যাগ ফেলে এসেছি।
যদিও বাবাকে বলেছি হাঁটাহাঁটি করবো কিন্তু শান্তিনগর থেকে কলাবাগানে হেঁটে যাওয়ার কোন ইচ্ছেই নেই আমার। বাবার ফিটফাট হয়ে থাকা কিংবা আমাদের ড্রয়িং রুম দেখে অনেকেরই মনে হতে পারে, বাহ কি সুন্দর সুখী-স্বচ্ছল পরিবার। আসল কাহিনী অন্য। সংসারের অবস্থা ভয়াবহ। বাবা একটা বেসরকারি কলেজ থেকে রিটায়ার্ড করেছেন।
টাকা-পয়সা তেমন কিছুই নেই। আমরা দুই ভাইবোনই পড়াশোনা করছি। বাবা পড়েছেন অকূল পাথারে। কিন্তু তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই কিছুই। মা প্রায় সময়ই মামার বাসায় যাচ্ছেন টাকা আনার জন্য।
মামা অত্যন্ত গম্ভীর ভঙ্গিতে মায়ের হাতে টাকা তুলে দিয়ে বলেন, ' এই লোকটার সাথে বিয়ে দিয়ে তোর লাইফটা নষ্ট করে দিলো বাবা। '
কলাবাগান যাচ্ছি ছাত্রের বাসায়। মাস শেষ হয়ে গেছে সপ্তাহ খানেক আগে। এখনো টাকা দেয়নি। হাঁটতে অবশ্য খারাপ লাগছে না।
হরতালের মধ্যে থাকায় রাস্তাঘাট কেমন ফাঁকা ফাঁকা। মোড়ে মোড়ে বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ। কয়েকদিন আগে এক হরতালের সময় পুলিশ আর পাবলিকের মাঝে পড়ে গিয়েছিলাম। ব্যাপক দৌঁড়াদৌড়ি চলছে। আমি শান্ত ভঙ্গিতেই এক পাশ ধরে হাঁটছি।
হঠাৎ এক পুলিশ সদস্য অবাক হয়েই আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ' কি ভাই, দৌড়ান না কেন?' ' দৌড়াদৌড়ি দরকার আপনাদের। স্বাস্থ্য ভালো রাখা দরকার। আমার দরকার নাই। আমার বরং দৌড় দেখতে ভালো লাগে। ' ভেবেছিলাম আমার কথা শুনে পুলিশ ভাইয়ের কি না কি প্রতিক্রিয়া হয়! পুলিশ ভদ্রলোক হেসে ফেললেন আমার কথা শুনে।
আমিও মিষ্টি হাসি দিলাম। সেই পুলিশ সাহেবকেই দেখা যাচ্ছে কলাবাগানে গলির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন হতাশ ভঙ্গিতে। ' ভালো আছেন?', এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। পুলিশকে কেউ ভদ্রতার প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে না। জিজ্ঞেস করলেই পুলিশের সন্দেহ তীব্র হয়।
ভ্রু কঁচকে যায়, চোখ ছোট ছোট হয়ে যায়। এই ভদ্রলোক অবশ্য আমাকে চিনলেন। 'আরে আপনি! এখানে কি করেন? আজকে বের হয়েছেন কেন? শহরের অবস্থা খুব খারাপ', উদ্বিগ্ন হয়েই কথাগুলো বললেন ভদ্রলোক। 'জোছনা দেখবো ভাই। তাই বের হয়েছি।
' পুলিশ ভদ্রলোক ভ্রু কূচঁকে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে!
ছাত্রের বাসায় কেউ নেই। সবাই গাজীপুরে গিয়েছে পিকনিকে। অথচ আগামীকাল কিছু টাকা খুবই দরকার। খুব দরকার। আমি আস্তে করে পা বাড়ালাম রাস্তার দিকে।
কিছুক্ষনের মধ্যেই টের পেলাম ধানমন্ডিতে এক প্রাসাদোপম বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। এটা নীহারদের বাসা। আমাদের সাথেই পড়ে। অসম্ভব রুপবতী বলতে যা বোঝায় নীহার তাই। আমি সাধারনত এই ধরনের মেয়েদের কাছ থেকে দূরত্ব রক্ষা করে চলি।
কিন্তু নীহার মেয়েটা অন্যরকম। ওর সাথে আমার পরিচয়টাও অদ্ভুত। এক শীতের সকালে ডিপার্টমেন্টের বারান্দায় চুপচাপ বসে আছি আমি। এমন সময়ে নীল চাদর গায়ে দেয়া এক মেয়ে আমার পাশে এসে বসেই বলল, ' কি ব্যাপার। তুমি নাকি আমাদের ক্লাশের হিমু? এই কারনেই কি সব সময় ভাব ধরে থাকো নাকি?', তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা।
আমি রীতিমত অপ্রস্তুত। বন্ধুরা মাঝে মাঝে আমাকে খেপানোর জন্য হিমু বললেও আমি হিমুর মত কেউ নেই। আমি তিনবেলা খাই, পয়সার জন্য টিউশনি করাই আর ঝুম বর্ষাতে রিকশার হুড সরিয়ে দিয়ে ভেজার বদলে ভালো পর্দাওয়ালা রিকশা খুঁজি যাতে করে মাথায় বৃষ্টি পড়ে ঠান্ডা না লাগে! এরপর বিভিন্ন সময় নীহারের সাথে কথা হয়েছে। দিন কয়েক আগেই ও বলছিলো, ' সামনের পূর্ণিমায় আমাদের বাড়ির ছাদে গানের আসর বসবে। তোমার দাওয়াত।
' আমি মনে মনে হেসেছিলাম। কিন্তু এই মুহুর্তে আমি নীহারদের বাসার সামনেই দাঁড়িয়ে।
'কাকে চাচ্ছেন? অত্যন্ত বিনীত ভঙ্গিতে হাসি হাসি মুখ করে গেট থেকে একজন মাথা বের করে বলল। ' এই লোককে দারোয়ান মনে হচ্ছে না। নাকি অতি বড়লোকদের বাড়ির দারোয়ানরা এরকই হয়? ' আমি হাসান।
নীহারদের সাথে পড়ি। ওর সাথে দেখা করতে এসেছি। ' মিনিট দুয়েক পরে লোকটা এসে সেই আগের মতই হাসি হাসি মুখ করে বলল, ' আপা তার বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ছাদে বসে গান শুনতেছেন। এখন নামতে পারবেন না। পরে আসতে বলেছেন।
' আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। লোকটা কি এখনো হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে? লোকট যদি এখন আমাকে দেখত, তাহলে সে দেখতে পেত আমিও হাসছি।
বাসায় ঢুকে দেখলাম বাবা এখনো সেই আগের মতই সোফায় বসে আছেন। আমাকে দেখেও তিনি না দেখার ভান করলেন। রুমে ঢূকতেই দেখলাম চেয়ারের উপর লীনা বসে আছে।
লীনা বড় মামার মেয়ে। আমার চেয়ে দুই বছরের ছোট। কিন্তু আমাকে তুই করে বলে। 'কিরে কেমন আছিস? শুনলাম তুই নাকি এখন ঢাকার রাস্তায় চিৎ হয়ে শুয়ে জোছনা দেখিস?', পা নাচাতে নাচাতে বলল লীনা। ওর মুখে চাপা হাসি।
আমি উত্তর দিলাম না। বিরক্ত লাগছে প্রচন্ড। ' মনে হচ্ছে অনেক মন খারাপ। মুখ তো দেখি পেঁচার মতে হয়ে আছে। ' 'লীনা, তুই তূর্ণার রুমে যা।
ওর সাথে কথা বল। আমাকে বিরক্ত করিস না। ', কথাগুলো বলেই রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। বাথরুম থেকে ফিরে দেখি লীনা এখনো আগের মতই বসে আছে চেয়ারে। ' হাসান শোন।
তুই যে আমাকে প্রচন্ড অপছন্দ করিস তা আমি জানি', কথাটা শুনে অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে। কেমন যেন শান্ত ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ও। 'আমি জানি আমি দেখতে খারাপ। কালো একটা মেয়ে। সেজন্যই কি আমাকে এত অপছন্দ করতে হবে? তুই আমাকে এত অপছন্দ কেন করিস?', কথাগুলো বলেই উঠে চলে গেলো লীনা।
রুমের লাইট অফ করে বিছানায় এসে বসলাম। জানালা দিয়ে উথাল-পাথাল জোছনার আলো ঢুকে পড়েছে। আগামীকাল লীনার জন্মদিন। আজকে টিউশনির টাকাটা পেলে লীনা হয়ত আগামীকাল সকালে বুঝতেই পারতো না কে তার জন্য একগাদা ফুল পাঠিয়েছে। এই কালো মেয়েটা জানে না, কি অপূর্ব মুগ্ধতায় এক যুবক তার দিকে দূর থেকে তাকিয়ে থাকে।
জোছনার আলো তীব্র হয়েছে। আমি বাইরে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। আজ জোছনা দেখবো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।