আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভেজা চোখ,ভেজা কাঁধ......

ভালোবাসা দিয়ে,ভালোবাসা পেতে চাই "অ্যাটেনশান এন্ড রেসপন্ড টু ইউর রোল কল। রোল নাম্বার ওয়ান,টু,...." ভার্সিটির ফার্স্ট ক্লাস আজ। প্রথমেই পদার্থবিজ্ঞান ক্লাস। স্যার রোল কল করে যাচ্ছেন। কাব্যর রোল ১০৫।

কাব্য মনযোগ দিয়ে শুনছে,প্রথম দিনে সে রোল মিস করে ঝাড়ি খেতে চায় না। "রোল ১০২'' "ইয়েস ম্যাডাম...সরি স্যার" ক্লাস এ হাসির রোল পড়ে গেল। কাব্য কিছুখনের জন্যে চুপ হয়ে গেল। কন্ঠ এতোটা হৃদয় ছোঁয়া হয় কি করে!!কাব্য অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে.... "রোল ১০৫" কোনো সাড়া নেই "রোল ১০৫ নেই?রোল ১০৫" স্যার এবার একটু রেগেই গেলেন..। "ইইই...য়েস,ইয়েস স্যার" অবশেষে কাব্যর সাড়া মিলল।

"মনোযোগ কোথায়?প্রথম দিনই রোল মিস!বাকি দিন কি করবা?" "সরি স্যার। " "হম বস" "যাহ্ শালা যে জিনিসটা করতে চাইলাম না সেটাই হইল!"মনে মনে বলল কাব্য। আবার মেয়েটির দিকে তাকাল..... দেখতে ফর্সাই বলা চলে। উচ্চতা এবং শরীরের গঠন দুটোই ভালো। "তোমার দীঘল কালো ঘন কেশ রক্ত রাঙা লাল দুটি ঠোঁট তোমায় দেখতে লাগে যে বেশ" নিজের খাতার দিকে তাকিয়ে নিজেই অবাক হয়ে গেল কাব্য।

ও কবি হলো কবে!আচ্ছা ও যা মেয়েটিকে দেখছে মেয়েটি কি তা বুঝতে পারছে? প্রথম ক্লাসটা এভাবেই পার করে দিল কাব্য। সব কিছু ভেবে সিদ্ধান্ত নিল যে মেয়েটির সঙ্গে পরিচিত হবে। সব জড়তা কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে...... মেয়েটির বেঞ্চের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কথা বলা শুরু করবে... "ওই বাইর হ সব,ওই ধর ধর,ওরে ধর,শালারা মার,হাড্ডি ভাইঙ্গা দিবি সব কয়টা। অয় চিনে,অয় চিনে অয় কার লগে কথা কইছে?" কাব্য এবং ক্লাসের সবাই কেউ কিছুই বুঝল না।

সবাই ক্লাসের বাইরে এসে বারান্দায় দাঁড়াল। বাইরে এখনো হইচই এর আওয়াজ। কিছুখন পরে ওরা বুঝতে পারল,যে জিনিসটা এতোদিন শুনে এসেছে কিংবা পত্রিকায় পড়েছে তাই আজ নিজের চোখে দেখল। সিনিয়রদের মারামারি। কারণটা যে পলিটিক্যাল তাও বুঝে নিল।

কাব্য একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কারণটা যদিও অন্য। "এই শোনো,কি হয়েছে একটু বলবা আমাকে?আমার খুব ভয় লাগছে" কাব্য আবারো অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা নিজেই ওর সাথে কথা বলতে এসেছে...... "আরে কি হল?ভাব নাও নাকি?কথা বললে কি তোমার ভাব কমে যাবে?"" ""নিচে মারামারি হচ্ছে। বড় ভাইদের কি নিয়ে যেন মারামারি লেগেছে।

"" ""ওওও। তোমার বাসা কোথায়?"" ""বাসা নাই"" ""বাসা নাই মানে?তবে কি রাস্তায় থাকো?"" ""নাহ্,মেসে। ফার্মগেটে। "" ওহ আচ্ছা। আমি মিরপুরে থাকি।

আমি মৃত্তিকা,তুমি?"" ""আমি কাব্য"" ""নাইস টু মিট ইউ"" হাসি দিয়ে কাব্যর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল মেয়েটি..... কাব্য মনে মনে রবীন্দ্রনাথের দুলাইন ভাবছে..... ""তোমার মুখের পানে চাহিনু অনিমেষ বুকে বাজিল সুখের মতন ব্যথা"" ""কি ব্যাপর হাত মেলাবে না?""মৃত্তিকা যেন একটু ধমকের সুরেই বলল। কাব্য ইতস্তত করে হাত মেলালো। কথা বলতে বলতে দুজনে হেঁটে গেল। ক্লাস আর ঢাকার চিরচেনা জ্যামে সারাদিন কাটিয়ে সন্ধ্যার দিকে কাব্য মেসে ফিরে এল। গোসল করে কেবল বিছানায় বসল সাথে সাথে ফোন বেজে উঠল.... ""স্যার আজকে আসবেন না?"" ""হম আসছি,পড়তে থাকো"" ঢাকায় মেসে থাকে কাব্য আর পড়া-লেখা করে ভার্সিটিতে।

বাকিটা সময় টিউশানি করেই কাটাতে হয়। এর বাইরে কাব্যর আর কিছু নেই। মাঝে মাঝে যদি একটু বিশ্রাম নিতে গিয়ে দেরী হয়ে যায় তবে সাথে সাথেই ফোন চলে আসে। কাব্যর আর বিশ্রাম নেয়া হয় না। টিউশানি শেষ করে এসে কাব্য বিছানায় গা এলিয়ে দিল।

পেটে খুব ক্ষুধা কিন্তু আজ আর রাঁধতে ইচ্ছা করছে না। বিছানায় শুয়ে কাব্য আবিষ্কার করল ওর ঘুম আসছে না। মাথার ভেতরে শুধু সকালের লেখা লাইনগুলো খোঁচাচ্ছে। মৃত্তিকার কথাও মনে পড়ছে খুব। চিন্তা করতে করতে কাব্য ঘুমিয় পড়ল।

আজ ক্লাসে একটু দেরীতে এল কাব্য। মৃত্তিকা বারান্দায় দাড়িয়ে গল্প করছিল। "কি ব্যাপার তোমার আজ এতো দেরী?" "রাতে ঘুম ভালো হয়নি তাই..." "কেনো?" "কারণ একটা ফোন নাম্বার আমার খুব প্রয়োজন ছিল বাট আমার কন্ট্যাক্ট লিস্টে তা খুঁজে পাচ্ছিলাম না" "ও কি নাম্বার?আমি কি তোমাকে হেল্প করতে পারি?" ""ম পারো। তোমার নাম্বারটা খুঁজছিলাম" "হাহাহা,কাব্য তুমি এমনভাবে কথা বলো!ভেরি ফানি" "ফান না,আমি সিরিয়াস। " "ওহ্।

ওকে তোমার ফোন দাও আমি সেভ করে দিচ্ছি। " মৃত্তিকা কাব্যর ফোন নিয়ে ওর নাম্বারটা সেভ করে দিল। "তোমার ফ্যামিলিতে কে কে আছে মৃত্তিকা?" "আমি বাবা-মার একমাত্র সন্তান ছিলাম। বছর দুয়েক আগে একটা দুর্ঘটনায় বাবা-মা মারা যায়। আমি বেঁচে যাই।

এরপর মামা মামির সাথেই আছি। " এরপরে দুজনে ক্লাসে চলে গেল। কাব্যর দিনগুলো ভালোই যাচ্ছিল। আনন্দহীন হয়ে পড়া জীবনে ও নতুন বৈচিত্র খুঁজে পেল যেন। দেখতে দেখতে ভার্সিটিতে অনেকগুলো দিন পার হয়ে গেল।

ফাইনাল এক্সাম শেষ। "কাব্য তোমার ফ্যামিলী সম্পর্কে কখনো বলোনি আমাকে। আজ তোমার ফ্যামিলী সম্পর্কে বল। " "হাহাহা আমার ফ্যামিলী!"অনেক জোড়ে জোড়ে কিছুখন হাসল কাব্য "কাব্য,আমি মজা করছি না" "আমার ফ্যামিলীর কথা শুনতে তোমার ভালো লাগবে না মৃত্তিকা" "কাব্য আমি তোমার ফ্যামিলী দেখে বা জেনে তোমাকে পছন্দ করিনি। তোমাকে পছন্দ করে তোমার ফ্যামিলির কথা জানতে চাইছি।

আজকের তুমি তোমার ফ্যামিলীর কারণেই। সো তোমার ফ্যামিলীকে খারাপ লাগার কিছু নেই। আর তাছাড়া আমার নিজের কোনো পরিবার নেই। তাই আমি তোমার পরিবারকে আমার পরিবার করে নিতে চাই। বিয়ের পর আমি বাবা-মার সাথে থাকবো,তাদের সঙ্গে গল্প করব,মজা করব,ঘুরব......কাব্য তুমি এভাবে কি দেখছ?" "তুমি আমাকে নিয়ে এভাবে ভাবছো কখনো বলনি তো।

" হঠাৎ করেই মৃত্তিকা লজ্জা পেয়ে গেল। কথায় কথায় সে তার মনে লুকিয়ে রাখা গোপন কথাটা প্রকাশ করে ফেলেছে। লজ্জায় তার গাল গোলাপী হয়ে গেছে। কাব্য মৃত্তিকার চিবুক উঁচু করে ধরে ওর দিকে তাকিয়ে আছে..... "আসলে মৃত্তিকা তোমাকে কখনো বলা হয়নি। আমিও তোমাকে খুব পছন্দ করি।

তোমাকে......." "তুই ক্যান চোখ বড় করলি??ওই শালা তুই চিনস হ্যায় কে?দুইদিন ধইরা কইতাছি তোরে,সাবধান করতাছি"" "ওই শালারে পিডা। " "ভাঙ,ভাইঙা ফালা সামনে যা পাবি সব ভাঙ। " "আমগো দলের পোলার লগে চোখ গরম করছে!সাহস কত" ভার্সিটিতে আবারো গণ্ডগোল,মারামারি শুরু হয়ে গেল। "আমি প্রেমের কথা বলতে গেলেই ঝামেলা হয়। শালার কপালটাই খারাপ।

"মনে মনে বলল কাব্য। "মৃত্তিকা চলো তোমাকে পৌছে দেই,আজ ভালোই ঝামেলা হবে" "চলো" ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরে কাব্য ভাবছে সে তার পরিবারের কথা মৃত্তিকাকে কিভাবে বলবে?বললে মৃত্তিকাই বা কি ভাববে!!চিন্তা করতে করতে কাব্য ঘুমিয়ে গেল। আজ ফাইনাল এক্সামের রেজাল্ট। সবাই চিন্তিত থাকলেও কাব্যকে নরমাল ই দেখা যায়। টেনেটুনে পাস করলেই চলবে কাব্যর।

তাই সে টেনশন ফ্রি। নোটিশ বোর্ডে কাব্য আর মৃত্তিকা রেজাল্ট দেখে নিল। ভালোই করলো দুজনে তবে মৃত্তিকা একটু বেশীই ভালো করে ফেলল। আর তাই মৃত্তিকা আজ কাব্যকে খাওয়াবে। দুজনে মিলে ক্যান্টিনে গিয়ে বসলো।

"মৃত্তিকা তোমাকে আজ আমার ফ্যামিলির কথা বলব" "আজ কেনো!অন্য সময় বলো" অনেকখন চুপ করে রইল কাব্য। "মোটামুটি দরিদ্র ফ্যামিলিই ছিল আমাদের। আমি আর আমার এক ছোটোবোন ছিল,আর বাবা-মা। বাবা গার্মেন্টসে চাকরী করতেন আর মা বাসার কাজ। খরচের কথা ভেবে বোনকে অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেয় বাবা-মা।

দিন চলে যাচ্ছিল ভালোই। আমি কখনো স্কুলে ক্লাস করতাম না। কারণ আমার বাবা গার্মেন্টসে কাজ করতো বলে সবাই আমাকে খেত বলতো। বলতো,"ওই দ্যাখ,আইছে গার্মেন্টসের বাচ্চা"গার্মেন্টসে কাজ করতো বলে আমার বাবাকে ওরা আস্ত গার্মেন্টস বানিয়ে দিয়েছিল ভেবে আমার বেশ মজা লাগত। তবে আমার সবচাইতে মজা লাগত যখন আমি দেখতাম ওরা আমার বাবার কিংবা আমার বাবার মত অন্য কোনো লোকের হাতের বানানো জামা গায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়ায় বা ফ্যাশন করে আর আমাকে বলে "শালা খ্যাত"!এরপর একদিন,অনেক বছর আগে,আমার দিন তারিখ মনে নেই,ইচ্ছে করেই মনে রাখিনি।

স্কুলের মাঠে বসে ছিলাম। দুটা ছেলে এসে বলল,ওই টাকা দে,গার্মেন্টস ভেঙে পড়ছে সাভারে,সাহায্য দিতে হবে। আমি কিছু বুঝি নাই সে সময় শুধু বুকের ভেতর কেমন যেন করে উঠল। বাসায় চলে গেলাম তাড়াতাড়ি। গিয়ে দেখলাম মা পাশের বাড়ির টিভির দিকে তাকিয়ে দেখছেন আর বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন।

আমার এবার আর কিছু বুঝে নিতে অসুবিধা হলো না। আমার বাবা যে গার্মেন্টসে কাজ করতেন সেটি ভেঙে পড়ে গেছে। আমি ওখান থেকে চলে এসেছিলাম। আমি দুদিন পরে এক চাচার সাথে ঢাকা চলে আসি। যে গার্মেন্টস ভেঙে পড়েছিল তার থেকে একটু দূরে এক জায়গায় বসে ছিলাম।

একজন এসে আমার কথা জিজ্ঞেস করল। আমি সব বললাম ওনাকে। উনি আমাকে এক জায়গায় নিয়ে গেলেন,চারপাশে শুধু গন্ধ আর গন্ধ কিসের এমন বাজে গন্ধ হতে পারে আমি বুঝলাম একটু পরেই। এই প্রথম আমার চোখ গড়িয়ে পানি পড়তে শুরু করল। আমি বাবার লাশ খুঁজে পেলাম,নিহতের লিস্টে বাবার নাম ছিল এবং তার পাশে লাশ হস্তান্তরের সাইন দিলাম আর আমাকে কিছু টাকা দিল।

আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। এরপরে কিছু লোক আমাকে ধরে নিয়ে গেল,বলল,শালা লাশ চুরি করস না?শালা চোর,হিরনচি। আমার বাবার লাশ আর টাকা ওরা নিয়ে গিয়েছিল আমি ওদের পা জড়িয় ধরে কেঁদেছিলাম কিন্তু কেউ আমার কান্না শোনেনি। আমি চিৎকার করে বলেছিলাম,ভাই আপনারা টাকা নিয়া যান,লাশটা নিয়েন না ভাই। কিন্তু আমার চিৎকার কেউ শোনেনি।

গরীবের কান্না কেউ শোনে না মৃত্তিকা। আমি সেদিনের পর আর কোনোদিন কাঁদিনি। " মৃত্তিকা কোনো কথা বলতে পারলো না,নীরবে শুধু চোখের পানি মুছল। "এই ঘটনা শোনার পরে মা আরেকবার জ্ঞান হারান,এরপর আর জ্ঞান ফেরেনি। আমি আর বাড়ি ফিরে যাইনি।

আমি সরি মৃত্তিকা,তোমাকে নতুন পরিবার উপহার দিতে পারলাম না। আমাকে মাফ করে দিও। তবে এটা সত্য যে আমি তোমাকে...." "থাক,আর বলো না,সবকিছু বলে দিতে হয় না কাব্য। মেয়েরা অনেক কিছুই না বললেও বুঝতে পারে। আমি ভাবছি,আমি এক এতিম আর আমার কপালে জুটলো ও আরেক এতিম।

হাহাহা....এতিম এতিম ভালবাসা" কথা বলতে বলতে ওরা ক্যান্টিনের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল। মৃত্তিকা ওর মিষ্টি হাসিটা কাব্যকে উপহার দিল আরো একবার। কাব্য অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। মৃত্তিকাকে বুকে জড়িয়ে ধরল আর পুরোনো লেখা লাইনগুলো আবৃত্তি করে গেল...... তোমার ওই টানা চোখের চাহুনী ঠোটের কোনের মিষ্টি একটু হাসি আমার শূন্য হৃদয়ে তোলে ঝড় আমার চোখ তোমার দিকে অনড় তোমার কন্ঠের ওই একটুখানি উচ্ছলতা বুঝিয়ে দেয় তোমার হৃদয়ের গভীরতা তোমার দীঘল ঘন কালো কেশ তোমায় আমার দেখতে লাগে বেশ অনেকদিন পর কাব্য উপলব্ধি করল তার চোখদুটো আবার ভিজতে শুরু করেছে। একই সাথে কাঁধ ও ভেজা।

আচ্ছা কাঁধ ভেজা কেনো?? পুলক হাসান-০২। ০৫। ১৩ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।