নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েত প্রস্তাবে চীন জোরেশোরে ভেটো দেওয়ায় ভণ্ডুল হলো রুশ-স্বপ্ন। তবে এতে যুক্তরাষ্ট্র যে বেশ সুবিধা করতে পেরেছিল তা নয়। পাস হয়নি মার্কিন প্রস্তাবও। এতে কী হলো? জাতিসংঘে ফলাফল হলো শূন্য।
এদিকে ঢাকায় পূর্ব প্রদেশ নিজেদের আওতায় নেওয়ার পরিকল্পনা করল পাকিস্তানি বাহিনী। কিন্তু বাঙালি সামরিক বাহিনীর সদস্য ও ছাত্র-জনতা গড়ে তুলল তীব্র প্রতিরোধ। চট্টগ্রামে শহরের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণে নিল বাঙালি সেনা ও ইপিআর। সেখানে নিয়ন্ত্রণ নিতে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে চালানো হলো যুদ্ধজাহাজ ও বিমান থেকে আক্রমণ। নিয়ন্ত্রণে চলে এলো কুষ্টিয়া, পাবনা, বগুড়া, দিনাজপুরসহ অনেক এলাকা।
তীব্র আক্রমণের মাধ্যমে সীমান্তবর্তী বর্ডার পোস্টগুলো একে একে দখল করে নিতে শুরু করল মুক্তিযোদ্ধারা। ৩০৭টি পোস্টের ৯০টিই দখল করে নিল তারা। গেরিলা হামলা হয়ে উঠল তীব্র থেকে তীব্রতর। এসব ঠেকাতে পাকিস্তানি বাহিনী কাজে লাগাল শান্তি কমিটির অধীন রাজাকার, আলবদর, আলশামসকে। সাধারণ মানুষের ওপর নেমে এলো অসহনীয় নির্যাতন। ঘরে ঘরে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও তার স্বজনদের খুঁজতে থাকল তারা। তবে মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে অনেকটাই মনোবল হারিয়ে ফেলল রাজাকার, আলবদর, আলশামস। এমন পরিস্থিতিতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জরুরি ভিত্তিতে নতুন করে আনা হলো পাঁচ ব্যাটালিয়ন সেনা।
লাভ হলো না এতে। অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হলো তারা। উপায়ান্তর না দেখে ডিসেম্বরের ৩ তারিখ ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল পাকিস্তান। ওই দিন বিকেলে রেডিও পাকিস্তান প্রচার করল বিশেষ এক বুলেটিন। এতে বলা হলো, পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তজুড়ে আক্রমণ শুরু করেছে ভারত। বিকেল ৫টা ০৯ মিনিটে পেশোয়ার বিমানবন্দর থেকে ১২টি যুদ্ধবিমান উড়ে গেল কাশ্মীরের শ্রীনগর ও অনন্তপুরের দিকে। সারগোদা বিমানঘাঁটি থেকে আটটি মিরেজ বিমান রওনা হলো অমৃতসর ও পাঠানকোটের উদ্দেশে। দুটি যুদ্ধবিমান বিশেষভাবে পাঠানো হলো ভারতীয় ভূখণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল আগ্রায় আঘাতের জন্য। পাকিস্তানের মোট ৩২টি যুদ্ধবিমান অংশ নিল এ আক্রমণে। একই সময় কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড ময়দানে জনসভায় বক্তৃতা করছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। এ সময় ভারতের বিভিন্ন ঘাঁটিতে শুরু হলো পাকিস্তানের বিমান আক্রমণ। সময় ক্ষেপণ না করে দিলি্ল ফিরলেন তিনি। বসল মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক। মধ্যরাতের কিছু পরে বেতার ভাষণে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলেন ইন্দিরা। বললেন, এত দিন ধরে পূর্ব পাকিস্তানে যে যুদ্ধ চলে আসছিল, তা পরিণত হয়েছে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে। একই ভাষণে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ৪ ডিসেম্বর ভারতীয় স্থলবাহিনীর সম্মুখসমর শুরু হলো চারটি অঞ্চল থেকে। পূর্বে ত্রিপুরা, উত্তর-পশ্চিমে কলকাতা ও মেঘালয় রাজ্যের তুরা থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে আক্রমণ চালাল যৌথ বাহিনী। প্রবল আক্রমণের মুখে সীমান্তবর্তী যুদ্ধক্ষেত্রগুলো থেকে পিছু হটতে শুরু করল পাকিস্তানি সেনারা। একের পর এক পতন হতে থাকল পাকিস্তানি ঘাঁটির। স্বতঃস্ফূর্তভাবে যৌথ বাহিনীর সহায়তায় এগিয়ে এলো পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনতা। যৌথ বাহিনী ঢাকার দোরগোড়ায় পেঁৗছে গেল আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণার মাত্র ১৩ দিনের মাথায়। এর আগেই বিমান হামলা চালিয়ে পরাস্ত করা হলো পাকিস্তানি বিমান বাহিনীকে। এ সময় বিধ্বস্ত করে দেওয়া হলো ঢাকার সব সামরিক বিমানঘাঁটির রানওয়ে। পরাজয় নিশ্চিত জেনে মরণ-কামড় দিল রাজাকার, আলবদর, আলশামস। ঘর থেকে ধরে এনে হত্যা করল জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের। তৎকালীন পাকিস্তানি ঊধর্্বতন সেনা কর্মকর্তারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আশ্বাস পেয়েছিলেন উত্তরে চীন ও দক্ষিণে আমেরিকা থেকে সহায়তা আসবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা মেলেনি তার। আবদুল মালিক ছিলেন এ সময় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর। ৯ ডিসেম্বর তিনি এক বার্তা পাঠালেন প্রেসিডেন্টকে। সেখানে তিনি অনুরোধ করে লিখলেন, 'সামরিক পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে। বাইরের সাহায্য যদি না আসে, তবে শত্রু যে কোনো দিন পেঁৗছে যাবে ঢাকার উপকণ্ঠে। পুনরায় আপনাকে বলছি, আশু যুদ্ধবিরতি ও রাজনৈতিক সমাধানের কথা বিবেচনা করুন।' ১০ ডিসেম্বর গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মে. জে. রাও ফরমান আলী ও মুখ্যসচিব মুজাফফর হোসেন ক্যান্টনমেন্টে জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে আলোচনা করলেন বিস্তারিত। সিদ্ধান্ত হলো ঢাকায় জাতিসংঘের প্রতিনিধির কাছে অস্ত্রসংবরণের আবেদন করবেন তারা। আবেদন করা হলো। উল্লেখ করা হলো, 'যেহেতু সংকটের উদ্ভব হয়েছে রাজনৈতিক কারণে, সুতরাং এর সমাধান হতে হবে রাজনৈতিক। তাই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ঢাকায় সরকার গঠনের আহ্বান জানানো হচ্ছে। শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানানো হচ্ছে জাতিসংঘকে।' আবেদনপত্র দাখিল করা হলো ঢাকায় জাতিসংঘের প্রতিনিধি পল মার্ক হেনরি বরাবর। তবে পরদিনই প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো তা। অন্যদিকে ঢাকা ঘেরাও করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আত্দসমর্পণের আহ্বান জানালেন মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনারা। বোমা ফেলা হলো গভর্নর হাউসে (বর্তমান বঙ্গভবন)। পদত্যাগ করে আশ্রয় নিলেন হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে (বর্তমান রূপসী বাংলা) গভর্নর মালিক ও পাকিস্তান সরকারের অন্য কর্মকর্তারা।
নিয়াজি সময় চাইলেন আত্দসমর্পণ বিষয়ে সিদ্ধান্তের। অনুরোধ জানালেন যেন স্থগিত রাখা হয় আক্রমণ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে পরদিন সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত বন্ধ রাখা হলো ভারতীয় বিমান আক্রমণ। সময়সীমা শেষ হওয়ার কিছু আগে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী জাতিসংঘের প্রতিনিধির মাধ্যমে ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানালেন যুদ্ধবিরতি আরও ছয় ঘণ্টা বাড়ানোর। এর পরই তারা সিদ্ধান্ত নিলেন অস্ত্র সমর্পণ বা আত্দসমর্পণের। পাকিস্তানিদের আত্দসমর্পণের দলিল চূড়ান্ত করতে ওই দিন মধ্যাহ্নে ঢাকায় এলেন ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকব। বিকেল ৪টার আগেই ঢাকা প্রবেশ করল বাংলাদেশ নিয়মিত বাহিনীর দুটি ইউনিটসহ মোট চার ব্যাটালিয়ন সেনা। পেঁৗছলেন কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকার জনবিরল পথঘাট ক্রমেই জনাকীর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করল সাধারণ মানুষের ভিড়ে। একই সময়ে ঢাকায় অবতরণ করলেন ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর অধিনায়ক লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরা, বাংলাদেশের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খোন্দকার এবং ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অন্য সদস্যরা। এর কিছু পরই ভারতের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলেন ইন্দিরা গান্ধী। ১৬ ডিসেম্বর বিকেল। ঢাকার রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ও আশপাশ যেন জনসমুদ্র। আনুষ্ঠানিক আত্দসমর্পণের জন্য প্রস্তুত পাকিস্তান। প্রস্তুত তাদের ৯৩ হাজার সেনা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাঠ। একপাশে বসলেন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক লে. জে. এএকে নিয়াজি। সঙ্গে তার অধীনস্থরা। অন্যপাশে লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরা ও ভারতীয় অন্যান্য সেনা অফিসার। হাজার হাজার উৎফুল্ল জনতার সামনে আত্দসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করলেন লে. জে. এএকে নিয়াজি। এরই মধ্য দিয়ে অবসান ঘটল ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের। অভ্যুদয় ঘটল বাংলাদেশ নামক স্বাধীন এক রাষ্ট্রের।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।