অনেক আনন্দ-বেদনা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও হাসি-কান্নার মিশেল নিয়ে কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে আরও একটি বছর ২০১৩। নতুন প্রত্যাশার বার্তা নিয়ে ক্যালেন্ডারের নতুন পাতায় চোখ বুলানোর আগে ফিরে তাকাতে হয় পুরনো বছরে দিকে। সাফল্য আর প্রাপ্তির পাশাপাশি ২০১৩ সাল ছিল সহিংস রাজনীতির আগুনে ঝলসে যাওয়া শত মানুষের মুখ আর স্বজনহারাদের হাহাকারের বছর। এ বছর রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আগুন ছড়িয়ে পড়েছে রাজপথ পেরিয়ে ছায়া সুনিবিড় দূরের মফস্বল পর্যন্ত। রাজনৈতিক অচলাবস্থায় দুই নেত্রী টেলিফোনে কথা বললেও তার উষ্ণতার ছোঁয়া পায়নি ১৬ কোটি মানুষের এই দেশ। বরং নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দুই দলের মধ্যে বৈরিতা বেড়েছে বহুগুণ। সাভারের রানা প্লাজা ধসের মতো মানবিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি বিশ্ববাসীর অবাক বিস্ময়ের মতো ধ্বংসস্তূপ থেকে দুই হাজার ৪৩৮ জন মানুষের বেঁচে ফিরে আসা ছিল উদ্ধার ইতিহাসের বড় অর্জন। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এগিয়ে নেওয়া, তারুণ্যের উচ্চকিত কণ্ঠ গণজাগরণ মঞ্চের সূচনা, হেফাজতে ইসলামের উত্থান, পিলখানা হত্যা মামলার রায়, মধ্য জুনে সিটি নির্বাচনে বিরোধী দলের বিপুল বিজয়সহ নানা ঘটনায় আলোচিত ছিল গত বছরটি। জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক নিবন্ধন বাতিল, পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যর্থতা, বেশ কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন উড়াল সড়ক উদ্বোধন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের অগ্রগতিসহ নানা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিতে ভরে ছিল গত বছর। বছরের শুরুতে হলমার্ক কেলেঙ্কারি আর শেষ দিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সম্পদের বহুগুণ প্রবৃদ্ধিতে বিব্রত সরকার ও জনগণ। যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু : গত বছরের শুরুতেই জাতি স্বাধীনতার ৪২ বছর পর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে গ্লানিমুক্তির আস্বাদ পায়। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২১ জানুয়ারি ফরিদপুরের মাওলানা পলাতক আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্য দিয়ে বহুল আলোচিত একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সূচনা হয়। তারুণ্যের গণজাগরণ ও সাঈদীর ফাঁসি : মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় প্রত্যাখ্যান করে ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে তারুণ্যের 'গণজাগরণ' সৃষ্টি হয়। লাখো মানুষকে শাহবাগের এক মঞ্চে নিয়ে আসে 'গণজাগরণ মঞ্চ।' ১৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে হাজারো মোমবাতির আলোয় ভাসে পুরো দেশ। ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় হওয়ার পর জামায়াত দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক সহিংসতা চালায়। এক সপ্তাহের নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞে দেশের ১৮ জেলায় ৭৭ জন সহিংসতায় নিহত হন। আক্রান্ত বিএনপি অফিস : ১১ মার্চ বিএনপির নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হানা দিয়ে পুলিশ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, সাদেক হোসেন খোকা, আমানউল্লাহ আমান, রিজভী আহমেদ, জয়নুল আবদিন ফারুকসহ ১৫৪ নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে। বিএনপি কার্যালয়ে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় পুলিশ। হেফাজতের উত্থান, রানা প্লাজা ধস : এপ্রিলের শুরুতেই ১৩ দফা দাবি নিয়ে ভয়ঙ্করভাবে দৃশ্যপটে আসে হেফাজতে ইসলাম। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক এ ধর্মীয় গোষ্ঠী ৬ এপ্রিল ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ করে রাতারাতি সংঘবদ্ধ শক্তি হিসেবে আবিভর্ূত হয়। এদিকে ২৪ এপ্রিল সাভারে ধসে পড়ে ৯ তলা রানা প্লাজা। বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান এক হাজার ১৩৪ জন। ২০ দিন ধরে চলা উদ্ধারকাজে ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত উদ্ধার হন দুই হাজার ৪৩৮ জন। ১৭ দিন পর ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত উদ্ধার হন রেশমা নামে এক গার্মেন্ট কর্মী। হেফাজতের তাণ্ডব : এপ্রিলে শাপলা চত্বরে লংমার্চ-উত্তর সমাবেশের পর ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। সরকারি দল আওয়ামী লীগ হেফাজতের ১৩ দফার বিরোধিতা করলেও বিএনপি দলটিকে অপ্রকাশ্যে সমর্থন জোগায়। ৫ মে হেফাজতের শাপলা চত্বরের কর্মসূচি ঘিরে বিএনপি সরকার পতনের স্বপ্ন দেখে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া হেফাজতের সমাবেশে যোগ দিতে দলীয় নেতা-কর্মীসহ ঢাকাবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। এদিন পল্টন ও মতিঝিলে নজিরবিহীন তাণ্ডব চালায় জামায়াত ও হেফাজত কর্মীরা। তারা শত শত যানবাহন, ফুটপাতের দোকান, বায়তুল মোকাররমের কোরআন শরিফ পুড়িয়ে দেয়। গাছ কেটে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। বিএনপির সিটি বিজয় : রাজনৈতিক অচলাবস্থার মধ্য দিয়েই ১৫ জুন অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে চার সিটিতে বিজয় লাভ করেন বিএনপি মনোনীত প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় স্থানীয় নেতাদের হারিয়ে রাজশাহীতে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, সিলেটে আরিফুল হক চৌধুরী, খুলনায় মনিরুজ্জামান ও বরিশালে আহসান হাবিব মেয়র নির্বাচিত হন।
গোলাম আযমের রায় : ১৫ জুলাই দেশের শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমকে বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আলোচিত ঐশী : গত বছরের মধ্য আগস্টে ঘটে সামাজিক অবক্ষয়ের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। ১৪ আগস্ট রাজধানীর চামেলীবাগে সিআইডি কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে খুন করে তাদের কিশোরী কন্যা ঐশী রহমান। এর আগে ১০ সেপ্টেম্বর সিলেটে সিপিবি ও বাসদের সমাবেশে ঔদ্ধত্য ছাত্রলীগ কর্মীরা হামলা চালায়। এতে সিপিবি নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমসহ ১৫ নেতা-কর্মী আহত হন। রাজনীতিতে সংঘাতময় পরিবেশের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার মধ্যে বহুল আকাঙ্ক্ষিত টেলিফোন আলাপচারিতা হয় ২৮ সেপ্টেম্বর। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের রায় : পিলখানায় বিডিআর সদর দফতরের হত্যাকাণ্ড মামলায় ৫ নভেম্বর ১৫২ জনের ফাঁসি ও ১৬১ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেয় আদালত। রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে চারটি পাবলিক পরীক্ষা, স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা এবং উচ্চশিক্ষার ভর্তি পরীক্ষা একের পর এক পিছিয়েছে নভেম্বরে এসে। পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন করেও দিশা পায়নি শিক্ষা প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষ।
ডিসেম্বরে গ্লানিমুক্তি : বছরের শেষ মাস ডিসেম্বর ছিল অনেক ঘটনার ঘনঘটায় ভরা। ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফারনান্দেজ তারানকো ঢাকায় এসে দুই পক্ষকে সংলাপে বসাতে সক্ষম হন। তার উপস্থিতিতে দুই দফা ও তিনি যাওয়ার পর এক দফা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বৈঠক হয়। সমঝোতায় পেঁৗছাতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুন ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি টেলিফোনে কথা বলেন। অবশ্য ডিসেম্বরে অন্য ইস্যুতেও শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। তিনি ২৪ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে টেলিফোন করে দাঙ্গা বিক্ষুব্ধ দক্ষিণ সুদানের জন্য এক ব্যাটালিয়ন শান্তিরক্ষী পাঠানোর অনুরোধ জানান। ১২ ডিসেম্বর রাতে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এ ঘটনায় পাকিস্তানের পার্লামেন্টে নিন্দা প্রস্তাব পাস নিয়ে প্রতিবাদে গর্জে ওঠে বাংলাদেশ। গণজাগরণ মঞ্চ পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জানায় সরকারের প্রতি। তারা পাকিস্তান দূতাবাস বন্ধের দাবি জানায়। ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর গোপীবাগে এক পরিবারের ছয়জনকে গলা কেটে খুন করা হয়। কিন্তু খুনের রহস্য ১০ দিনেও বের করতে পারেনি পুলিশ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।