আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ডিগবাজি খেয়ে এরশাদের স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন

জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আবারও ডিগবাজি খেলেন। গত মাসদুয়েক ধরে তিনি অবিরাম বলে আসছিলেন, তিনি মহাজোটে থাকবেন না, নেই। ১৭ নভেম্বর-২০১৩ পর্যন্ত তিনি মহাজোটে ছিলেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন কথিত সর্বদলীয় সরকারে যোগদানের দিন তিনি মহাজোট ত্যাগের অর্থহীন ঘোষণা দিয়ে রাজনৈতিক মহলে হাস্যরসের খোরাক জোগান। তার মহাজোট সরকারে যোগদান এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা কিছু মানুষকে হতাশ করলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষণে এটা খুবই পরিষ্কার যে, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই।

যারা হতাশ হয়েছেন তারা এরশাদের অতি সাম্প্রতিক অনেকটা 'দ্রোহী' ভূমিকা ও বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে এমন একটা ধারণা করেছিলেন যে, এবার বুঝিবা তওবা করে তিনি ভালো হয়ে গেছেন। আর হয়তো জনগণের সঙ্গে প্রতারণাশ্রয়ী কোনো খেলা খেলবেন না। বিশেষ করে তিনি যখন বললেন যে, সবদলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে জনগণ তাকে জাতীয় বেইমান বলবে, মুখে থুতু দেবে, তখন কিছু মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে মনে করেছিল এরশাদ বোধহয় এ ব্যাপারে তার অন্তরের কথাই বলছেন। শেখ হাসিনার 'তু-তু' ডাকে দিশাহারা হয়ে ছুট দেওয়ার মাত্র দুই দিন আগে এরশাদ যখন বললেন, 'শেখ হাসিনার সঙ্গে একত্রে বেহেশতে যেতেও আমি রাজি নই', তখন থেকে অন্তত কেউ কেউ এটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে, নাহ, এবার হয়তো আর বেইমানি করবেন না তিনি। কিন্তু গ্রামগঞ্জে একটা প্রবাদ আছে না যে, কোনো একটা প্রাণীর বাঁকা লেজ যতদিন একটা সোজা চোঙে ঢুকিয়ে রাখা হয় ততদিনই সোজা থাকে, চোঙটা খুলে নিলেই সঙ্গে সঙ্গে আবার লেজটা বাঁকা হয়ে যায়; এই প্রবাদটা এরশাদের বেলায় সত্য হয়ে গেল বলেই এখন মন্তব্য করছেন সবাই।

গত ক'দিনে এমন কোনো খারাপ মন্তব্য নেই যা তাকে নিয়ে করা হয়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানাজন নানা রকম রসাত্দক স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। অনেকে স্মরণ করছেন পটুয়া কামরুল হাসানের সেই বিশ্ববিখ্যাত 'বিশ্ব বেহায়া' কার্টুনের কথা, বলছেন, শিল্পী বেঁচে থাকলে জাতি আরেকটা মজার কার্টুন দেখতে পেত। কার্টুনিষ্ঠ শিশির এরশাদকে গরু বানিয়ে গলায় দড়ি দিয়ে শেখ হাসিনা টেনে নিয়ে যাওয়ার যে কার্টুনটি জাতিকে উপহার দিয়েছেন তা অবশ্য অনেক দিন মানুষের মনে থাকবে। কার্টুনের গরুর আদলে এরশাদের ছবিটা হয়েছে বেশ খাসা! তার থুতু তত্ত্ব নিয়েও স্ট্যাটাসে অনেক মজার গল্প পাওয়া যাচ্ছে।

অবশেষে ডিগবাজি খেয়ে তিনি কথিত সর্বদলীয় সরকারে যোগ দিয়েছেন এবং শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়ারও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে বেহেশতেও যাবেন না বলেছিলেন। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে, তিনি তার সঙ্গে প্রয়োজনে 'দোজখে' যাওয়ার জন্যও মাল-সামানা গুছিয়ে রেখেছেন।

ঠিক যেন ১৯৮৬ সালের ঘটনার পুনরাবৃত্তি। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন তখন তীব্র।

এই বুঝি এরশাদের সরকার পড়ে যায়, পড়ে যায় অবস্থা। এরশাদ তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছেন। প্রধান দুই দলের ঘোষণা, তারা এরশাদের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না। শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছিলেন, এরশাদের অধীনে যারা নির্বাচনে যাবে তারা হবে জাতীয় বেইমান। কিন্তু জাতিকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়ে মাত্র এক দিনের ব্যবধানেই তিনি সম্পূর্ণ বদলে গেলেন।

ঘোষণা করলেন, এরশাদের অধীনে তিনি এবং তার লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। একইভাবে এরশাদও বদলে গেলেন এক দিনের ব্যবধানে। সমীকরণটা কী তা কারও জানার আগ্রহটা খুবই স্বাভাবিক। পাঠক, আসুন আমরা সমীকরণটা একটু মিলিয়ে দেখি। '৮৬ সালে বিষয়টা আগে থেকে জনসাধারণ বুঝতে পারেনি।

পাতানো খেলায় পা দেওয়া লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা একটা কঠোর অবস্থানে ছিলেন। জনগণকে তিনি এমন ধারণাই দিয়েছিলেন যে, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াই এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার জন্য তলে তলে সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে ফেলেছেন। চট্টগ্রামের এক জনসভা থেকে তাই তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে, 'যারা এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যাবে তারা হবে জাতীয় বেইমান'। মাত্র এক দিনের ব্যবধানেই অবস্থান পাল্টে ফেলেছিলেন লীগ নেত্রী। সারা জাতিকে বিস্ময়ে হতবাক করে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, আওয়ামী লীগ এরশাদের অধীনে নির্বাচন করবে।

এরশাদের জবরদস্তি ক্ষমতা দখলকে বৈধকরণের জন্য সেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল খুবই জরুরি। শেখ হাসিনা জানতেন তিনি ক্ষমতা পাবেন না। তারপরও এরশাদের ক্ষমতাকে পোক্ত করার জন্য তিনি কেন সে নির্বাচনে গিয়েছিলেন? এই সমীকরণ মেলানোর জন্য আমাদের দেশে পরপর ঘটে যাওয়া আরও তিনটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ঘটনার প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। এক. '৮৬ সালের সেই পাতানো সংসদ নির্বাচনের পর অনুষ্ঠিত হয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। খালেদা জিয়া যথারীতি সেই নির্বাচনও বর্জন করেন।

বিপদে পড়ে যান শেখ হাসিনা। আগের সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে দলের ভেতরেও তিনি সমালোচিত হন। তার ভাবমূর্তি অনেকটাই ক্ষুণ্ন হয়। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার ভাবমূর্তি হয়ে ওঠে গগনচুম্বী। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যেতে সাহস করলেন না শেখ হাসিনা।

কিন্তু বিরোধিতাও করলেন না। খালেদা জিয়া ও তার দল বিএনপি শুধু বর্জনই নয়, সে নির্বাচনের বিরুদ্ধে জনমতও গঠন করে। যার ফলে ওই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট প্রদানের হার ছিল খুবই কম। নির্বাচনকে দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্য করার জন্য একজন পরিচিত মুখ হিসেবে বেছে নেওয়া হলো কর্নেল (অব.) ফারুককে। অন্তত এই একটি কারণে হলেও সেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা, তার দল ও সহযোগী বামদের অবস্থান নেওয়া ছিল সঙ্গত ও প্রত্যাশিত।

কিন্তু তারা সে অবস্থান নেননি। কেন নেননি? এ সমীকরণ একটু জটিল বলেই মনে হতে পারে।

শেখ হাসিনা, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং কর্নেল (অব.) ফারুকের প্রকাশ্য রাজনৈতিক অবস্থান ভিন্ন হলেও বিভিন্ন বাস্তব ঘটনার বিশ্লেষণে তিনজন একই গুরুর শিষ্য কিনা এই চিন্তা আমাদের ধন্ধেই ফেলে দেয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের জন্য আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার অভিযোগের আঙ্গুল কোন দিকে তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বঙ্গবন্ধু যখন নিহত হন তখন সারা দুনিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের দোর্দণ্ড প্রতাপ।

পৃথিবী তখন দুটি বলয়ে বিভক্ত- একটি মার্কিন নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তি, অন্যটি সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত অক্ষশক্তি। ভারত ছিল সোভিয়েত বলয়ভুক্ত। এই অক্ষশক্তিটি রুশ-ভারত আন্তর্জাতিক অক্ষশক্তি হিসেবেই সমধিক পরিচিত ছিল। ভারত বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। সোভিয়েত ইউনিয়নও।

বঙ্গবন্ধুর খুনিরা রাজনৈতিক আশ্রয় এবং সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেল কোথায়? লিবিয়ায়। এখন লিবিয়া সম্পর্কে আমাদের একটু জানা দরকার। দুই ভাগে বিভক্ত পৃথিবীতে তখন লিবিয়া ছিল সোভিয়েতের ঘনিষ্ঠতম মিত্র। ভারতেরও। অর্থাৎ লিবিয়া ছিল রুশ-ভারত আন্তর্জাতিক অক্ষশক্তির বলয়ভুক্ত একটি দেশ।

কোথাও কর্নেল গাদ্দাফির ছায়া দেখা গেছে খবর পেলে সেখানে মার্কিনিরা বোমা ফেলেছে বলে শোনা যেত। ভারত-রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু দেশ বাংলাদেশের নেতাকে হত্যাকারীদের ভারত-রাশিয়ারই আরেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু দেশ লিবিয়ার আশ্রয় দেওয়ায় কারণ খোঁজার জন্য বেশি পেরেশানির বোধ হয় প্রয়োজন নেই। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরশাদের ক্ষমতাকে কর্নেল (অব.) ফারুকের বৈধতা দেওয়ার এবং শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগসহ তাদের মস্কোপন্থি মিত্রদের চুপ থেকে মৌনভাবে তাতে সম্মতি প্রদানের সমীকরণটা মেলাতে কী খুব কষ্ট হয়? বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, হত্যা মামলা ও কর্নেল (অব.) ফারুকদের ফাঁসির বিষয়টি একই গুরুর শিষ্যদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলেরই অপর এক রক্তাক্ত উপাখ্যান বলে মনে না করার কোনো সবল যুক্তি নেই। দুই. এর পর আমরা একেবারে ১৯৯৬ সালে চলে আসি। ওই বছর ১২ জুন অনুষ্ঠিত হয় সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি কেউ-ই সরকার গঠন করার মতো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ১৪৬ আসন, বিএনপি ১১৬, জাতীয় পার্টি ৩২, জামায়াত ৩, জাসদ (রব) ১, ইসলামী ঐক্যজোট ১ ও স্বতন্ত্র ১ আসন। ভোট পেয়েছিল আওয়ামী লীগ ৩৭.৫৩ শতাংশ, বিএনপি ৩৩.৮১ শতাংশ, জাতীয় পার্টি ১৫.৯৯ শতাংশ ও জামায়াতে ইসলামী ৮.১১ শতাংশ। জাসদ ও স্বতন্ত্র (স্বতন্ত্র এমপি লীগে যোগ দিয়েছিল) দুজনকে নিয়েও সরকার গঠনের জন্য ১৫১ হয় না, হয় ১৪৮ জন। অন্যদিকে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট মিলে হয় ১৫২ (১১৬+৩২+৩+১) জন।

খালেদা জিয়া কারাবন্দী এরশাদকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব পাঠান। এটা আমরা সবাই জানি। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এরশাদ নিজে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লোভনীয় প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে সমর্থন জানান এবং শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ করে দেন। কারও মনে কি এই প্রশ্ন জাগেনি যে, কেন এরশাদ শেখ হাসিনাকে সমর্থন জানালেন? নিশ্চয়ই জেগেছে। যে কারণে ১৯৮৬ সালে এরশাদের পাতানো নির্বাচনে ক্ষমতা পাবেন না জেনেও শেখ হাসিনা অংশ নিয়েছিলেন, যে কারণে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরশাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কর্নেল (অব.) ফারুককে শেখ হাসিনা মেনে নিয়েছিলেন, একই কারণে এরশাদ নিজে প্রধানমন্ত্রী না হয়ে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হতে সমর্থন জানিয়েছিলেন।

তিন. নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি যে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল, আমরা জানি সেই নির্বাচনে এরশাদ বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে মিলে নির্বাচন করার কথা ছিল। কিন্তু আবারও সবাইকে হতবাক করে দিয়ে এরশাদ পল্টি খান, চলে যান শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোটে। উল্লেখ্য, মহাজোটের শরিক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে কারসাজি করে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার পর মহাজোট সেই নির্বাচন থেকে সরে গিয়েছিল। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে এরশাদের পার্টি মহাজোটে থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে।

সমীকরণটা স্পষ্ট। দুজনকেই 'একই পীরের মুরিদ' বলে মনে হয় না!

এরশাদের এই ডিগবাজি দেশের বর্তমান অশান্ত ও অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে অনুকূল কোনো প্রভাব কি ফেলতে পেরেছে? মনে হয় না। বরং পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে, হিংসা আর হানাহানির দুর্বিষহ তথাকথিত রাজনীতির আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বলা চলে এতে শান্তির পায়রার প্রতি বিষাক্ত তীর ছোড়া হয়েছে। দেশ-বিদেশে সর্বত্র প্রত্যাশিত সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি অর্থবহ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী যে অনাকাঙ্ক্ষিত সংকট সৃষ্টি করেছে এরশাদের কথিত সর্বদলীয় সরকারে যোগদান তার কোনো সমাধান দিল না।

গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে তাতে সদ্য বিগত নির্বাচিত সরকারি দল ও বর্তমান প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ অপরিহার্য শর্ত। এরশাদের পার্টির 'সর্বদলীয়' সরকারে যোগদান এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত সেই শর্ত পূরণ করেনি। বরং প্রধান বিরোধী দল, জোট এবং তাদের মতো একই পন্থা অনুসরণকারীদের নির্বাচনের বাইরে রেখে এটা একটা পাতানো নির্বাচনের খেলা বলেই স্পষ্ট মনে হচ্ছে। একে সরকারি দল ও এরশাদের জাতীয় পার্টির মধ্যে গোপন অাঁতাতনির্ভর একটি পূর্বপরিকল্পিত, চক্রান্তমূলক ও অনাকাঙ্ক্ষিত তৎপরতা বলে চিত্রিত করা যেতে পারে। এর ফলে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি, ১৮-দলীয় জোট এবং আগামী নির্বাচন প্রশ্নে একই মনোভাবাপন্ন রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যেই শুধু নয়, শান্তির সুখস্বপ্ন দেখা দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যেও ক্রোধের সঞ্চার হওয়া স্বাভাবিক।

ধারণা করা অমূলক নয় যে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে-পরে একতরফা পাতানো নির্বাচনের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের সঙ্গে ব্যাপকহারে সাধারণ মানুষও মাঠে নেমে যেতে পারে- যে জনগণ বিরোধী দলের ডাকে সাড়া দিচ্ছে না বলে সরকার কলেরগান বাজিয়ে আসছিল। বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৮-দলীয় জোটের ২০ নেতা গত ১৯ নভেম্বর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি [সংবিধানের ৪৮(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী] রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে উদ্ভূত নির্বাচনকেন্দ্রিক কঠিন সংকট সমাধানে তার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ এবং সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেও বলা যায়, রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে দুই পক্ষকে তিনি বঙ্গভবনে ২-১ দিনের মধ্যে আমন্ত্রণ জানাতে পারতেন। এ জন্য তার সাংবিধানিক কোনো ক্ষমতার প্রয়োজন নেই।

সবাই জানেন তিনি আওয়ামী লীগের নেতা, আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পছন্দেই তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। জাতির প্রত্যাশা ছিল, তিনি আওয়ামী লীগ নেতার নয়, রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব ও ভূমিকাই পালন করবেন এই সংকটকালে। তাতে সারা জাতি তার প্রতি কৃতজ্ঞ হতো। মনে হচ্ছে বিরোধী দল তার ভূমিকায় হতাশ। হয় তিনি কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করছেন না, অথবা করতে পারছেন না।

এ অবস্থায় বিরোধী দলের কাছ থেকে 'সুবোধ বালকের' মতো আচরণ বা প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশা করা বোধহয় একটু বেশি আশা-ই হয়ে যায়।

২০ নভেম্বর নবম সংসদের ১৯তম অধিবেশন শেষ হয়েছে। বলা হয়েছে এই সংসদের এটি শেষ অধিবেশন। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন রাষ্ট্রপতি তাকে নির্বাচনকালীন সময়েও কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন এবং তিনিই প্রধানমন্ত্রী থাকছেন। বিরোধী দলকে তিনি তার সরকারে এসে মন্ত্রী হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

অর্থাৎ সংকট একই জায়গায় থাকল। বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে প্রয়োজনে সংবিধানে ছোটখাটো কিছু সংশোধনী এনে নির্বাচনকালীন একটি গ্রহণযোগ্য সরকার গঠনের সুযোগও বন্ধ হয়ে গেল সংসদ কার্যক্রম শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। যদিও সংসদ এখনো বলবৎ আছে, সরকার কোনো সদুদ্দেশ্য নিয়ে আবার সংসদ অধিবেশন আহ্বান করার উদ্যোগ নেবে বলে মনে হয় না। মনে হয়, সরকার এখানেও চতুরতার আশ্রয় নিয়েছে। বিরোধী দলের নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এখন বলবে সংসদ অধিবেশন শেষ, কাজেই সংবিধান সংশোধনের আর কোনো সুযোগ নেই।

বিরোধী দল কেন, জনগণও যে সরকারের এই অতিচালাকি বুঝছে না তা নয়। এরশাদকে গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা বানানোর দুরভিসন্ধিটাও যে সেই পঞ্চদশ সংশোধনী গ্রহণকাল থেকেই শুরু তা-ও এখন স্পষ্ট হয়ে এসেছে।

পঞ্চম জাতীয় সংসদেও এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিল। সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রায় একবছর আগে আওয়ামী লীগ, জামায়াত, জাপা ও তাদের সঙ্গীরা একযোগে সংসদ থেকে পদত্যাগ করায় সংসদ সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা হারায়। মেয়াদ শেষে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক শাসনের ধারাবাহিকতা রক্ষার কথা বলে তৎকালীন খালেদা জিয়ার সরকার ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একটা একদলীয় নির্বাচন করে নেয় আওয়ামী লীগ-জামায়াত-জাপার প্রচণ্ড প্রতিবন্ধকতা ও রক্তক্ষয়ের বিনিময়ে।

স্বল্পকালীন সেই ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে বিরোধী দল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাসে খালেদা জিয়ার সরকারকে বাধ্য করে। ১৯৯৬ সালের ২৫ মার্চ সেই বিল পাস হয় এবং ৩০ মার্চ তা কার্যকর হয়। পরিস্থিতি এবারও সেদিকে এগুচ্ছে বলেই মনে হয়। এরশাদের ডিগবাজির মাধ্যমে 'সর্বদলীয়' সরকারের নামে কার্যত মহাজোট সরকারের একটা বর্ধিত সংস্করণের মাধ্যমে সরকার একটি একপেশে পাতানো নির্বাচন করে ফেলতে বদ্ধপরিকর। নবম সংসদের শেষ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে তা একেবারেই স্পষ্ট।

তিনি বলেছেন, কেউ সেই নির্বাচন বানচাল করতে পারবে না। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, লীগ সরকার তার ভিশন-২০২১ কে সামনে রেখে একটি নীলনকশার নির্বাচনের মাধ্যমে আবার রাষ্ট্রক্ষমতা করায়ত্ত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। শেখ হাসিনা ও এরশাদের সমঝোতা বা পাতানো এই নির্বাচন বিপুলভাবে গণসমর্থিত বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল সহজে বা বিনা চ্যালেঞ্জে মেনে নেবে বলে মনে হয় না। অনুমান করা কঠিন নয় যে, ছিয়ানব্বইয়ের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টির, সংক্ষেপে বললে শেখ হাসিনার পদাঙ্কই অনুসরণ করতে পারে তারা। মানুষের মনে তাই আবার হানাহানি, হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্যের আতঙ্ক বাসা বেঁধেছে।

সবচেয়ে বেশি আতঙ্কের ব্যাপার হচ্ছে, সরকার যদি মানুষের রক্ত, মৃত্যু, ধ্বংসজ্ঞের তোয়াক্কা না করে যেনতেন প্রকারে একটা নির্বাচন করেও ফেলে তাতে সংকট আরও বেড়ে যাবে, আরও প্রাণহানি, জ্বালাও-পোড়াও-এর তাণ্ডব বেড়ে যাবে এবং এই ধরনের একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার যতদিন টিকে থাকবে ততদিনই এই অরাজকতা ও অশান্তি চলতেই থাকবে। সবকিছুর অবসান ঘটাতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কেননা তিনি সরকারের প্রধান। তার দায়িত্্বই অন্য সবার চেয়ে বেশি।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

ই-মেইল :kazi.shiraz@yahoo.com

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.