দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে উত্তপ্ত জোট-মহাজোটের বর্তমান রাজনীতি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট বেশ ভালোভাবে নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় এগুচ্ছে। মহাজোট নির্বাচনি এ প্রক্রিয়ায় বেশ সফলভাবে যাত্রা শুরু করলেও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট বেশ বেকায়দায় রয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। বিশেষ করে সরকারি দলের নানামুখী নির্বাচনি চাপ ও আকর্ষণীয় প্রস্তাবে ১৮ দলীয় জোটের শরিক অনেক প্রভাবশালী নেতাই বেশ টালমাটাল অবস্থায় রয়েছেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন যে কোনো নেতা ১৮ দল ছেড়ে সরকারের নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে পারেন।
এ নিয়ে উদ্বিগ্ন ও প্রচ- চাপে রয়েছেন স্বয়ং জোট নেতা খালেদা জিয়া। কারণ জরিপে দেখা যাচ্ছে নির্বাচন নিয়ে তৃণমূল নেতাদের ব্যাপক আগ্রহ থাকলেও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এখনো নির্দলীয় সরকারের দাবিতে অনড় রয়েছেন। ১৮ দলীয় জোট নেত্রী খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না চাইলেও জোটের অন্য শরিকরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার পক্ষে জোটবদ্ধ হওয়ার পরিকল্পনা করছেন। সম্প্রতি মহাজোট থেকে বেরিয়ে জাতীয়পার্টি চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ জোট গঠনের প্রক্রিয়া হিসেবে বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এদিকে সম্প্রতি নিবন্ধন পাওয়া বিএনএফ শহীদ জিয়ার আদর্শের কথা বলে তৃণমূলের নেতাদের তাদের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নিতে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
এরকম পরিস্থিতিতে তৃণমূলের নেতাদের ধরে রাখতে ও অন্যদিকে জোট রক্ষায় কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ঘরে-বাইরে নানামুখী চাপে রয়েছেন তিনি। সরকার যাতে দল ও জোট থেকে কোনো নেতাকে বাগিয়ে নিতে না পারে সে চেষ্টাও অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন জোট নেত্রী খালেদা জিয়া। একদিকে দল ও জোট নেতাদের ধরে রাখা অন্যদিকে নির্দলীয় সরকারের দাবি বেগবান করার আন্দোলন চূড়ান্ত অবস্থায় নিয়ে যেতে খালেদা জিয়া সতর্কতার সাথে পা ফেলছেন। খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠজনরা মনে করেন, সরকারের কৌশলের কাছে ন্যূনতম ভুল করলে বিএনপি এবং খালেদা জিয়ার ভবিষ্যত রাজনীতি হুমকির মুখে পড়তে পারে।
বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনকালীন সরকারের নতুন মন্ত্রীদের শপথ নেওয়ার পরদিন গত ১৯ নভেম্বর খালেদা জিয়া চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জোটের অবস্থান তুলে ধরতে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানেও খালেদা জিয়া নির্দলীয় সরকার প্রশ্নে অনঢ় অবস্থানের কথা জানান। রাষ্ট্রপতির কাছে খালেদা জিয়া অভিযোগ করে বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে চলমান
রাজনৈতিক সংকট সমাধানে সংলাপে বসতে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই চিঠির কোনো উত্তর পায়নি বিএনপি। এর জবাবে রাষ্ট্রপতি বেগম জিয়াকে এ বিষয়ে তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে কথা বলবেন বলে আশ্বস্ত করেন।
ক্ষমতাসীনরা বিএনপি এবং জোটের কিছু নেতা ও দলকে বাগিয়ে নিতে নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রী-উপদেষ্টা এবং আগামী নির্বাচনে চাহিদামাফিক আসনে প্রার্থী করার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে, খালেদা জিয়া বিভিন্ন সূত্রে এমন খবর জানার পর বঙ্গভবন থেকে ফিরেই ১৮ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গে গুলশানে তার রাজনৈতিক কার্যালয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকে খালেদা জিয়া জোট নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, এখন সরকারের নানা মহল থেকে আপনাদের কাছে নানা অফার আসবে। আপনারা সে অফার গ্রহণ করবেন কি না সেটা একদমই আপনাদের বিষয়। তবে এই অল্প সময়ের জন্য সরকারের সুযোগ গ্রহণ করে জাতীয় বেইমান না হওয়াই ভালো।
জোট নেতাদের খালেদা জিয়া আশ্বস্ত করেছেন, ১৮ দলীয় জোট ক্ষমতায় গেলে শরিক দলের শীর্ষ নেতাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে।
জবাবে জোট নেতারা খালেদা জিয়াকে আশ্বস্ত করেছেন, তারা কেউই তাকে ছেড়ে যাবেন না। তবে বৈঠকে এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল অলি আহমেদ (অব.), বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ এবং লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান খালেদা জিয়ার কাছে স্বীকার করেছেন, বিভিন্ন অফার দিয়ে সরকারের বিভিন্ন মহল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।
সূত্র মতে, গত ১৯ নভেম্বর দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এলডিপির মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য মাহমুদুর রহমান চৌধুরী এবং সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব শাহাদত হোসেন সেলিম বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ঘণ্টাব্যাপী চলা এই বৈঠকে এলডিপির এই প্রতিনিধি দল খালেদা জিয়াকে জানান, সরকার তাদের নির্বাচনকালীন সরকারে যাওয়ার জন্য অফার করেছে। এলডিপি যদি বর্তমান নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দেয়, তাহলে একজন মন্ত্রী, একজন উপদেষ্টা পাবেন।
আর আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শরিক হিসেবে ১২টি আসনে তাদের প্রার্থী থাকবে। এই অবস্থায়, তার দল ১৮ দলীয় জোটের সঙ্গে থাকতে চায়; সে ক্ষেত্রে তারা বিএনপির কাছে ১৫টি আসনের নিশ্চয়তা চায়। এ ছাড়া যেসব স্থানে বিএনপির সঙ্গে এলডিপির বিরোধ আছে, তা সমাধানে খালেদা জিয়ার হস্তক্ষেপ কামনা করেন এলডিপির নেতারা। এ বিষয়ে শাহাদত হোসেন সেলিম জানান, নানা চাপেও আমরা বিএনপির সঙ্গে আছি। সে ক্ষেত্রে ১৫টি আসন দাবি করা অযৌক্তিক নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
খালেদা জিয়ার আশ্বাসে এই তালিকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, দেশে চলমান রাজনৈতিক সংকট সামাল দিতে নিজেদের মধ্যে সব ধরনের মতভেদ দূর করে দলের কথিত সংস্কারপন্থিদের আরও কাছে টানার উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে গত ১৯ নভেম্বর রাতে রাজধানীর গুলশানে ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার বাসায় সংস্কারপন্থিদের সঙ্গে বৈঠক হয়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বৈঠকে অন্যদের মধ্যে যোগ দেন জহিরউদ্দিন স্বপন, জিয়াউল হক জিয়া, রেজাউল বারী ডিনা, শহিদুজ্জামান, নজির হোসেন, মফিকুল হাসান তৃপ্তি, শামিম কায়সার লিংকন। জানা গেছে, চলমান রাজনৈতিক সংকটের ফলে দলের মধ্যে সম্ভাব্য যে কোনো ধরনের ভাঙন ঠেকানোর পাশাপাশি এই দুঃসময়ে দলকে আরও শক্তিশালী করতে সংস্কারপন্থিদের দলে আরও সক্রিয় করতে চায় বিএনপি।
চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ইতোমধ্যেই দলের শীর্ষ নেতাদের এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনাও দিয়েছেন। নির্দেশনা পাওয়ার পরপরই দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতা এ ব্যাপারে এগিয়ে আসেন এবং সংস্কারপন্থিদের নিয়ে বৈঠকে বসেন।
জহির উদ্দিন স্বপন জানান, দলের দুঃসময়ে আমরা মহাসচিবের মাধ্যমে সক্রিয় হওয়ার আগ্রহ জানিয়েছি। এ বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে।
বিএনপি নেতাদের অনেকেই মনে করছেন, নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় আমির হোসেন আমু এবং তোফায়েল আহমেদকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে যেভাবে সংস্কার বিষয়টিকে আওয়ামী লীগ মুছে দিয়েছেন, বিএনপিরও সে রকম পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য স্বদেশ খবরকে বলেন, সংকটময় সময়ে যারা দলে ভাঙন তৈরি করেছিল সেই সংস্কারপন্থিদের দলের মধ্যে এতটা গুরুত্ব দেওয়ার কোনো মানে হয় না। বরং এটি দলের অন্য নেতাকর্মীদের কাছে একটি ভুল বার্তা পৌঁছাবে এবং এটা দলের জন্য সুখকর কোনো কিছু নাও হতে পারে। তিনি আরও বলেন, বর্তমান মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে যারা এতদিন ধরে আন্দোলন করে জেল-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তারা হয়তো নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি। তাঁর মতে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এসব নেতাদের অনেক আগেই ক্ষমা করেছিলেন। তারপরও তাদের নিজের এলাকা এবং দলের কেন্দ্রীয় অফিসে আসতে দেখা যায়নি।
বরং তারা দলের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থেকেছে।
চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ‘হস্তক্ষেপ’ চেয়েও আশান্বিত হতে পারেনি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। রাষ্ট্রপতির কাছে প্রত্যাশা অনুযায়ী সাড়া না পাওয়ায় লাগাতার কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন বিরোধী জোটের শীর্ষ স্থানীয় নেতারা। তবে পরিস্থিতি আরও দুএকদিন পর্যবেক্ষণ করে করণীয় নির্ধারণ করতে চায় তারা। দলের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে বিরোধী জোট।
টানা হরতাল ও অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি আসতে পারে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। তবে জোটের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া সরকার বিরোধী আন্দোলন কর্মসূচিতে দল ও জোটের শীর্ষ নেতাদের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালনে বেশ ক্ষুব্ধ ও হতাশ। শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মাঝে মধ্যে খালেদা জিয়া শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের হুঙ্কার দিলেও পরবর্তীতে দল ও জোটের আশু ভাঙন ঠেকাতে নমনীয়তা প্রদর্শন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এমতাবস্থায়, অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা-কর্মীরা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।