আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাংবাদিকতা : পেশার চ্যালেঞ্জ ও চ্যালেঞ্জের পেশা

জামাতীরা ধর্মের শত্রু, বি. এন. পি.-আওয়ামীলীগ জাতির শত্রু সাংবাদিকতার জগতটি গত এক যুগে অনেক প্রসারিত হয়েছে। সংবাদপত্রের পাশাপাশি নতুন নতুন মিডিয়া বিশেষ করে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল, এফএম রেডিও এবং সর্বশেষ ইন্টারনেট- বাংলাদেশে এই পেশার অনেক সম্ভাবনা তৈরি করেছে। আজকাল শিশু-কিশোরদের অনেকেই ভবিষ্যতে সাংবাদিক হতে চায় এমন আকাঙ্খার কথা অল্প বয়সেই প্রকাশ করে। এখন দেশের একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গণ-যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ আছে। এমনকি কমপক্ষে অর্ধ-ডজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন এই বিষয় পড়ানো হচ্ছে।

অর্থাৎ পেশার সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় সুনির্দিষ্ট বিষয় পাঠের ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। পেশার সম্মান, মর্যাদা বেড়েছে। সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে চ্যালেঞ্জ। কিন্তু প্রয়োজনীয় পেশাদারিত্ব কি বেড়েছে ব্যক্তি সাংবাদিকের? কর্মরত সাংবাদিকদের পেশাদারিত্ব নিয়ে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের আলোচনায় এখন বেশ হা-হুতাশ শুনতে পাওয়া যায়।

যে কোনো পেশার জন্যই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আমলা বা অন্য যে কোনো পেশার কেউ যথেষ্ট দক্ষ-যোগ্য, সৎ ও দলনিরপেক্ষ না হলে সাংবাদিকরা তাদের নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কিন্তু সাংবাদিকদের কতোজন ওইসব গুনের অধিকারী? বিশেষ করে এখনকার সময়ে; যখন অন্য সব পেশার মতো সাংবাদিকতাতেও অযোগ্য, অদক্ষ, অসৎ এবং দলবাজদের জয়-জয়াকার দেখা যায়। পেশাদারিত্বের বিষয়টি পেশার প্রতি সৎ ও আন্তরিক থাকা এবং যোগ্যতা ও দক্ষতার একটা মান অর্জনের সঙ্গে জড়িত। আজকের সাংবাদিকতার জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জও এটাই।

সাংবাদিকতা পেশায় সম্মান, সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি ‘গ্ল্যামার’ যুক্ত হয়েছে গত এক যুগে। ইলেকট্রনিক মাধ্যমের কল্যাণে এখন একজন সাংবাদিক দ্রুতই দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে পরিচিতি পেয়ে যাচ্ছেন। তারকার মর্যাদা পাচ্ছেন। নবীন অনেককে পেশার এই ‘গ্ল্যামার’ও আকৃষ্ট করছে। একজন ভালো ও পেশাদার সাংবাদিক হওয়ার জন্য কি কি প্রয়োজন? আজকের প্রতিষ্ঠিত ও সম্মানিত সাংবাদিকদের অনেকেই বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশুনা করে এসেছেন।

ভালো সাংবাদিক হওয়ার জন্য সাংবাদিকতাই পড়তে হবে এমনটা জরুরি নয়। তবে বিষয়টি পড়া থাকলে একজনকে ভালো সাংবাদিক হতে তা অবশ্যই সাহায্য করে। সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমগুলো এই বিভাগের শিক্ষার্থীদের পেশায় নিয়োগ দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। এক্ষেত্রে সাংবাদিকতা বিভাগের পাঠ্যসূচি নিয়ে কিছু কথা বলতেই হয়। সাংবাদিকদের ‘সব কাজের কাজী’ হতে হয়।

অর্থাৎ অনেক বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান থাকা একজন সাংবাদিকের জন্য জরুরি। সেটা খেলা, অর্থনীতি ও বাণিজ্য, আইন-আদালত, সংবিধান, জ্বালানির মতো বিষয় হতে পারে। দেখা যায়, বার্তা কক্ষে যারা প্রথম কাজ শুরু করেন- তাদের বেশির ভাগ এমনকি খ্যাতিমান ব্যক্তির নামের বানান পর্যন্ত জানেন না। দলে রাজনীতিবিদদের পদ-পদবী সম্পর্কেও অবহিত নন। এইরকম মৌলিক এবং প্রতিদিনের কাজের জন্য জরুরি বিষয় নিয়েও তাদের বার্তা কক্ষে ঢুকে হিমশিম খেতে হয়! বিষয়গুলো কি পড়াশুনার সময়ই সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীদের শেখানোর ব্যবস্থা করা যায় না? সাংবাদিকদের মধ্যে সবসময়ই দুটো ধরণ দেখা যায়।

একদল একে চাকরি হিসাবে নেন। নির্দিষ্ট সময়ের বেশি পেশায় দেন না। ছকবাধা কাজে অভ্যস্ত এবং এতেই তারা স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। এই শ্রেনীর সাংবাদিকরা পেশায় শেষ পর্যন্ত ভালো করতে পারেন না। আরেক দল আছেন, যারা পেশাকে নেশা হিসেবে নেন।

বহুমুখী কাজ করতে আগ্রহী। সময় ধরে নয়, কাজের প্রয়োজনে যতোটা দরকার পেশায় ততোটাই সময় দেন। এই ধরণের সাংবাদিকদের নিয়ে কাজ করতে যে কোনো পেশাদার গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানও আগ্রহী হয়। পেশাদারিত্ব অর্জনের জন্য একজন সাংবাদিকের দেশ-বিদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখাটা জরুরি। নিয়মিত দেশ-বিদেশের সংবাদপত্র পড়া, টেলিভিশনের নিউজ চ্যানেলগুলো অনুসরণ করা, ইন্টারনেটে খবর ও সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর দিকে নজর রাখা ভালো সাংবাদিক হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

অনেক প্রতিবেদককে দেখা যায়, নিজের নির্দিষ্ট বিটের বাইরে অন্য বিষয় নিয়ে পড়াশুনা তো দূরের কথা, খোঁজ-খবরও রাখেন না। রাজনৈতিক প্রতিবেদক অর্থনীতির ব্যাপারে আগ্রহ দেখান না। অর্থনৈতিক প্রতিবেদক রাজনীতির অগ্রগতি সম্পর্কে জানেন না। আদালত রিপোর্টিং অনেকের কাছে আতঙ্কের বিষয় মনে হয়। আধা-নিশ্চিত তথ্য প্রকাশের লোভ অনেকেই সামলাতে পারেন না।

অথচ একজন ভালো সাংবাদিকের নীতি হওয়া উচিত, তিনি জানবেন বেশি, লিখবেন সতর্কভাবে; ঠিক যতোটুকু তিনি নিশ্চিতভাবেই প্রমাণ করতে পারেন। সাংবাদিকতায় পেশাদারিত্ব অর্জনের জন্য ঘটনার নেপথ্যেও খবর জানা, বিশ্লেষনের ক্ষমতা খুবই জরুরি। সংবাদসূত্র অনেক সময় উদ্দেশ্য-প্রণোদিতভাবে সাংবাদিককে ভুলপথে নিয়ে যান। ঘটনা পরম্পরা বিশ্লেষণ করে, নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠি বা ব্যক্তির অতীত আচরণ জেনে-বুঝে সাংবাদিককে প্রাথমিকভাবে নিজের বিশ্লেষণ দাঁড় করাতে হয়। তারপর তাকে কাজে এগোতে হয়।

অনেক সময় চটকদার খবরের লোভ সামলাতে পারেন না সাংবাদিকেরা। বার্তা কক্ষেও এ ধরণের সংবাদ আকর্ষনীয় মনে হয়। কিন্তু কিছুদিন পরই হয়তো দেখা যায়, পুরো খবরটাই ছিল একটা ধাপ্পা। একজন পেশাদার সাংবাদিক চটকদার খবরের পেছন ছোটেন না। জনপ্রিয়তা অর্জন তার লক্ষ্য হয় না।

বরং অনুসন্ধানী, বিশ্লেষণাত্মক মনোভাব এবং দলনিরপেক্ষ ও স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গী একজন পেশাদার সাংবাদিককে জনপ্রিয় করে তোলে। দুনিয়া নাড়া দেওয়া “ওয়াটারগেট কেলেংকারি”র খবর প্রকাশ করে ‘ওয়াশিংটন পোস্টে’র দুই সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড ও কার্ল বার্নস্টেইন বিশ্বখ্যাত ও জনপ্রিয় হয়েছিলেন। যে সময় তারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের ওই কেলেংকারির খবরের পেছনে ছোটা শুরু করেছিলেন, তখন তারা ছিলেন মাত্র বিশ পেরোনো দুই যুবক। ১৯৭২ সালের ১৮ জুন ‘ওয়াশিংটন পোস্টে’র প্রথম পাতার নিচের দিকে “Five Held in Plot to Bug Democratic Offices Here” শিরোনামে ছোট্ট যে খবরটি প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল, দুই বছরের ধারাবাহিক অনুসন্ধান শেষে সেই খবর মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে একটা অধ্যায় শেষ করেছিল। এই দুই যুবকের কাজ আজো যে কোনো পেশাদার সাংবাদিকের জন্য ঈর্ষনীয় সাফল্যের নজির হিসাবে বিবেচিত হয়।

বাংলাদেশেও এরকম অনুসন্ধানী কাজ নিকট অতীতে হয়েছে এবং এখন হচ্ছে। “ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ” নিয়ে প্রথম আলো এবং পত্রিকাটির বর্তমান বিশেষ প্রতিনিধি টিপু সুলতানের অনুসন্ধান; একজন জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা নিয়ে চার বছর অনুসন্ধান শেষে একই প্রতিবেদকের সম্প্রতি প্রকাশিত নাড়া দেওয়া প্রতিবেদন- এদেশে পেশাদার সাংবাদিকের কাজের উদাহরণ হতে পারে। একজন সাংবাদিককে পাঠক বা দর্শক-শ্রোতার আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করতে হয়। এ কারণে তাকে কষ্ট করতে হয়, পেশায় দক্ষতা দেখাতে হয়। আজ বাংলাদেশে যে “মিডিয়া বুম” চলছে, সেখানে আমরা এইরকম পেশাদার সাংবাদিক খুঁজে পাই না।

সাংবাদিকতা পেশায় এখন যারা আসছেন তাদের বড় অংশই দ্রুত সাফল্য আর তারকাখ্যাতি চান। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখছি, সাংবাদিকতা শুরু করার মাত্র দুই বা আড়াই বছরের মধ্যে তিন-চারটি প্রতিষ্ঠান বদলে একজন সাংবাদিক সহজেই ২৫ বা ৩০ হাজার টাকা বেতন-ভাতা পেয়ে যাচ্ছেন। “মিডিয়া বুমে”র বিপরীতে সাংবাদিকের স্বল্পতায় এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটা ছোটো অর্থনীতিতে ১০/১৫টি জাতীয় সংবাদপত্র, ১২/১৩টি টেলিভিশন চ্যানেল, ৪টি এফএম রেডিও স্টেশন এবং কয়েকটি ওয়েব সংবাদপত্র অর্থনৈতিকভাবে টেকসই হবে কিনা, দীর্ঘমেয়াদে এসব গণমাধ্যম সাংবাদিক-কর্মীদের সম্মানজনক হারে বেতন-ভাতা দিয়ে যেতে পারবে কিনা, সে বিবেচনাটা কারো মধ্যেই থাকে না। আপাতত নগদ পাওনাটা তাদের কাছে মূখ্য হয়ে ওঠে।

আজকের সাংবাদিকতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ এখন এসবই। মেধাবীরা এখনও সাংবাদিকতায় আসছেন কম। পেশাদার, স্বাধীন মিডিয়ার অভাব এখনো প্রকট। নিজের অন্যায় ব্যবসাকে সুরক্ষা দিতে এবং সমাজে আরো প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন করতে অধিকাংশ উদ্যোক্তা মিডিয়া মালিক হচ্ছেন। এই উদ্যোক্তারা স্বাধীন গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় বিপদ।

তারা প্রতি পদে পদে স্বাধীন ও দলনিরপেক্ষ সাংবাদিকতায় হস্তক্ষেপ করেন। আর রাজনৈতিক মতাদর্শে ও নগদ পাওনার লোভে বিভক্ত সাংবাদিকরা সহজেই এইসব উদ্যোক্তার শিকারে পরিণত হচ্ছেন। দলীয় সরকারের বিলিয়ে দেওয়া সুযোগ-সুবিধা নিলে একজন সাংবাদিককে বারবার আনুগত্যের প্রমাণ দিতে হয়। গণমাধ্যমের অসৎ উদ্যোক্তার অবৈধ কাজের হাতিয়ার হতে অবাধ্য ক’জন সাংবাদিক এ পর্যন্ত চাকরি ছেড়েছেন? হিসাব মেলানো কঠিন। তারপরও পেশাদারিত্ব অর্জনের জন্য এখনকার কোনো কোনো সাংবাদিকের আকাঙ্খা আশান্বিত করে।

লোভের কাছে নতজানু না হওয়া, অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করা, পেশার প্রতি সৎ থাকা আর নিজের যোগ্যতা ধারাবাহিকভাবে বাড়িয়ে চলাটাই পেশাদারিত্ব অর্জনের মূলকথা। সাংবাদিকতা পেশায় এতোসব নোংরা জঞ্জালের মধ্যে এখনো অনেকে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছেন। সেইসব সাংবাদিকের জন্য শুভকামনা। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.