ডিঙিয়ে যাবো যত অন্ধকূপ
পৃথিবীর আকার আকৃতি সম্পর্কে মানবজাতির আগ্রহ ও ধারণা বেশি দিনের নয়। পৃথিবীটা যে গোলাকার শুধুমাত্র এই ধারণায় পৌছাতেই আমাদের সহস্র বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। প্রায় ২৪00 বছর আগে(৩৪০ খ্রীঃপূঃ) গ্রীক বিজ্ঞানী অ্যারিস্টটল তার বই ‘অন দ্য হ্যাভেন’ –এ গোলাকার পৃথিবীর স্বপক্ষে দুটি ভাল বিতর্কের সূচনা করেন। প্রথমত, তিনি উপলব্ধি করেন যে, সূ্র্য ও চাঁদের মাঝে পৃথিবী চলে এলে চন্দ্রগ্রহন ঘটে। চাঁদের উপর পৃথিবীর ছায়া সবসময়ই বৃত্তাকার দেখা যায়।
এটা শুধুমাত্র পৃথিবীটা গোলাকার হলেই সম্ভব। পৃথিবীটা থালার মত চ্যাপ্টা হলে, ছায়াটি রেখার মত কিংবা উপবৃত্তাকার হত।
দ্বিতিয়ত, গ্রীকরা তাদের ভ্রমন থেকে জেনেছিল যে, উত্তর থেকে দক্ষিণে গেলে ধ্রুবতারার অবস্থান দিগন্তের দিকে নিচে নামতে থাকে- গোলাকার পৃথিবীকে মেনে নিলেই কেবল এর ব্যাখ্যা দেয়া যায়। এছাড়াও মিশর এবং গ্রীস থেকে ধ্রুবতারার অবস্থান পরিমাপ করে অ্যারিস্টটল পৃথিবীর পরিধি নির্ণয় করেন, যা আধুনিক হিসেবের প্রায় দ্বিগুণ ছিল।
গোলাকার পৃথিবীর স্বপক্ষে গ্রীকদের আরেকটি বিতর্ক ছিল- দিগন্তের কাছ থেকে আসা কোন জাহাজের মাস্তুলের আগে পাল দেখতে পাওয়া।
আমরা যে সময়ের কথা বলছি তখনও দূরবীণ আবিস্কৃত হয়নি, তখনকার মানুষ খালি চোখেই আকাশ পর্যবেক্ষণ করত। স্বাভাবিকভাবেই অ্যারিস্টটল চিন্তা করতেন যে, পৃথিবী স্থির এবং সূ্র্য, চাঁদ, গ্রহ-নক্ষত্রগুলো পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরে বেড়ায়। অ্যরিস্টটলের পর থেকে বিজ্ঞানের বন্ধ্যাকাল চলতে থাকে, মহাকাশ বিজ্ঞানের গবেষণা থেমে যায়।
এরও প্রায় ৪৫০ বছর পর, ঈসা(আঃ)–এর তথাকথিত মৃত্যুর ১০০ বছর পরে বিজ্ঞানী টলেমি অ্যারিস্টটলের ধারণাকে আরও বিস্তৃত করেন। তিনিই প্রথম বিশ্বতত্তের পূর্ণ মডেল দাড় করান।
সেই মডেলের কেন্দ্র ছিল পৃথিবী এবং তার চারপাশে ঘুর্ণায়মান আটটি গোলক- চন্দ্র, সূ্র্য, তারকা, আর সেসময় পর্যন্ত জানা পাঁচটি গ্রহ- বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনি। তিনি গ্রহগুলোর চলার পথকে বৃত্তাকার হিসেবে উল্লেখ করেন। যদিওেএতে তার কিছু সংশয় ছিল, কেননা কখনও কখনও পৃথিবী থেকে চাঁদকে দ্বিগুণ বড় দেখা যায়। এর অর্থ চাঁদটি কখনও পৃথিবীর নিকটে চলে আসে, আবার কখনও দূরে চলে যায়। তাহলে চাঁদের চলার পথটি বৃত্তাকার হয় কি করে! যাইহোক সেসময়ের খ্রীষ্টানরা টলেমির মডেলটি গ্রহন করেছিল এই ভেবে যে, এই মডেলে তাদের ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত জান্নাত ও জাহান্নামের জন্য পৃথিবীর বাইরে যথেষ্ট স্থান রয়েছে।
পরবর্তি ১৪০০ বছর টলেমিয় ধারণার তেমন কোন পরিবর্তনই ঘটেনি। ১৫১৪ সালে পোল্যান্ডের খ্রিষ্টীয় ধর্মযাজক নিকোলাস কোপারনিকাস এত বছর ধরে চলে আসা প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধে মত প্রদান করেন। অভিযুক্ত হওয়ার ভয়ে তিনি ছদ্মনামে নতুন একটি মডেল প্রকাশ করেন। তার মতে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে নয় বরং সূ্র্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহগুলো ঘুর্ণায়মান। কোপারনিকাসের জন্য দুঃখজনক যে, জীবদ্বশায় মানুষের কাছে অগ্রাহ্য হলেও এক শতাব্দী পরে তার মতকে গুরুত্বের সাথে নেয়া হয়।
অ্যারিস্টটল ও টলেমিয় ধারণার পরিপূর্ণ মৃত্যু ঘটে ১৬০৯ সালে, যখন গ্যালিলিও তার তৈরি দূরবীন দিয়ে রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেন।
ইটালিয়ান বিজ্ঞানী গ্যালিলিও দূরবীন দিয়ে বৃহস্পতি গ্রহের দিকে তাকিয়ে দেখেন যে, কতগুলো ছোট উপগ্রহ বা চাঁদ এর চারপাশে ঘুর্ণায়মান। এর মানে, অ্যারিস্টটল এবং টলেমির ধারণা এক্ষেত্রে ভূল। কারন তাদের মতে সব কিছুই পৃথিবীর চারপাশে ঘুর্ণায়মান থাকার কথা। এদিক থেকে কোপারনিকাসের মতবাদ মেনে নেয়াটা সহজতর।
একই সময়ে জার্মান বিজ্ঞানী কেপলার কোপারনিকাসের তত্ত্বটিকে বিস্তৃত করেন। তিনি বৃত্তাকার কক্ষপথের পরিবর্তে উপবৃত্তাকার পথের প্রস্তাব করেন। যদিও তিনি যানতেননা যে কি কারনে পথটি উপবৃত্তাকার, যেখানে বৃত্তাকার পথটিই সরল মনে হওয়ার কথা। তিনি শুধু দেখেছিলেন যে, উপবৃত্তাকার পথের সাথে বাস্তব পর্যবেক্ষণ মিলে যায়। উল্লেখ যে, চাঁদের আকার ছোট বা বড় হওয়াটা উপবৃত্তাকার পথের প্রমান দেয়।
পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে সূ্র্যকেন্দ্রিক উপবৃত্তাকার পথের ধারণা মেনে নিলেও পৃথিবীর মানুষ কিন্তু তখনও জানেনা গ্রহগুলো কোন শক্তিবলে ঘুরছে। এ প্রশ্নের জবাব দিতেই যেন নিউটনের আবির্ভাব ঘটে। ১৬৮৭ সালে তার রচিত ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা ন্যাচারালিস কসেস’ পদার্থবিজ্ঞানের জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ একক কাজ হিসেবে বিবেচিত। এ বইটিতে তিনি প্রতিটি বস্তুর সাথে অপর বস্তুর আকর্ষণের কথা উল্লেখ করেন, যা বস্তুর ভরের সাথে বৃদ্ধি পায় আর দূরত্ব বৃদ্ধির সাথে হ্রাস পায়। পাশাপাশি তিনি এ সূত্রটিকে গানিতিকভাবেও বিশ্বের কাছে উপস্থিত করেন।
যার হাত ধরে একসময় মানুষ একসময় জানতে পারে গ্রহগুলোর ঘুর্ণনের কারণ এবং উপবৃত্তাকার পথের যৌক্তিকতা। মানবজাতির চোখের সামনে স্পষ্ট হতে থাকে এক নতুন কিন্তু বাস্তব জগতের ছবি, যেখানে অস্পষ্ট ধারণা ও কুসংস্কার নয়, বরং স্পষ্টতা ও যৌক্তিকতার আলোকে বিশ্বাস তৈরি হয়। নিউটনের পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ৩৫০ বছরে জ্যোতি পদার্থবিজ্ঞানের বহু চমক পৃথিবীবাসি দেখতে পেয়েছে। এই ইতিহাস অন্য কোন দিন লেখার প্রয়াস থাকবে। আজ এ পর্যন্তই।
সূত্রঃ
*দ্য থিওরি অফ এভরিথিং-স্টিফেন হকিং
*বাংলাদেশ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্য পদার্থবিজ্ঞান
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।