অস্থিতিশীল সংঘাতময় রাজনীতির কারণে লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়েছে দেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থা। শিশু শ্রেণী থেকে উচ্চশিক্ষার সব শিডিউল ভেঙে পড়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বার্ষিক পরীক্ষার মৌসুমে কোনো বিদ্যালয় পরীক্ষা নিতে পারছে না। বার বার পরীক্ষার তারিখ পিছিয়েও লাভ হচ্ছে না। টানা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির কারণে ছুটির দিনেও পরীক্ষা দিতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছুটির মধ্যে পরীক্ষা দিতে বের হলে ককটেল-বোমার আঘাতে আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ফলে নিরাপত্তাহীনতায় সারা দেশে প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তায় পড়েছে। অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন পুরো এক বছর পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে, এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর প্রায় চার মাস ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার আশায় দিন গুনেছে প্রায় সাড়ে সাত লাখ শিক্ষার্থী। অপেক্ষার পর যখন ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারিত হলো, তখনই টানা অবরোধ কর্মসূচি। ফলে একের পর এক স্থগিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ১২ লাখ শিক্ষার্থী আগে থেকেই দু-তিন বছরের সেশনজটে আটকা পড়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যখন বিভিন্ন কৌশলে এ সেশনজট কমানোর চেষ্টা করছে, ঠিক তখনই টানা অবরোধে একের পর এক পরীক্ষা স্থগিত করতে হচ্ছে। পরীক্ষার নতুন কোনো তারিখও নির্ধারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। হরতাল-অবরোধে শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও সেশনজট বাড়বে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। জানা গেছে, সারা দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে তিন কোটি ৭০ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। এর বাইরে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে আরও প্রায় ৩০ লাখ শিক্ষার্থী। এখন চলছে পরীক্ষার মৌসুম। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি পরীক্ষাও চলছে। কিন্তু হরতাল-অবরোধের কারণে সময়সূচি অনুযায়ী পরীক্ষা শেষ হচ্ছে না। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে নিয়মিত ক্লাস। ২০ নভেম্বর থেকে শুরু হয় দেশের সবচেয়ে বড় পাবলিক পরীক্ষা প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা। আগের সময়সূচি অনুযায়ী ২৯ নভেম্বর পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বিরোধী দলের অবরোধের কারণে কয়েক দফা পরীক্ষা পেছানো হয়। এর আগে ৪ নভেম্বর শুরু হয়ে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেটের (জেএসসি) ১১টি বিষয়ের পরীক্ষার মধ্যে ৬টিই পেছাতে হয়েছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের চলমান বার্ষিক পরীক্ষাও পিছিয়ে যাচ্ছে। আবার অনেক বিদ্যালয় আগে থেকে কোনো ঘোষণা না দেওয়ায় শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা পড়েছেন বিপাকে। অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশন ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষা শেষ করতে বলায় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও ঠিক সময়ে পরীক্ষা শেষ করা নিয়ে চিন্তায় পড়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনিতেই সেশনজট বিদ্যমান। এর মধ্যে বার বার পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ায় প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন আরও অনিশ্চয়তায় পড়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিভিন্ন পরীক্ষা হরতাল-অবরোধে পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। রাজশাহী ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাও পেছানো হয়। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির 'ফল সেমিস্টারের' বিভিন্ন বিভাগের মিডটার্ম পরীক্ষা অনিবার্য কারণে স্থগিত করা হয়েছে। এ পরীক্ষার সময় পরে জানানো হবে। সংঘাতময় রাজনীতির বলি হয়ে শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, রাষ্ট্রের বিভিন্ন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষতি হলেও তা হয়তো পূরণ করা যাবে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে একটি বছর ঝরে গেলে তা আর কখনো ফিরিয়ে আনা যাবে না।
গত সোমবার অবরোধের মধ্যে পরীক্ষা দিতে এসে মারাত্দক আহত হয়েছে চট্টগ্রামের স্কুলছাত্রী সুমাইয়া আক্তার সাদিয়া। ওই দিন চট্টগ্রামের পাহাড়তলী এলাকায় নার্সারি শ্রেণীর পরীক্ষা দিতে এসে ককটেলের আঘাতে সাদিয়ার কপাল ফেটে যায়। এমন ঘটনা সারা দেশের শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের ফেলেছে আরও দুশ্চিন্তায়। এ অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে বাইরে বের হলেই জীবননাশের শঙ্কা! শিক্ষার্থীদের বিবেচনায় নিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এখন সমস্যা পুরো দেশের। সমস্যা সবার। তবে শিক্ষার্থীদের সমস্যা একটু বেশি। তাদের এখন পরীক্ষার সময়। তারা আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ। তাদের পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে। এ ক্ষতিটা বড় রকমের। দেশের ভবিষ্যতের ক্ষতি। আমাদের রাজনীতিবিদরা দেশের জন্য নন ক্ষমতার জন্যই রাজনীতি করেন। এ রাজনীতি দেশের জন্য অসম্ভব ক্ষতিকারক। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, দেশের যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে এ সংঘাত স্বল্পমেয়াদি হবে বলে মনে হয় না। তাই সবার প্রতি অনুরোধ, অন্তত পরীক্ষাগুলো যেন রাজনৈতিক কর্মসূচির বাইরে রাখা হয়। অধ্যাপক সৈয়দ মন্জুরুল ইসলাম বলেন, ক্ষমতার জন্য রাজনীতি আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে না। দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ স্বপ্ন দেখে তাদের সন্তানকে অন্তত পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষ করবে। গরিব বাবা মেয়ের ভর্তি পরীক্ষার সময় রাত জেগে হোটেলে পাহারা দেয় নিরাপত্তার জন্য। কিন্তু রাজনীতিবিদদের চেতনাবোধ ফিরে আসে না, হরতাল-অবরোধ দিয়ে লাখো বাবা-মায়ের স্বপ্ন ভাঙতে। এখন পরীক্ষার সময় রাজনীতিবিদদের বিষয়টি ভাবা উচিত।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।