হরতাল-অবরোধে মৃত্যু মিছিল থামছেই না। গতকালও নওগাঁর রানীনগরে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সংঘর্ষে এক জামায়াত কর্মী নিহত হয়েছেন। নিহতের নাম শুকবর আলী (৬০)। হরতাল
অবরোধকারীদের হামলা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। রাজশাহীতে মতিহার থানার ওসির শটগান কেড়ে নিয়ে তার পা ও হাতের আঙ্গুল ভেঙে দিয়েছে জামায়াত ও শিবির। এ হামলায় আরও পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে। গতকাল নগরীর বিনোদপুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। গত মাসে ১৮ দলীয় জোটের প্রথম দুই দফার অবরোধে প্রাণ হারান ৫৫ জন। গত সপ্তাহে দ্বিতীয় দফার টানা ১৩১ ঘণ্টা অবরোধে আহত দুজন পরে মারা যান। শনিবার ভোর ছয়টা থেকে শুরু হওয়া তৃতীয় দফার অবরোধে রবিবার সুনামগঞ্জে সংঘর্ষে ছাত্রলীগের এক কর্মী নিহত হন। গত পরশু নিহত হন এক শিশুসহ দুইজন। গতকাল একজন। তফসিল ঘোষণার সব মিলিয়ে অবরোধে এ পর্যন্ত প্রাণ হারালেন মোট ৬১ জন।
গতকাল বিরোধী জোটের ডাকা অবরোধ ও হরতালে রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় মিছিল ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় একজনকে আটক করেছে পুলিশ। এদিকে জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামী গতকাল দ্বিতীয় দিনের মতো সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করেছে। গতকাল সকালে খিলগাঁওয়ের সিপাহিবাগে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা মিছিল বের করেন। এ সময় তারা ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করেন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ এলে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা পালিয়ে যান। ঘটনাস্থল থেকে একজনকে আটক করে পুলিশ। সকালে আজিমপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। রাজধানীতে প্রচুর রিকশা, অটোরিকশা এবং বেশ কিছু গণপরিবহন ও গাড়ি চলাচল করছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে। এ ছাড়া সারা দেশে সড়ক ও রেলপথে অগি্নসংযোগ, সড়কে গাছ ফেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে অবরোধ পালন করেছে ১৮ দলের নেতা-কর্মীরা। বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে অবরোধ-হরতালকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। পুলিশ প্রায় ৩০ জন পিকেটারকে আটক করেছে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে নাশকতার অভিযোগে ছাত্রদল ও শিবিরের বেশকিছু নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :
নওগাঁয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংঘর্ষে জামায়াত কর্মী নিহত : উপজেলা জামায়াতের ডাকে অর্ধদিবস হরতাল চলাকালে সকালে আবাদপুকুর মোড়ে জামায়াতের একটি মিছিল থেকে একটি ট্রাক্টরে হামলা চালানো হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা এগিয়ে আসে। উভয় দলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় আওয়ামী লীগের লোকজন একজন সাংবাদিকের মোটরসাইকেল, ৩টি ভটভটি, ১টি ট্রাক্টর ও ৭টি দোকান ভাঙচুর করে। আর সংঘর্ষে আওয়ামী লীগ সমর্থক হেলাল উদ্দীন, বেলাল মণ্ডল, রবিউল ইসলাম, রঞ্জ মণ্ডল, সাহাদ আলী, আবদুল ওহাব, রুহুল আমিন মণ্ডল, শাজাহান প্রামানিক ও আবদুল করিম আহত হয়। অপরদিকে জামায়াত-শিবিরের দুলাল হোসেন, মোজাহার আলী, সবুজ আলী, হাসান আলী, নুর ইসলাম, তোজাম্মেল হক ও শুকবর আলীসহ (৬০) আরও কয়েকজন আহত হন। আহতদের মধ্যে গুরুতর শুকবর আলীকে প্রথমে নওগাঁ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে বিকালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। রানীনগর থানার ওসি আবদুল্লা-আল-মাউসুদ চৌধুরী ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, আওয়ামী লীগ সমর্থিত ব্যবসায়ীদের প্রতিরোধের মুখে জামায়াত-শিবির কর্মীরা পালিয়ে গেলে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে। ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
রাজশাহীতে পিটিয়ে ওসির পা ভাঙল জামায়াত-শিবির : সকাল ৮টার দিকে নগরের বিনোদপুর এলাকায় শিবিরের কর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে মিছিল বের করে। এর আগে থেকেই নগরের মতিহার থানার ওসি আবদুল মজিদসহ পুলিশের সাতজন সদস্য তাদের পিকআপ ভ্যান নিয়ে সড়কের উত্তর পাশে কদমতলায় অবস্থান করছিলেন। এক পর্যায়ে পুলিশের তিনজন সদস্য পাশের চায়ের দোকানে চা পান করতে যান। এ সময় মিছিল থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে কয়েকটি ককটেল ছোড়া হয়। পুলিশ শিবিরের কর্মীদের লক্ষ্য করে শটগান থেকে গুলি এবং কাঁদানে গজ্ঝাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এ সময় শিবিরের কর্মীদের মধ্য থেকে কেউ একজন বলে ওঠেন, 'পুলিশ কম আছে, ধর।' এ অবস্থায় ওসি ও তার সঙ্গে থাকা পুলিশ সদস্যরা আত্দরক্ষার্থে রাস্তার পাশে দৌড় দেয়। এর মধ্যেই শিবিরের কর্মীরা চারদিক থেকে তাদেও ঘেরাও করে ফেলেন। তারা প্রথমে হাতে থাকা বাঁশের লাঠি দিয়ে পুলিশদেও পেটাতে থাকেন। একপর্যায়ে তারা কনস্টেবল রেজাউল করিম ও মেরাজ উদ্দিনের হাত থেকে তাদের শটগান কেড়ে নিয়ে তাদেও পেটাতে শুরু করেন। পাশে ওসি ও আরেকজন কনস্টেবলকে পেটাতে থাকেন। হামলাকারীরা ওসির একটি পা ও হাতের আঙ্গুল ভেঙে দেয়। পরে অতিরিক্ত পুলিশ এলে জামায়াত-শিবির কর্মীরা পালিয়ে যায়। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি কনস্টেবল রেজাউল করিম বলেন, চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার কারণে তারা পেরে ওঠেননি। শিবিরের কর্মীরা পিটিয়ে তার বন্দুকটি ভেঙে ফেলেছেন। হামলাকারীরা ওসির ওয়্যারলেস সেটটি নিয়ে গেছেন। ঘটনার পর এলাকায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ ১৯ জনকে আটক করেছে। চট্টগ্রাম : নগরীর আগ্রাবাদ বেপারিপাড়া এলাকায় একটি টেম্পোতে আগুন দিয়েছে জামায়াত-শিবির কর্মীরা। এ সময় একটি সিএনজি অটোরিকশাও ভাঙচুর করে তারা। এদিকে সকালে খুলশী থানার ঝাউতলা ওয়্যারলেস রেলগেট সড়কে রোড ডিভাইডার ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়ে সড়ক অবরোধের চেষ্টা চালায় হরতাল সমর্থকরা। এ সময় তারা রাস্তায় পেট্টল ঢেলে অগি্নসংযোগ করে। নগরীর কোতোয়ালি থানার ডিসি হিল এলাকা থেকে ৪ পিকেটারকে আটক করেছে পুলিশ। এদিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আকবর খোন্দকারের মুক্তির দাবিতে উত্তর জেলা বিএনপি নগরীতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে।
সিলেট : পুলিশ বহনকারী গাড়িসহ অন্তত ১০টি গাড়িতে আগুন দিয়েছে জামায়াত-শিবির নেতা-কর্মীরা। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক বোমাবাজি করেছে হরতাল সমর্থকরা। বিভিন্ন স্থানে শিবির নেতা-কর্মীরা ঝটিকা মিছিল করে হাত বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক ছড়ায়।
দিনাজপুর : বেলা ১২টার দিকে নিমনগর ফুলবাড়ী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন রেলক্রসিংয়ে বিএনপির অবরোধকারীরা ঢাকা থেকে দিনাজপুরমুখী একতা এঙ্প্রেস ট্রেনকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এ সময় পুলিশ বাধা দিলে তাদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বেধে যায়। দফায় দফায় ৪ ঘণ্টাব্যাপী চলে এই সংঘর্ষ। এ সময় পুলিশ দুই শতাধিক রাউন্ড রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। সংঘর্ষের সময় বাসস্ট্যান্ড মোড়ে পুলিশ ও সাংবাদিকের দুটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও অগি্নসংযোগ করেছে। এখানে পুলিশ বঙ্ েভাঙচুর চালায় অবরোধকারীরা। কুমিল্লা : দেবিদ্বারে সোমবার পেট্রল ঢেলে আগুন দিয়ে ট্রাকচালক ও হেলপারকে দগ্ধ করার ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে মো. ফখরুল ইসলাম নামে শিবিরের এক নেতাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ফেনী : জামায়াত-শিবির কর্মীরা জেলা নির্বাচন অফিস লক্ষ্য করে কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ করেছে। তারা শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে ককটেল বিস্ফোরণ, একযোগে ঝটিকা মিছিল, রাস্তায় খড়কুটায় আগুন জ্বালিয়ে পিকেটিং করেছে। পিকেটাররা কয়েকটি ব্যাটারিচালিত টমটম ও বেশ কয়েকটি রিকশা ভাঙচুর করেছে। রংপুর : বিকালে মিঠাপুকুর উপজেলা সদরে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ৬টি ককটেল হামলা করে জামায়াত-শিবির। এতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান জাকির হোসেন সরকার ও পুলিশ কনস্টেবল শহিদুল ইসলামসহ ৬ জন আহত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া : ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা নির্বাচন অফিসের পাশ থেকে ১৯টি তাজা ককটেল ও বিপুল পরিমাণ ককটেল তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ ছাড়া কসবায় সিএনজি অটোরিকশা, মোটরসাইকেল ভাঙচুর করেছে অবরোধকারীরা। বরিশাল : নগরীর কালীজিরা নতুনহাটে বাইপাস সড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে ও আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করা হয়। মানিকগঞ্জ : দুপরে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে খালপাড় মোড়ে সমাবেশ করে। নোয়াখালী : কোম্পানীগঞ্জের চরপার্বতী ইউনিয়নের চৌধুরীহাট সংলগ্ন লেঙ্গারটেক এলাকায় সোমবার রাতে পেট্রল বোমা বিস্ফোরণে বিপুল (২৭) নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী আহত হয়েছে। এছাড়া সূবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরবাটা ইউনিয়নের ছমিরহাট বাজারে অভিযান চালিয়ে দুই ইউপি সদস্যকে আটক করেছে পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে তিনটি ককটেল উদ্ধার করা হয়। মুন্সীগঞ্জ : জেলার ৩টি পয়েন্টে ২ গাড়িতে আগুন, ৯টি ভাঙচুর ও ২৪টি তাজা ককটেল উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। নারায়ণগঞ্জ : ফতুল্লার মাসদাইরে গতকাল সকালে হরতাল সমর্থনে মিছিল থেকে একটি ট্রাকে আগুন, যানবাহন ভাঙচুর করে। পরে পুলিশ এলে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে শিবিরের অন্তত চারজন গুলিবিদ্ধসহ ১০ জন আহত হয়েছে। পাবনা : জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) নেতা হাবিবুল ইসলাম মিন্টুর বাসভবনে দুর্বৃত্তরা পর পর ৩টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। সোমবার রাতে শহরের গোপালপুর মহল্লার মাটি সড়কস্থ বাসভবনে এ ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। তবে এ সময় কেউ হতাহত হয়নি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ : সকালে পিটিআই মোড়ে পুলিশ ও বিজিবিকে লক্ষ্য করে পরপর তিনটি ককটেল বিস্ফোরণ করে হরতাল সমর্থকরা। এ সময় পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে হরতালকারীদের দফায় দফায় ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া হয়। সিরাজগঞ্জ : সদর উপজেলার বহুলী বাজারে সোমবার সংঘর্ষে শিশু ছাত্র সুমন নিহতের ঘটনায় বিএনপির ডাকা হরতাল বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ও ককটেল বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে পালিত হয়েছে। লক্ষ্মীপুর : মিছিলে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থকদের মধ্যে সকালে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে উভয়পক্ষের অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। সাতক্ষীরা : কদমতলা এলাকায় সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে, গাছের গুঁড়ি ফেলে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে ১৮ দল নেতা-কর্মীরা। চতুর্থ দিনের মতো বন্ধ রয়েছে ভোমরা স্থল বন্দরের আমদানি-রপ্তানী কার্যক্রম। নাশকতা এড়াতে সাতক্ষীরার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশ, বিজিবি ও র্যাব মোতায়েন করা হয়েছে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।